(১) আরশের ছায়াপ্রাপ্ত লোকেরা সাত শ্রেণীর হবে। যথা-
روی مالک وغیرہ عن ابی ھریرۃ رضی اللّٰہ عنہ۔ عن النبی ﷺ ۔ سبعۃ یظلھم اللّٰہ فی ظلہ یوم لاظل الا ظلہ۔ الامام العادل ، وشاب نشأ فی عبادۃ اللّہ، ورجل قلبہ معلق بالمساجد، ورجلان تحابا فی اللّٰہ۔ اجتمعا علیہ۔ وتفرقا علیہ، ورجل دعتہ امرأۃ ذات منصب وجمال۔ فقال: انی اخاف اللّٰہ، ورجل تصدق بصدقۃ۔ فاخفاھا حتی لا تعلم شمالہ ما تنفق یمینہ، ورجل ذکر اللّٰہ خالیا۔ ففاضت عیناۃ
অর্থাৎঃ ইমাম মালেক (রহঃ) এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদগণ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। রাসুলকরিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন- “হাশরের ভীষণ রৌদ্রতপ্ত দিবসে সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবে- যে দিনে আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতিত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। তারা হলেনঃ (ক) ন্যায়পরায়ন শাসক (খ) আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত বয়োপ্রাপ্ত যুবক (গ) মসজিদের সাথে মনের আকর্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি (ঘ) এমন দুই ব্যক্তি, যারা পরস্পর বন্ধুত্ব করে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য, মিলিত হয় আল্লাহর রেযামন্দির জন্য এবং পৃথক হয়ে গেলে তাও হয় আল্লাহর সন্তষ্টির জন্যই (ঙ) এমন ব্যক্তি, যাকে কেউ উচ্চ বংশীয় সুন্দরী রমনী আহবান করলেও সে বলে, আমি আল্লাহ্কে ভয় করি (এমন নিকৃষ্ট কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়)। (চ) এমন ব্যক্তি, যে গোপনে দান করে, ডানহাতে দান করলে বামহাত জানেনা, কি পরিমান দান করলো (ছ) যেব্যক্তি নীরালায় দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর যিকির করে”। (তাযকিরাহ্ ২৬৪ পৃষ্ঠা)।
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীস সাধারণ উম্মতের ক্ষেত্রে। নবী ও ওলীগণের মর্তবা পৃথক হবে।
(২) ইমাম মুসলিম হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে একখানা হাদীস বর্ণনা করেছেন এভাবে,
مسلم عن ابی ھریرۃ رضی اللّٰہ عنہ۔ قال: قال رسول اللّٰہ ﷺ: من نفس عن مسلم کربۃ من کرب الدنیا نفس اللّٰہ عنہ کربۃ من کرب یوم القیامۃ۔ وذکر الحدیث ۔
অর্থঃ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন- রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “যেব্যক্তি কোন মুসলমানের দুনিয়াবী কষ্ট সমূহের মধ্যে একটি কষ্ট লাঘব করবে বা দূর করবে, আল্লাহ্পাক তার থেকে কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহের মধ্যে একটি কষ্ট লাঘব করবেন বা দূর করবেন। ” এরপর তিনি এ সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসে অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করেছেন” (মুসলিম শরীফ)।
(৩) হযরত আবদুর রহমান ইবনে ছামুরা (রাঃ) রাসুলেপাকের একটি দীর্ঘ হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
