নূরনবী ﷺ
নবুয়তের দায়িত্ব লাভ
আঠারতম অধ্যায়ঃ নবুয়্যতের অভিষেক বা দায়ীত্ব অর্পণঃ
কুরআন নাযিলের প্রথম সূচনাঃ
নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স যখন ৪০ বৎসর ৬ মাস ১৫ দিন, তখনই পবিত্র রমযানের শবে ক্বদর সোমবার রাত্রে কোরআন মজিদ নাযিলের ধারা সূচিত হয়। গভীর রাত, ঘন অন্ধকার, কৃষ্ণা তিথীর শেষাংশ। নবী করীম [ﷺ] গভীর ধ্যানে মগ্ন। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) গারে হেরার চূড়ায় নবীজীর [ﷺ] খেদমতে এসে উপস্থিত। তিনি কোরআন নাযিলের সূচনা করলেন এভাবে “ইকরা"- আপনি পাঠ করুন। শুধু একটি শব্দ। তিনবার উচ্চারণ করলেন জিব্রাইল (عليه السلام)। তিনবারই নবী করীম [ﷺ] বললেন- মা আনা বি-কারিয়ীন- “আমি পাঠক নই।" হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) তিনবার নবী করীম [ﷺ] কে জোরে আলিঙ্গন করলেন। এতে জিব্রাইলের (عليه السلام) পরিশ্রম হলো। নবী করীম [ﷺ] বলেন- “আমার পক্ষ হতে জিব্রাইলের নিকট জহুদ বা কষ্ট পৌঁছলো।" এই আলিঙ্গন ছিল যাতে বশরী ও যাতে মালাকীর মধ্যে সমন্ময় সাধন। পরস্পর দুই যাতের মধ্যে যে ব্যবধান ছিল, তা আলীঙ্গনের মাধ্যমে দূরীভূত হয়ে গেল।
এখানে হুযুর [ﷺ]-এঁর মালাকী ছুরত প্রকাশ পেল এবং জিব্রাইলও জাহেরী বশরী ছুরতের আধ্যাত্মিক পরশে ধন্য হলেন। আলিঙ্গনের এই অনুষ্ঠান ছিল ফয়েয আদান-প্রদানের আলিঙ্গন। এক সীনা হতে অন্য সীনায় যে প্রবাহ গমন করে - তাকে ফয়েয বলা হয়। এটা স্ফুলিঙ্গ সদৃশ। কারেন্ট যেভাবে প্রবাহিত হয়- ফয়েযও সেভাবে প্রবাহিত হয়। এজন্যই ইলমে মা’রেফাতকে ইলমে সীনা বলা হয় এবং শরীয়তের কিতাবী বিদ্যাকে বলা হয় ইলমে ছফীনা বা জাহাজী বিদ্যা।
হাদীস বিশারদগণের এটা আংশিক মতামত। তিনবার এই আনুষ্ঠানিকতা শেষে জিব্রাইল (عليه السلام) কোরআনের সুরা "আলাক"-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন। নবীজী পরে পাঠ করলেন। এভাবেই প্রত্যক্ষ অহী নাযিলের ধারা শুরু হলো।
এই পাঁচটি আয়াতই প্রথম প্রত্যক্ষ ওহী। সুতরাং এই পাঁচটি আয়াতের গুরুত্বও অপরিসীম। জ্ঞানের প্রথম সোপানই হলো পাঠ করা বা পড়া। কিন্তু মুসলমানরাই আজ জ্ঞানার্জনে সবচেয়ে অনগ্রসর। আমরা কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান চর্চা করছিনা। তাই এই অধঃপতন। উক্ত পাঁচটি আয়াতে মানব সৃষ্টির দ্বিতীয় স্তর “আলাক" বা রক্তপিন্ড উপাদানের উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে- কলমের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন এবং মানুষের অজানা তত্ত্ব কামেল মানুষকে (নবীজীকে) শিখিয়েছেন। বৈজ্ঞানিকদের সৃষ্টি সম্পর্কে গবেষণার মূল সূত্র এই পাঁচটি আয়াত। এভাবেই সমস্ত জ্ঞানের উৎস নবী করীম [ﷺ]-এঁর নিকট প্রকাশ করা হলো।
অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। নবী করীম [ﷺ] গারে হেরা থেকে নেমে নীচে আসলেন। এমন সময় জিব্রাইল (عليه السلام) শূন্যলোক থেকে আপন মূল ছুরতে দেখা দিলেন এবং বললেন, “আন্তা রাসুলুল্লাহ ওয়া আনা জিব্রাইল"- “আপনি আল্লাহর মনোনীত রাসূল এবং আমি জিব্রাইল ফেরেশতা"। মাওয়াহিব লাদুন্নিয়া গ্রন্থে আল্লামা শাহাবুদ্দীন কাস্তুলানী (رحمة الله عليه) লিখেন- ঐ সময়ই হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) জমিনে পদাঘাত করে পানি বের করে নিজে অযু করলেন এবং নবী করীম [ﷺ] কে ওযু করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিলেন। অযু শেষে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) দু’রাকাত নামায আদায় করলেন এবং হুযুর আকরাম [ﷺ] কে দু’রাকাত নামায আদায় করতে বললেন। সেই সময় থেকে নবী করীম [ﷺ] সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে সকালে ও সন্ধ্যায় দু’রাকাত করে ফজর ও মাগরিব নামায আদায় করতেন। এর ১১ বৎসর পাঁচ মাস পর নবীজী যখন মি’রাজ শরীফে গমন করেন, তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয় এবং মূল দু’রাকাতের সাথে মাগরিবে এক রাকাত, যোহর, আছর ও এশাতে দু’রাকাত করে যোগ করা হয়।