প্রসঙ্গঃ ইসলামের সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান মসজিদে নববী নির্মাণ, উসতুনে হান্নানার জীবন লাভ ও নবী বিচ্ছেদে ক্রন্দন
নবী করীম [ﷺ] সাত মাস পর্যন্ত হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه)’র গৃহের নিচ তলায় অবস্থান করেন। কেননা, লোকজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত ও সামাজিক কাজ-কর্মের জন্য এটাই সুবিধাজনক ছিল। এসময়ের মধ্যেই তিনি মসজিদে নববীর কাজ সমাপ্ত করেন। মসজিদের জায়গাটুকু দশ দিনার দিয়ে খরিদ করা হয়। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) এই জমিনের মূল্য পরিশোধ করেন। হিজরতের যাবতীয় খরচও হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) একা বহন করেন। জান মাল দিয়ে নবীজীকে সাহায্য করার এই কৃতিত্ব এককভাবে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর।
তিন দরজা বিশিষ্ট এই মসজিদ দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একশত হাত ছিল। দেওয়াল ছিল কাচা ইটের। খুটি ছিল খেজুর গাছের এবং ছাদ ছিল খেজুরপাতার ছাউনি। ভিটি ছিল পাথরকুচির, কেবলা ছিল ১৭ মাস পর্যন্ত উত্তর পশ্চিমে বাইতুল মোকাদ্দাসের দিকে। কেবলা পরিবর্তনের পর মিম্বার ও মেহরাবের স্থান দক্ষিণ দিকে এনে দক্ষিণমুখী করা হয়। মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পূর্ব কোণ কয়েকটি হুজরা তৈরী করা হয় – হযরত আয়েশা (رضي الله عنها), হযরত সওদা (رضي الله عنها) প্রমুখ উম্মুল মোমিনীনগণের জন্য। অতঃপর মক্কা শরীফ থেকে হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে কুলসুম, উম্মুল মোমিনীন হযরত সওদা, হযরত উম্মে আয়মান, উছামা ইবনে যায়েদ (رضي الله عنهم أجمعين) প্রমুখ হুযুরের পরিবারবর্গকে মদীনায় আনা হয়। হযরত যয়নব (رضي الله عنها) স্বামীগৃহে মক্কা শরীফে অবস্থান করেন। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এর সাহেবজাদা হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) মক্কায় গিয়ে তাঁর পরিবারবর্গকে মদীনায় নিয়ে আসেন।
মসজিদে নববীতে প্রথমে মিম্বর ও মেহরাব কিছুই ছিলো না। একটি মৃত খেজুর গাছের খুঁটিতে হেলান দিয়ে নবী করীম [ﷺ] শুক্রবারের জুমআর খুতবা দিতেন। পরে ৮ম হিজরীতে তিন তাক বিশিষ্ট কাঠের মিম্বার তৈরী হলে খেজুরের খুঁটিটি মসজিদের মেহরাবের পার্শ্বে সরিয়ে রাখা হয়। জুমআর নামাযে খুৎবা দেয়ার জন্য নবী করীম [ﷺ] মিম্বারে দন্ডায়মান হলে উক্ত খুটিটি শিশুর ন্যায় করুণ সুরে কেঁদে উঠে। সর্বশেষ কাতারে দন্ডায়মান হযরত আনাছ (رضي الله عنه) খুটিটির কান্না শুনতে পান। সমবেত সাহাবীগণ এতে স্তম্ভিত হয়ে যান। নবী করীম [ﷺ] খুতবা বন্ধ করে নেমে এসে খুটিটি কোলে তুলে নেন এবং তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকেন। অবশেষে বেহেস্তে তাঁকে লাগানো হবে এবং বেহেশতবাসীগণ তাঁর তাজা ফল ভক্ষণ করবেন - নবী করীম [ﷺ] এঁর এই আশ্বাসবাণীতে সে শান্ত হয়ে যায়। নবীজীর পরশে উসতুনে হান্নানার মধ্যে মানুষের হায়াত এসেছিল। তাই সে মানব শিশুর মতোই কেঁদেছিল।
হযরত ঈসা عليه السلام মৃত মানুষকে জীবিত করে কথা বলিয়েছিলেন। আর আমাদের প্রিয় নবীজীর সান্নিধ্য পেয়ে মৃত খেজুর গাছ জীবীত হয়ে মানুষের মতো কেঁদেছিল। ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله عليه) বলেন, “ঈসা আলাইহিস সালামের তুলনায় নবী করীম [ﷺ]-এঁর এই মো’জেজা ছিল উন্নত এবং সূক্ষ্মতর।" একাধিক সাহাবী কর্তৃক এই মো’জেজা বর্ণিত হয়েছে। তাই খবরে মোতাওয়াতের দ্বারা এটা প্রমাণিত। উক্ত উসতুনে হান্নানাকে পরে মানুষের মতই দাফন করা হয়। হাজী সাহেবানগণ এখনও উক্ত উসতুনে হান্নানাকে জিয়ারত করেন। মসজিদে নববীর একটি পিলারের নিচে এর অবস্থান এবং সে পিলারটির নাম উসতুনে হান্নানা।