عن عبد الرحمٰن بن سمرۃ رضی اللّٰہ عنہ قال : خرج علینا رسول اللّٰہ ﷺ ذات یوم۔ ونحن فی مسجد المدینۃ۔ فقال: انی رأیت البارحۃ عجبا۔ رأیت رجلا من امتی۔ جاء ہ ملک الموت لیقبض روحہ۔ فجاء ہ برہ بوالدیہ۔ فرد عنہ، ورأیت رجلا من امتی۔ قد احتوشتہ الشیاطین۔ فجاء ہ ذکر اللّٰہ۔ فخلصہ من بینھم۔ ورأیت رجلا من امتی۔ قد احتوشتہ ملائکۃ العذاب۔ فجاء تہ صلاتہ۔ فاستنقذتہ من ایدیھم ، ورأیت رجلا من امتی۔ یلھث عطشا۔ کلما ورد حوضا منع منہ۔ فجاء ہ صیامہ۔ فسقاہ وارواہ، ورأیت رجلا من امتی والنبیون قعود حلقا۔ کلما دنا لحلقۃ۔ طردوہ فجاء ہ اغتسالہ من الجنابۃ۔ فأخذ بیدہ۔ واقعدہ بجنبی، ورأیت رجلا من امتی من بین یدیہ ظلمۃ۔ ومن خلفہ ظلمۃ۔ وعن یمینہ ظلمۃ۔ وعن شمالہ ظلمۃ ۔ ومن فوقہ ظلمۃ۔ ومن تحتہ ظلمۃ۔ فھو متحیر فیھا فجاء تہ حجہ وعمرتہ۔ فا ستخرجہ من الظلمۃ وادخلاہ فی النور، ورأیت رجلا من امتی یکلم المؤمنین فلا یکلمونہ۔ فجاء تہ صلۃ الرحم فقالت یا معشر المؤمنین۔ کلموہ۔ فکلموہ، ورأیت رجلا من امتی یتقی شررالنار۔ ووھجھا بیدہ عن وجھہ۔ فجاء تہ صدقتہ۔ فصارت سترا علی وجھہ۔ وظلا علی رأسہ۔ ورأیت رجلا من امتی۔ قد اخذتہ الزبانیہ من کل مکان۔ فجاء ہ امرہ بالمعروف ونھیہ عن المنکر۔ فاستنقذہ من ایدیھم۔ وادخلاہ مع ملائکۃ الرحمۃ ، ورأیت رجلا من امتی جاثیا علی رکبتیہ۔ بینہ وبین اللّٰہ حجاب۔ فجاء ہ حسن خلقہ۔ فاخذ بیدہ۔ فادخلہ علی اللّٰہ، ورأیت رجلا من امتی۔ قد ھوت صحیفتہ من قبل شمالہ۔ فجاء ہ خوفہ من اللّٰہ تعالی۔ فاخذ صحیفتہ۔ فجعلھا فی یمینہ، ورأیت رجلا من امتی۔ قدخف میزانہ۔ فجاء تہ افراطہ۔ فثقلوا میزانہ، ورأیت رجلا من امتی قائما علی شفیر جھنم فجاء ہ وجلہ من اللّٰہ۔ فاستنفذہ من ذلک ومضی، ورأیت رجلا من امتی ھوی فی النار فجاء تہ دموعہ التی بکی من خشیۃ اللّٰہ فی الدنیا۔ فاستخرجتہ من النار، ورأیت رجلا من امتی قائماعلی الصراط یرعدکما ترعد السعفۃ۔ فجاء ہ حسن ظنہ باللہ۔ فسکن رعدہ ومضی۔ ورأیت رجلا من امتی علی الصراط یزحف احیانا ویحبوا احیانا۔ فجاء تہ صلاتہ علی۔ فاخذت بیدہ واقامتہ ومضی۔ ورأیت رجلا من امتی۔ انتھی الی ابواب الجنۃ۔ فغلقت الابواب دونہ ۔ فجاء تہ شھادۃ ان لا الہ الا اللّٰہ ففتحت لہ الابواب۔ وادخلتہ الجنۃ ۔ (خرجہ الترمذی الحکیم فی نوادر الاصول عن ابیہ عن عبد اللّہ بن نافع عن ابی فدیک عن عبد الرحمٰن بن ابی عبد اللّٰہ عن سعید بن المسیب عن عبد الرحمن بن سمرۃ)
অর্থঃ হাকীম তিরমিযি তার “নাওয়াদিরুল উছুল” গ্রন্থে একখানা দীর্ঘ হাদীস সংকলিত করেছেন তার পিতা হতে, তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে নাফে’ থেকে, তিনি ইবনে আবি ফুদায়েক থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আবু আবদুল্লাহ্ থেকে, তিনি ছায়ীদ ইবনে মুসাইয়েব থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে ছামুরা (রাঃ) থেকে।
তিনি বলেন-“একদিন আমরা সাহাবীগণ মসজিদে নববীতে উপস্থিত ছিলাম- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজ্রা থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে তাশরীফ নিয়ে আসলেন এবং বলতে লাগলেন-
“আমি গতরাত্রে এক আশ্চর্য ধরণের স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম- আমার এক উম্মতের কাছে মালাকুল মউত তার জান কব্জ করার জন্য এসেছে। ওদিকে হঠাৎ করে তার পিতা-মাতার প্রতি তার ‘সদ্ব্যবহার’ এসে তাকে আযরাইল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসলো। আর এক উম্মতকে দেখলাম- অনেক শয়তান এসে তাকে ঘেরাও করে ফেলেছে। এমন সময় তার পঠিত ‘আল্লাহর যিকির’ এসে তাকে শয়তানের ঘেরাও থেকে মুক্ত করে দিলো। অন্য এক উম্মতকে দেখলাম- তাকে আযাবের ফিরিস্তারা এসে অবরূদ্ধ করে ফেলেছে। এমন সময় তার ‘নামায’ এসে তাকে ফিরিস্তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসলো। আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- সে পিপাসায় কাতর হয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে (মৃত্যু আসন্ন অবস্থায়)। যখনই সে একটি কুপের কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে- তখনই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন সময় তার ‘রোযা’ এসে তাকে ঐ কুয়ার পানি পান করালো এবং তাকে তৃপ্ত করলো। আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- আম্বিয়ায়ে কেরামগণ (আঃ) হাল্কা করে বা গোল হয়ে বসে আছেন। আর যখনই ঐব্যক্তি তাঁদের হাল্কার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করছে- তখনই তাকে হাঁকিয়ে পিছনে নিয়ে আনা হচ্ছে। এমন সময় তার ‘ফরয গোসল’ অগ্রসর হয়ে তাকে হাত ধরে আমার (নবীজীর) এক পার্শে এনে বসিয়ে দিল। আমার আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- তার সামনে অন্ধকার, পিছনে অন্ধকার, ডানে অন্ধকার, বামে অন্ধকার, উপরে অন্ধকার, নীচেও অন্ধকার। আর সে ঐ ঘোর অন্ধকারে হাতরাচ্ছে- আর ঘুরছে (রাস্তা পাচ্ছে না)। এমন সময় তার ‘হজ্ব ও ওমরাহ’ অগ্রসর হয়ে তাকে ঘোর অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে এনে দিল। আরেক উম্মতের দূরবস্থা দেখলাম- সে কিছু সংখ্যক মোমেন ভাইদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে- কিন্ত তারা তার কথায় সায় দিচ্ছে না। এমন সময় আত্মীয় স্বজনদের প্রতি তার ‘সদ্ব্যবহার’ এগিয়ে এসে বললো- হে মোমেনগণ, আপনারা তার সাথে কথা বলুন। তখন তারা কথা বললো। আমি আমার আরেক উম্মতের দূরবস্থা দেখতে পেলাম- সে লেলিহান আগুন থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে এবং আগুনের ফুল্কি তার মুখমণ্ডল থেকে হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। এমন সময় তার ‘সদকা খয়রাত’ এগিয়ে এসে তার মুখের উপর আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো এবং মাথার উপর ছায়া প্রদান করলো। আমার আরেক উম্মতের দুরাবস্থা দেখলাম- দোযখের ফিরিস্তারা এসে তাকে গ্রেফতার করে ফেলেছে। এমন সময় দেখি- তার ‘ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ’ এসে ফিরিস্তাদের হাত থেকে তাকে মুক্ত করে দিলো এবং রহমতের ফিরিস্তাদের দলে তাকে প্রবেশ করিয়ে দিলো।
আমার আর এক উম্মতের দূরবস্থা দেখতে পেলাম- সে হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে এবং আল্লাহ্ ও তার মধ্যখানে একটি পর্দা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় দেখলাম- মানুষের সাথে তার ‘উত্তম ব্যবহার’ এসে তাকে হাত ধরে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করে দিল। আমার আরেক উম্মতের দূর্গতি দেখলাম- তার আমলনামা তার বামহাতে চলে যাচ্ছে। এমন সময় ‘আল্লাহর প্রতি তার ভয়’ সামনে অগ্রসর হয়ে উক্ত আমলনামা তার ডানহাতে তুলে দিচ্ছে। আমার আরেক উম্মতকে দেখলাম- তার নেকীর পাল্লা হাল্কা হয়ে গিয়েছে। এমন সময় দেখলাম- তার ‘উত্তম অযু’ এগিয়ে এসে নেকীর পাল্লা ভারী করে দিল। আমার আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- সে জাহান্নামের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় তার ‘আল্লাহ্ ভীতির প্রকম্পন’ সামনে এগিয়ে আসলো এবং তাকে মুক্ত করে চলে গেলো। আমার অন্য এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- সে জাহান্নামের নীচের দিকে চলে যাচ্ছে। এমন সময় ‘আল্লাহর ভয়ে তার কান্নাকাটি’ এগিয়ে এসে তাকে জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করলো। আমার আর এক উম্মতকে দেখলাম- সে পুলসিরাতের উপর দাঁড়ানো আছে। সে এমনভাবে থরথর করে কাঁপছে- যেভাবে শীতের বাতাসে গাছের পাতা কাঁপে। এমন সময় দেখলাম- ‘আল্লাহর প্রতি তার উত্তম ধারনা’ এসে উপস্থিত। এতে তার কম্পন বন্ধ হয়ে গেলো এবং সে চলে গেলো। আমি আমার আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- সে পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে আছে- সে কখনও উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে এবং কখনও সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন সময় আমার প্রতি ‘তার মহব্বতের ﷺ’ শরীফ এগিয়ে আসলো এবং তার হাত ধরে পুলসিরাতের উপর স্থির করে দিল। সে পুলসিরাত অতিক্রম করে গেলো। আমার আর এক উম্মতের অবস্থা দেখলাম- সে বেহেস্তের দরজা পর্য্যন্ত পৌছে গেলো। হঠাৎ করে দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। এমন সময় দেখি, তার স্বাক্ষীমূলক কলেমা “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু” এসে উপস্থিত। বেহেস্তের দরজা পুনঃ খুলে গেলো এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিলো”। (তাযকিরাহ্ ২৬২-২৬৩ পৃষ্ঠা)।
মন্তব্যঃ এই একটি হাদীসই মানুষের যাবতীয় নেক আমলের উপকারিতার একটি বাস্তবচিত্র মানসপটে অঙ্কন করে দিয়েছে। পড়তে গেলে হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। লিখতে গেলে কলম থরথর করে কেঁপে উঠে। কবর ও হাশরের ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা কবচ হচ্ছে ঈমান ও আমল।
মসজিদে নববীতে উপবিষ্ট সাহাবীদের নিকট যখন তিনি এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন- তখন সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা কেমন হয়েছিল- তা কল্পনা করলে চোখের পাতা ভিজে উঠে এবং সামনে অন্ধকার দৃষ্টিগোচর হয়।
উল্লেখ্যঃ নবীজীর স্বপ্নই অহী। এতে ফিরিস্তার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি অহী হয়। হুযুরের স্বপ্নদর্শন এবং বাস্তবদর্শনের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। অত্র হাদীসে হাশরের যে ভয়াবহ অবস্থা বর্ণনা করা হলো- তার থেকে বাঁচতে হলে দুনিয়ার যেসব কাজ উপকারে আসে- তা হলো-
হাদীসের সারমর্ম
======
(১) পিতামাতার প্রতি সৎব্যবহার (২) অযু (৩) আল্লাহর যিকির (৪) নামায (৫) রোযা (৬) ফরয গোসল (৭) হজ্ব ও ওমরাহ্ (৮) আত্মীয়তার অটুট বন্ধন (৯) সদ্কা খয়রাত (১০) সৎকাজে আদেশ, মন্দকাজে নিষেধ (১১) সৎচরিত্র ও সৎস্বভাব (১২) প্রত্যেক কাজে আল্লাহ্ভীতি (১৩) ভাল করে পবিত্রতা অর্জন (১৪) আল্লাহর ভয়ে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি (১৫) আল্লাহর ভয়ে রোদন (১৬) আল্লাহর প্রতি উত্তম ধারনা (১৭) নবীজীর উপর ﷺ শরীফ পাঠ (১৮) কলেমা শাহাদাত বা ঈমান। এই ১৮ টি বিষয় তিনি একরাত্রে স্বপ্নে দেখেছেন। দুনিয়ার খাস খাস আমল কবর ও পরকালের খাস খাস আযাব হতে মুক্তির উছিলা হবে। ইহাই অত্র হাদীসের মূল বিষয়।
এখানে গুরুত্ব সহকারে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, হাশরের দিনের ভয়াবহ অবস্থা ও চিত্র মানুষের জ্ঞানের বাইরের বিষয়। এই বিষয়ের চাক্ষুস ধারণা ও জ্ঞান একমাত্র নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্পাক দান করেছেন। প্রকাশ্য জগত ও অপ্রকাশ্য জগতের মধ্যখানের হিজাব বা পর্দা আল্লাহ্পাক নবীজীর জন্য তুলে নিয়েছেন বলে সহীহ হাদীসে উল্লেখ আছে। যেমন-
قال رسول اللّٰہ ﷺ: ان اللّٰہ رفع لی الدنیا۔ فانا انظر الیھا وما ھو کائن الی یوم القیامۃ کانی انظر الی کفی ھذا رواہ البیھقی والطبرانی عن ابی الدرداء رضی اللّہ عنہ ۔
অর্থাৎঃ “আল্লাহ্পাক সব সময়ের জন্য দুনিয়া আমার সামনে উন্মুক্ত করে রেখেছেন (মধ্যখানের পর্দা তুলে নিয়েছেন)। অতএব দুনিয়ার বর্তমানও ভবিষ্যতে ঘটিতব্য সব বিষয় আমি এখনও অবলোকন করছি এবং ভবিষ্যতেও অবলোকন করতে থাকবো- এমন পরিষ্কারভাবে এবং নিকটে- যেন আমার এই হাতের তালু দেখছি”। (বায়হাকী ও তাবরানী- আবু দারদা (রাঃ) সুত্রে)।
অতএব তিনি “হাযির ও নাযির”।
(৪) হযরত কা’ব ইবনে আমর ওরফে আবুল ইউছ্র (রাঃ) থেকে হাদীস বর্ণিত-
انہ سمع النبی ﷺ یقول: من انظر معسرا۔ او وضع عنہ۔ اظلہ اللّٰہ فی ظلہ رواہ مسلم ۔
অর্থাৎঃ ইবনে আমর আবুল ইউছ্র নবী করিম (ﷺ) কে একথা এরশাদ করতে শুনেছেন “যেব্যক্তি সামর্থহীন ব্যক্তিকে দেনা পরিশোধে বর্দ্ধিত সময়ের সুযোগ দেয় অথবা ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ্পাক তাকে নিজ আরশের নীচে ছায়া দান করবেন”। (মুসলিম শরীফ)।
(৫) হযরত আনাছ (রাঃ) বর্ণনা করেন-