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) কর্তৃক বর্ণিত নবুয়ত ধারার এই হাদীসখানা বোখারী শরীফে উল্লেখিত হয়েছে। হেরা গুহায় নবী করীম [ﷺ]-কে নবুয়তের দায়িত্বে অভিষিক্ত করা হয়। আরবীতে এই অভিষেককেই বি’ছাত বা মাব্আছ বলা হয়। প্রিয় নবী [ﷺ] আদম সৃষ্টির পূর্বেই নবী হিসাবে মনোনীত ছিলেন। দায়িত্ব প্রদান করা হয় হেরা গুহাতে। এদিনেই “আউয়াল ও আখের নবী" উপাধীর রহস্য প্রকাশ পায়। আউয়াল, আখের, যাহের, বাতিন যেমন আল্লাহর সিফাতি নাম, তেমনিভাবে নবী করীম [ﷺ]-এঁরও সিফাতি নাম (বেদায়া-নেহায়া ও মাওয়াহিব)।
[নবী করীম [ﷺ] যখন আকাশে তারকা হিসাবে বিরাজমান ছিলেন, তখন ঐ জগতের পাঁচশত চার কোটি বৎসর যাহের এবং পাঁচশত চার কোটি বৎসর বাতেন হিসাবে বিদ্যমান ছিলেন বলে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ]-এঁর দরবারে স্বীকার করেছেন। জিব্রাইলের মুখে এই স্বীকৃতি শুনে নবী করীম [ﷺ] বললেন, “আমিই সেই তারকা- হে জিব্রাইল"! ঐ সময়েও তিনি নবীই ছিলেন।
যাহের-বাতেন মিলিয়ে ঐ জগতের এক হাজার আট কোটি বৎসর পূর্বের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া নবী করীম [ﷺ] ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে সম্ভব কি? এটাই তো গায়েবের এক বড় সংবাদ। নবী শব্দের মূল ধাতু নাবাউন। এর অর্থ “গোপন সংবাদ প্রদান।" প্রত্যেক নবীর তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এক নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো- আল্লাহপ্রদত্ত গায়েবী এলেম, দুই নম্বর বৈশিষ্ট্য- ফেরেশতা দর্শন এবং তিন নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো- আল্লাহ্ প্রদত্ত সরাসরি জ্ঞান বা ইলমে বদিহী।
(ওহাবী লেখক সোলায়মান নদভীর সিরাতুন্নবী গ্রন্থের ৩য় খন্ড ১৬ ও ১৭ পৃষ্ঠা-উর্দ্দু)। সুতরাং নেতার কথা মেনে নেয়া তাদের উচিৎ।]
হেরাপর্বত থেকে অবতরণ করে নবী করীম [ﷺ] সোজা বিবি খাদিজার [رضي الله عنها] নিকট চলে আসলেন এবং বললেন, “তোমরা আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।" অকস্মাৎ ঘটনার স্বাভাবিক বিহবলতা কেটে যাওয়ার পর নবী করীম [ﷺ] বিবি খাদিজার নিকট হেরা গুহার সব ঘটনা খুলে বললেন। বিবি খদিজার (رضي الله عنها) শান্তনা দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিগত ১৫ বছরের চরিত্র মাধূর্য বর্ণনা করে বললেন, “আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন, আল্লাহ্’র শপথ, নিশ্চয়ই আপনাকে আল্লাহ অপদস্ত করবেন না। কেননা, আপনি আত্মীয়স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন, কথায় সততার প্রমাণ দিয়েছেন, মানুষের দুঃখ লাঘব করেছেন, অতিথিদের সেবা করেছেন, সত্যপথে বিপদগ্রস্থদের সহযোগিতা করেছেন।" একথা বলে বিবি খাদিজা সর্বপ্রথম নবী করীম [ﷺ]-এঁর উপর ঈমান আনয়ন করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজ স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর মহত্বের এমন স্বীকৃতি প্রদান এক বিরল ঘটনা। ইংরেজ লেখক ওয়ার্ডস ওয়ার্থ বলেছেন, “কোন মানুষই নিজ স্ত্রীর কাছে হিরো বা সাধু সাজতে পারে না। কিন্তু মুহাম্মদ [ﷺ]-এঁর বেলায় এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।" (NO MAN IS HERO TO HIS VALET EXCEPT MOHAMMAD.)
