উত্তর__মাওলানা বখতিয়ার উদ্দীন
□ কদমবুচি শুধু জায়েয নয়; বরং সুন্নাতে সাহাবাওঃ
__________________________________________
[ عن زارع وكان فى وفد عبد القيس قال لما قدمنا المدينة وجعلنا نتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله ﷺ ورجله. ]
হযরত যারা [رضي الله عنه] যিনি আব্দুল কায়েম গোত্রের প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন মদীনা শরীফে আগমন করলাম, তখন আমাদের বাহন হতে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম এবং সাইয়্যেদুল মুরছালীন, রাসূলে করীম [ﷺ]-এর হস্ত মুবারক এবং কদম মোবারক চুম্বন করলাম।"
[আবূ দাউদ শরীফের সূত্রে মিশকাতুল মাসাবীহ, ৪০২ পৃষ্ঠা]
প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
__________________
ইসলাম সুন্দরতম একটি আদর্শের নাম। ইসলামের শিষ্টাচারিতা অতি চমৎকার। ছোট-বড় সকলের প্রাপ্য অধিকার, সম্মান, স্নেহ, আদব, ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সুন্দর আচরণের যে শিক্ষা ইসলামে দেয়া হয়েছে- তা অন্য কোন ধর্মে দেখা যায় না। বড়দের সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ সম্পর্কে মহানবী [ﷺ] এরশাদ করেনঃ
[ من لم يرحم صغيرنا ولم يوقر كبيرنا فليس منا. ]
অর্থাৎ "যে বড়দের সম্মান করেনা এবং ছোটদের স্নেহ করেনা সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।" সুতরাং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নবী-ই করিম [ﷺ] -এর শিক্ষা। সম্মান প্রদশন বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমনঃ সালাম প্রদান, দেখলে সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া, কাজকর্মে সহযোগিতা করা, প্রয়োজনীয় বস্তু এগিয়ে দেয়া, পর সাক্ষাৎ হলে কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার প্রাক্কালে কদমবুচি করা।
বড়দের মধ্যে রয়েছে- মা-বাবা, শিক্ষকমন্ডলী, দাদা-দাদী, নানা-নানী, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, চাচা-চাচী, মামা-মামী, বড় ভাই, বড় বোন ইত্যাদি মুরব্বীদের কাছ থেকে দো'আ নেয়ার অন্যতম পন্থা হল সালাম বিনিময়ের পর কদমবুচি করা। এ কাজটি অত্যন্ত চমৎকার একটি শিক্ষা, যাতে করে শিশুরা মুরব্বীদের প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী হয়ে উঠে।
অনেকে এ কদমবুচি না'জা-য়েয মনে করে, এমনকি মুরব্বীদের কে কদমবুচি করা হারাম, শির্ক ইত্যাদি ফতোয়া দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। মূলত পবিত্র কোরআন-হাদীসের দলীল ছাড়া এ ধরনের লাগামহীন বক্তব্য দ্বারা নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তির শিকার হয়। আর সমাজ হয় শিষ্টাচার বঞ্চিত, ছোটদের মনে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা কমতে থাকে। তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সুন্দরতম আদব-কায়দার অন্যতম পন্থা যে কদমবুচি ইসলামী শরীয়তে কতটুকু অনুমোদিত তা পাঠকসম্মুখে উপস্থাপনই এ প্রয়াস। নিন্মে কদমবুচির বৈধতার উপর আরো কয়েকটি দলীল উপস্খাপন করা হলঃ
○ হাদীসঃ (০২)
হযরত ওয়াযে ইবনে আমের [رضي الله عنه] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
"একদা আমরা বিশ্বকূল সরদার, হুযূর করীম, রউফুর রহীম [ﷺ] -এর খেদমতে উপস্থিত হলাম অতঃপর: ( فاخذنا بيديه ورجليه نقبلها ) অর্থাৎ আমরা হুযূরের পবিত্র হাত এবং চরণযুগল ধরে চুম্বন করলাম।"
[ বুখারী ফিল আদাবুল মুফরাদ, ১৪৪ পৃষ্ঠা]
○ হাদীসঃ (০৩)
হযরত বুরাইদা [رضي الله عنه] বলেনঃ
[ سأل اعرابى النبى ﷺ اية فقال له قل لتلك الشجرة رسول الله ﷺ يدعوك فقال فمالت الشجرة عن يمينها وشمالها وبين يديها وخلفها فقطعت عروقها ثم جآئت يتخد الارض تجر عروقها مغبرة حتى وقعت بين يدى رسول الله ﷺ السلام عليك يا رسول الله قال الاعرابى مرها فلترجع الى منبتها فرجعت فدلت عروقها فاستوت فقال الاعرابى ائذن لى اسجد لك قال لو امرت احد ان يسجد لاحد لامرت المرأة ان تسجد لزوجها قال فأذن لى ان اقبل يديك ورجليك فاذن له. ]