قال رسول اللّہ ﷺ: من اشبع جائعا۔ وکسی عریانا۔ واوی مسافرا۔ اعاذہ اللّہ من اھوال یوم القیامۃ۔
অর্থাৎঃ রাসুলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “যেব্যক্তি ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করে এবং মুসাফিরকে আশ্রয় দেয়, আল্লাহ্পাক কেয়ামতের দিন তাকে ভয়াবহ অবস্থা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থান দিবেন।” (আবু হাদিয়া ইব্রাহীম)।
(৬) হযরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) বর্ণনা করেন-
قال رسول اللّٰہ: من لقم لقمۃ۔ صرف اللّٰہ عنہ مرارۃ المؤقف یوم القیامۃ (طبرانی)
অর্থাৎঃ আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে এক লোক্মা খাদ্য দান করবে- আল্লাহ্পাক কেয়ামতের দিন তার থেকে হাশরের তিক্ত কষ্ট দূর করবেন”। (তাবরাণী শরীফ)।
(৭) কোরআন মজিদের ছুরা দাহার- এ সৎকর্মের ফলাফল সর্ম্পকে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
یوفون بالنذر ویخافون یوما کان شرہ مستطیرا۔ ویطعمون الطعام علی حبہ مسکینا ویتیما واسیرا۔ انما نطعمکم لوجہ اللّٰہ لا نرید منکم جزاء ولا شکورا 228 انا نخاف من ربنا یوما عبوسا قمطریرا 228 فوقاھم اللّٰہ شرذلک الیوم ولقھم نضرۃ وسرورا ۔ وجزاھم بما صبروا جنۃ و حریرا ۔
অর্থাৎঃ তারা (সৎ কর্মীরা) মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে- যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। খাদ্যের প্রতি তাদের আকর্ষন থাকা সত্বেও তারা অভাবগ্রস্থ, এতিম এবং বন্দীকে আহার্য্য দান করে। তারা বলে- আমরা কেবল আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের জন্যই তোমাদেরকে আহার্য্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। আমরা আমাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে আগত এক ভীতিপ্রদ ভয়ঙ্কর দিনের ভয় করি। অতঃপর আল্লাহ্ তাদেরকে সেদিনের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন। তাদের ধৈর্য্যরে পুরস্কার হবে সেদিন জান্নাত ও রেশমবস্ত্র”। (ছুরা দাহ্র ৭-১২ আয়াত)।
(৮) আল্লাহ্পাক সৎকর্মশীলদের নেক আমলের পুরষ্কার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরশাদ করেন-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا
অর্থঃ “যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে- আমি তাদের সৎকর্মের প্রতিদান বিনষ্ট করবোনা”। (ছুরা কাহাফ ৩০ আয়াত)।
(৯) আল্লাহ্পাক আরো এরশাদ করেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ وَالصَّابِؤُونَ وَالنَّصَارَى مَنْ آمَنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وعَمِلَ صَالِحًا فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
অর্থাৎঃ “যারা মুসলমান এবং যারা ইহুদী, ছাবেয়ী (তারকা পূজারী) ও খৃষ্টানদের মধ্য হতে ঈমান এনে মুসলমান হয়েছে, পরকালকে বিশ্বাস করেছে এবং সৎকর্ম করেছে- তাদের কারো কোন ভয় নেই ভবিষ্যতের জন্য- এবং তারা অতীতের ব্যাপারেও চিন্তিত থাকবে না”। (ছুরা মায়েদাহ্ ৬৯ আয়াত)।
বিঃ দ্রঃ আল্লামা কুরতুবী কোরআন মজিদের উপরোক্ত তিনটি দলীল উল্লেখ করে মন্তব্য করেন “কোরআন মজিদের যেসব আয়াতে আল্লাহ্পাক হাশরের আযাব থেকে মুক্তির ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হচ্ছে অতি সংক্ষেপ ও নীতিমালা স্বরূপ- অথচ ব্যাপক অর্থবোধক। যেমন, “আমলে ছালেহ” শব্দ। এটি অতি ব্যাপক। ঈমানের সাথে সব প্রকারের উত্তম কাজকেই “আমলে ছালেহ” বলা হয়। নবী করীম (ﷺ) ঐসব উত্তম কাজের বিস্তারিত ও বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন মাত্র। আল্লাহ্ হচ্ছেন সংক্ষিপ্ত বর্ণনাকারী, আর রাসুল হচ্ছেন তার বিশদ বর্ণনাকারী ও ব্যাখ্যাকারী। কোরআনের পূর্ণ ব্যাখ্যাই হচ্ছে হাদীস।
বিজ্ঞ উলামারাই বলতে পারেন, কোন্ আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা কোন্ কোন্ হাদীস? সুতরাং কোরআন ও হাদীস এক ও অভিন্ন- তবে সূর ও ভাষা ভিন্ন, একটি সংক্ষিপ্ত, অন্যটি বিস্তারিত- এই যা প্রভেদ। নবী করীম (ﷺ) যখন ভাষন দিতেন- তখন কোন কোন সময় কালামে মজিদের উদ্ধৃতি পেশ করতেন। তখন সাহাবীগণ স্পষ্ট বুঝে নিতেন- উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যাও মর্ম কী! আর আয়াত উল্লেখ না করলেও সাহাবীগণ হুযুরের বাচনভঙ্গিতেই বুঝে ফেলতেন- তিনি কোন্ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
তাই পরবর্তীকালে সাহাবীগণ কোরআন মজিদের আয়াত সমূহের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন- মূলতঃ তা ছিল নবীজীর মূখ হতেই শ্র“ত। তাঁরা কোন কোন সময় আয়াতের ব্যাখ্যায় নবীজীর নাম উল্লেখ করতেন- আবার কোন কোন সময় উল্লেখ করতেন না। সরাসরি ব্যাখ্যা বলে দিতেন। তাদের এই পদ্ধতিকে বলা হয় “মউকুফ” বা সাহাবীর সরাসরি মন্তব্য। হাদীসে মউকুফ যদি কবর, হাশর ও পরকাল সম্পর্কিত হয়- তাহলে এটাকে হাদীসে মারফু বা হুযুরের নিজস্ববাণী বলেই ধরে নিতে হবে, কেননা পরকালের গায়েবী খবর একমাত্র নবীজীই জানেন- অন্য কেউ নয়। (শেখ আবদুল হক দেহলভীর মেশকাত শরীফ সংযুক্ত মোকাদ্দমা দেখুন)।
কোরআনের ব্যাখ্যায় সাহাবীগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে অধিকাংশ সাহাবীর মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে (দেখুন ইত্কান আল্লামা জালালুদ্দীন ছুয়ুতি)। সাহাবীগণের ব্যাখ্যার মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) -এর ব্যাখ্যা অগ্রগণ্য। যে সাহাবী যত বেশী সোহবত বা নবীজীর সান্নিধ্য পেয়েছেন- তাঁর ব্যাখ্যা ততবেশী অগ্রগণ্য।
দূঃখের বিষয়, মিঃ মউদূদী সাহাবীগনের বিশ্বস্ততায় সন্দেহপোষন করে বলে- “কোরআন বুঝার জন্য আরবীভাষা ও ঐ যুগের মেজাজ এবং পরিবেশ জানাই যথেষ্ঠ। একজন বিজ্ঞ প্রফেসরই কোরআন বুঝার জন্য যথেষ্ঠ”। (সংক্ষিপ্ত মর্ম- ইসলামী রেঁনেসা আন্দোলন, রাসায়েল মাছায়েল- ইত্যাদি)। যদি তাই হতো- তাহলে এতদিনে গোটা ইসলামের রূপরেখাই বদলিয়ে যেতো।
--------
Home
»
কিতাবঃ হায়াত-মউত [লেখকঃ অধ্যক্ষ আবদুল জলিল (রহঃ)]
» তেত্রিশতম অধ্যায়ঃ হাশরের ভয়াবহতা হতে রক্ষাকারী আমল