প্রিয় নবীর [ﷺ] চরিত্র মাধূর্য সম্পর্কে ১৫ বৎসর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে অবলোকন করার সুযোগ বিবি খাদিজার (رضي الله عنها) হয়েছিল। সামান্য ক্রটিও যদি পরিলক্ষিত হতো - তাহলে তিনি এভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতেননা। নবী করীম [ﷺ] বিবি খাদিজাকে অযু করার পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন এবং তাঁকে নিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করলেন। এ অবস্থা দেখে ৮/১০ বৎসরের বালক হযরত আলী (رضي الله عنه) ও ঈমান এনে নামাযে শরিক হয়ে গেলেন। বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হচ্ছেন হযরত আলী (رضي الله عنه), এরপর পুরুষগণের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه), আশ্রিত লোকদের মধ্যে পালিতপুত্র যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه) এবং ক্রীতদাসগণের মধ্যে হযরত বেলাল (رضي الله عنه)। মহিলাদের মধ্যে বিবি খাদিজার (رضي الله عنها) পর আবদুর রহমান ইবনে আউফ-এঁর মাতা হযরত শিফা (رضي الله عنها) প্রথম ইসলাম কবুল করেন। এরপর নবীজীর চাচী উম্মুল ফযল (رضي الله عنها), হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর কন্যা আসমা (رضي الله عنها) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। (আনওয়ারে মুহাম্মদীয়া)।
ফাত্রাত বা ওহী-বিরতিঃ
জিব্রাইল (عليه السلام)-এঁর বিদায় গ্রহণের পর তিন বৎসর পর্য্যন্ত কোরআন নাযিল বন্ধ ছিল। ইমাম বায়হাকী, ইমাম শাবী (رحمة الله عليه) থেকে বর্ণনা করেছেন- এই তিন বৎসর সময়ে হযরত ইস্রাফিল (عليه السلام) নবীজীর খেদমতে বিভিন্ন দোয়া ও বিষয় নিয়ে নাযিল হতেন। তিন বৎসর পর পুনঃ কোরআন নাযিল শুরু হয় এবং পরবর্তী বিশ বৎসরে তা সম্পন্ন হয়। এই মধ্যবর্তী তিন বৎসর সময়কে ফাত্রাতুল ওহী বা ওহী বিরতি সময় বলা হয়। এই সময়ে কোরাইশদের পক্ষ থেকে কোন বাধা আসেনি। তিন বৎসর পর যখন জিব্রাইল (عليه السلام) নিম্নোক্ত আয়াত নিয়ে পুনঃ আগমন করেন- يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرقُمْ فَأَنذِرُ
অর্থঃ “হে প্রিয় কম্বলধারী নবী! প্রস্তুত হোন এবং লোকদেরকে শতর্ক করুন।"
তখন থেকেই নবী করীম [ﷺ] দাওয়াতী কাজ শুরু করেন এবং প্রথমে নিজ পরিবার পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনদেন নিকট ইসলামের বানী পৌঁছাতে থাকেন। প্রিয় নবীর [ﷺ] চাচা আবু লাহাব ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে প্রকাশ্যে শত্রতা করতে আরম্ভ করে। তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল নবীজীর যাতায়াতের পথে কাটা বিছিয়ে রাখতো। আপন ঘরেই প্রথম শত্রু পয়দা হলো।