অর্থাৎ- "একজন বেদুঈন হুযূর [ﷺ] -এর কাছে মু'জিযা চাইলো। হুযূর [ﷺ] বেদুঈন'কে এরশাদ করলেন, ওই বৃক্ষটাকে বলো আল্লাহর রাসূল তোমাকে ডাকছেন। সে যখন বললো, বৃক্ষটি তার ডানে-বামে, সম্মুখে-পেছনে, ঝুঁকল, তখন ওটার শেকড়গুলো ভেঙ্গে গেলো। তারপর তা মাটি খোদাই করে শিকড়গুলো টেনে ও বালি উড়িয়ে হুযূর [ﷺ] -এর সম্মুখে এসে দাঁড়াল এবং বললো- "আস্সালামু আলায়কা এয়া রাসূলাল্লাহ!" বেদুঈন বললো, "আপনি তাকে আদেশ করুন যেন ওটা ওখানে ফিরে যায়।" তাঁর নির্দেশে ওটা ফিরে গেল এবং তার শেকড়গুলোর উপর গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বেদুঈন বললো, "আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনাকে সাজদা করবো।" তিনি এরশাদ করলেন, "যদি কাউকে সাজদা করার হুকুম দিতাম তাহলে নারীকে হুকুম দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সাজদা করে।" বেদুঈন আরয করলো- "হুযূর! তাহলে আমাকে আপনার হস্ত ও পদদ্বয় চুম্বন করার অনুমতি দিন।" তিনি তাকে অনুমতি প্রদান করলেন।" [শিফা শরীফ, দালাইলুন্নবূয়্যাহ, আবূ নাঈম, পৃষ্ঠা-৩৩২]
○ হাদীসঃ (০৪)
হযরত সোহাইব [رضي الله عنه] বলেনঃ
[ رأيت عليا يقبل يد العباس ورجليه. ]
অর্থাৎঃ আমি হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা [رضي الله عنه] কে দেখেছি, "তিনি হযরত আব্বাস [ رضى الله عنهما ] -এর হাতে ও পায়ে চুমু দিচ্ছেন।" [বুখারী ফিল আদাবুল মুফরাদ, পৃষ্ঠা- ১৪৪]
○ হাদীসঃ (০৫)
হযরত ইবনে জাদ'আন [رضي الله عنه] বলেন, হযরত সাবিত [رضي الله عنه] হযরত আনাস [رضي الله عنه] কে বলেছেন-
[ امسست النبى ﷺ بيدكا قال نعم فقبلها. ]
অর্থাৎঃ "আপনি কি ছরকারে দো'জাহান, রাসূলে আরাবী, নবী করিম [ﷺ] কে আপনার হাত দ্বারা স্পর্শ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি তাঁর হাতে চুম্বন করলেন।" [বুখারী ফিল আদাবুল মুফরাদ, পৃ. ১৪৪]
প্রমাণিত হল- ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনার্থে বুযুর্গানে দ্বীনের হাত ও পায়ে চুম্বন করা শুধু জায়েযই নয়; বরং সুন্নাত সম্মত।
কতেক লোক বুযুর্গানে দ্বীনের হাত ও পায়ে চুমু খাওয়াকে শির্ক, পূজা ইত্যাদি বলে থাকে। উল্লেখিত বিশুদ্ধ বর্ণনা সমূহ তাদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত। যদি হস্ত ও পদ চুম্বন করা শির্ক হতো তাহলে হুযূর [ﷺ] কখনোই তা করার অনুমতি প্রদান করতেন না। প্রতীয়মান হলো- হস্ত ও পদ চুম্বন করলেও সম্মান প্রদর্শনার্থে শির্ক কিংবা পূজা নয়। যদি এটাকে শির্ক বলা হয়, তবে কি হুযূর [ﷺ] -এর প্রতি শির্ক করার অনুমতি প্রদান করেছেন? এবং সাহাবায়ে কেরামের দ্বারা কি শির্ক সংঘটিত হয়েছে? (না'ঊযুবিল্লাহ্!) এর কোনটিই হতে পারে না।
রাসূলাল্লাহ [ﷺ] আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দ্বীন সহকারে প্রেরিত হয়েছেন, তার (দ্বীন) মৌলিক শিক্ষাই হল, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই।
যেহেতু বিশুদ্ধ হাদিস শরীফ এবং সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র জীবনে কদমবুচি তথা সম্মান প্রদর্শনার্থে বুযুর্গানে দ্বীনের হাত ও পা চুম্বন করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, তাই বলা যায়- কদমবুচি করা কোন গর্হিত কাজ তো নয়ই, বরং এটা একটা বরকতময় আমল। কদমবুচি শির্ক বলে যারা ফিতনা-ফেসাদ সৃষ্টি করে, তারা বলে বেড়ায় কারো সামনে মাথা নিচু করাই সাজদা আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সাজদা করা হারাম; তাই কদমবুচিও হারাম। অথচ তাদের জানা দরকার, রুকূ'ও সিজদার জন্য নিয়্যত আব্যশক। যেহেতু কদমবুচির ক্ষেত্রে কোন মুসলমানের অন্তরে কষ্মিণকালেও সাজদা করার নিয়্যত থাকেনা, সেহেতু কদমবুচি হারাম বলাটা ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির নামান্তর।
[দরসে হাদীস; কৃত- মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দীন।, পৃ. ৭৭]
।।।