নবী করীম [ﷺ] নিজের জন্য যে হুজরা তৈরী করেছিলেন, তাতে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) থাকতেন। এই হুজরাতেই অধিকাংশ সময় হযরত জিবরাইল عليه السلام ওহী নিয়ে আসতেন। এই হুজরা মোবারকেই রওজা শরীফ অবস্থিত। এর অর্ধেকে ছিল রওজা মোবারক এবং বাকী অর্ধেকে ছিল হযরত আয়েশা (رضي الله عنها)-এর বাসস্থান। পরে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) এবং হযরত ওমর (رضي الله عنه) কে উক্ত হুজরায় নবী করীম [ﷺ]-এঁর পাশে দাফন করা হয়। হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র কারণেই হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) হিজাব পরিধান (পর্দা) করতেন। কেননা, হযরত ওমর (رضي الله عنه) কে তিনি তাঁর রওজা থেকে চেয়ে থাকতে দেখেছিলেন (আল বাছায়ের)। নবী প্রেমিকগণ কবরে জিন্দা থাকেন এবং আল্লাহর অলীগণ কাশফের মাধ্যমে কবরবাসীকে দেখতে পান। এটা তাদের কারামত। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) এবং হযরত ওমর (رضي الله عنه) উভয়েরই কাশফুল কুবুর ছিল। মসজিদে নববীতে প্রথমে তেলের বাতি জ্বালানো হতো। হযরত তামিম দারী (رضي الله عنه) দামেশক হতে মূল্যবান ঝালর বাতি এনে পিলারের সাথে লাগান। নবী করীম [ﷺ] এ বলে দোয়া করলেন - “তামীম দারীর (رضي الله عنه) কবর যেন এমনিভাবে রৌশন হয়।"
হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র খেলাফত কালে খতমে তারাবীতে মসজিদে নববীতে অধিক আলোকসজ্জা করা হতো। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, “ওমরের কবরকেও আল্লাহ রৌশন দান করুন।" হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলতেন, “মসজিদে আলোকসজ্জার জন্য নবী করীম [ﷺ] হযরত তামীম দারীকে দোয়া করেছিলেন, আর আমার জন্য দোয়া করেছেন তাঁরই জামাতা ইমাম হাসান-হোসাইনের পিতা এবং বিবি ফাতেমা (رضي الله عنها)’র স্বামী হযরত আলী (رضي الله عنه)।" মসজিদে আলোক সজ্জা করার এটাই দলিল। (দেখুনঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান-সূরা দোখান)।
এটা ছিল মসজিদে নববীর প্রথম অবস্থা। বর্তমান অবস্থার সাথে তার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। নবী করীম [ﷺ] এঁর পর হযরত ওমর, হযরত উসমান, খলিফা আব্দুল মালেক, ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (رضي الله عنهم أجمعين) প্রমুখ কর্তৃক সজ্জিত হতে হতে মসজিদে নববী বর্তমান বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত হয়েছে। এগুলো যদিও বিদআতে হাসানাভুক্ত - অর্থাৎ নবী করীম [ﷺ] এঁর পরে সংযোজিত, তবুও পরিতাজ্য নয়। কেননা, কোন কোন বিদ’আত ওয়াজিব, যেমন – হযরত আলী (رضي الله عنه) কর্তৃক ইলমে নাহু, ইলমে ফেকাহ’র প্রচলন। কোন কোন বিদ’আত সুন্নাত, যেমন – ওমর (رضي الله عنه) কর্তৃক ২০ রাকআত বিশিষ্ট তারাবীহ নামাজ জামাতে আদায় করা এবং হযরত উসমান (رضي الله عنه) কর্তৃক জুমআর নামাজের প্রথম আজান প্রবর্তন করা। কোন কোন বিদ’আত মোস্তাহাব, যেমন – হযরত ওমর ও হযরত ওসমান (رضي الله عنهما) কর্তৃক মসজিদে নববী সজ্জিতকরণ ও নকশাকরণ। ৮৬ হিজরীতে কোরআন শরীফে নোকতা ও হরকত সংযোজন করা হয়। মিলাদ শরীফের মাহফিল সাজানো এবং আনুষ্ঠানিকভাবে খানাপিনা তৈরী করা, সমবেত দরূদ ও সালাম পেশ করার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করা বিদআতে মোস্তাহাব পর্যায়ভুক্ত ( মৌলুদে বরজিঞ্জি, শামী, নছরুদ দোরার ফি মৌলুদে ইবনে হাজর ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)।
তদুপরি, সপ্তম শতকের সমস্ত আলেম উলামা ও জনগণ কর্তৃক ইজমায়ে উম্মত দ্বারা মিলাদ মাহফিল প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ওহাবী সম্প্রদায় পরবর্তী যুগে মিলাদ শরীফের বিরোধিতা করলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের আপত্তি চিরদিন আপত্তি হিসেবেই থাকবে - মূল বিষয় কোনোদিনই হবে না।
মসজিদে নববী তৈরী করার কাজে নবী করীম [ﷺ] নিজে ইট সরবরাহ করে দিতেন এবং সাহাবীগণকে উৎসাহিত করার জন্যে আরবী কবিতা দ্বারা দোআ করতেন। কবিতার শেষাংশ ছিল-
اللهم لا عيش إلا العيش الآخرة + فارحم النصار والمهاجرة -
অর্থঃ- “হে আল্লাহ! পরকালের সুখই প্রকৃত সুখ। তুমি আমার আনসার ও মোহাজির সাহাবীদের প্রতি দয়া করে।"
ভালকাজে অনুরূপ মর্মের কবিতা পাঠ করা উত্তম। মসজিদের ছাদ পিটানো বা বিল্ডিং-এর ছাদ বা অন্য যেকোন ভারী কাজে দলবদ্ধ হয়ে ইসলামি কবিতা পাঠ করা বা গজল না’ত পাঠ করা উক্ত হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত।