নূরনবী ﷺ
বিবাহিত জীবন
পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ বিবাহিত জীবনে প্রবেশঃ
প্রসঙ্গঃ বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ, ব্যবসায়ী জীবনযাপন এবং সামাজিক সেবায় আত্মনিয়োগ
বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর সাথে হুযুর আকরাম [ﷺ]-এঁর বিবাহ বন্ধন তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও আমনতদারীর এক উজ্জ্বল ফসল। বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) আরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন। ইয়েমেন, সিরিয়া, মদীনা ও বছরা শহরে ছিল তাঁর বাণিজ্য কুঠি। তিনি লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের (মুদারাবা) ভিত্তিতে তাঁর ব্যবসায়ে লোক নিয়োগ করতেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সত্যবাদিতা, আমানতদারী ও চরিত্র মাধুর্যের কথা শুনে তাঁর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব পেশ করলে নবী করীম [ﷺ] সানন্দে তাতে রাজী হন। বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর বিশ্বস্ত গোলাম মাইছারাকে সাথে করে নবী করীম [ﷺ] বিবি খাদিজার বাণিজ্যপণ্য নিয়ে সিরিয়ায় গমণ করেন এবং প্রচুর লাভ করে মক্কায় ফিরে আসেন।
পথিমধ্যে মাইছারা দেখতে পায়- দু’জন ফেরেশতা নবী করীম [ﷺ] কে সূর্যের তাপ থেকে পাখা বিছিয়ে ছায়া দিচ্ছে। মক্কায় ফিরে মাইছারা আপন মনিব বিবিকে এ সংবাদ দিলে বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং মনে মনে নবীজীর চরণে আপন জীবন সমর্পণ করার সংকল্প করেন। তিনি ছিলেন একে একে দুই স্বামীহারা বিধবা, ৪০ বছর বয়স্কা মহিলা। চরিত্রমাধুর্যে লোকে তাঁকে তাহেরা (পবিত্রা) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি আপন গোলামের মাধ্যমে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। নবী করীম [ﷺ] আপন চাচাদের মতামত নিয়ে জানাবেন বলে জবাব দিলেন। এই প্রস্তাবে আবু তালেব, হামযা ও আব্বাস সানন্দে রাজী হলেন এবং সামাজিক প্রথানুযায়ী বিবাহের কাজ সম্পন্ন করলেন। তখন নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স ছিল পঁচিশ বৎসর।
এই বিবাহে খুতবা পাঠ করেন আবু তালেব। খুতবার সারমর্ম ছিল এই- “আমি ঐ আল্লাহর প্রশংসা করছি- যিনি আমাদেরকে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এঁর বংশে এবং হযরত ইসমাইল (عليه السلام) কর্তৃক আবাদকৃত মক্কা ভূমিতে স্থাপিত করেছেন এবং বংশ পরম্পরায় মাআদ ও মুদার গোত্রের মূল শাখার অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তিনি আমাদেরকে তাঁর পবিত্র হেরেমের পরিচালক ও তাঁর ঘরের সেবক নিযুক্ত করেছেন এবং মক্কায় বসবাসকারী জনপদের উপর আমাদেরকে শাসক নিযুক্ত করেছেন। আমার এই ভাতিজা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহকে যেকোন লোকের সাথে তুলনা করা হলে তাঁর ওজনই ভারী হবে। যদিও আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর নেই, অর্থ-সম্পদ তো ঢলে পড়া ছায়ামাত্র, তবুও তাঁর আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে আপনারা সবাই অবগত রয়েছেন।"
খুতবা শেষে ১২ উকিয়া রৌপ্য বা ৪৮০ দিরহাম মোহরানার বিনিময়ে হযরত খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর নিকট বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। হযরত খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর পক্ষে তাঁর চাচা উকিল হয়ে এই বিবাহকার্য্য সম্পাদন করেন। 'আল আমীন' [ﷺ] ও 'তাহেরা' (رضي الله عنها) দম্পতির দাম্পত্য জীবন কেটেছিল ২৫ বৎসর। বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) আদর্শ স্বামী পেয়ে জীবন ও অর্থ-সম্পদ সব কিছু নবীজী [ﷺ]-এঁর চরণতলে সঁপে দিলেন। তাঁদের পবিত্র সংসারে হযরত কাসেম, হযরত যয়নব, হযরত আবদুল্লাহ, হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম ও হযরত বিবি ফাতেমা (رضي الله عنهم) জন্মগ্রহণ করেন। অন্য রেওয়ায়াত মতে, (ইবনে হিশাম) হযরত তৈয়ব ও হযরত তাহের নামে আরও দু’জন সাহেবজাদার নাম উল্লেখ করেছেন। এ হিসাবে বিবি খাদিজার ঘরে নবী করীম [ﷺ]-এঁর চার সাহেবজাদা ও চার সাহেবজাদী- মোট আটজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। চার সাহেবজাদা শৈশবেই ইনতিকাল করেন। সাহেবজাদী সকলেই নবুয়ত যুগ পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন ও বিবাহিত জীবন যাপন করেন। সবচেয়ে ছোট ও প্রিয় কন্যা বেহেস্তের নারীগণের সর্দার হযরত বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها)-এঁর সন্তানগণই কিয়ামত পর্যন্ত প্রকৃত সাইয়্যেদ খান্দান নামে অভিহিত। অন্য কেউ বংশ পরিচয়ের ক্ষেত্রে আইনগত সাইয়্যেদ হতে পারবেন না। তবে সম্মানসূচক “সাইয়্যিদ" শব্দ অন্যান্য সাহাবীদের বংশধরের নামের সাথেও যোগ করা যাবে। ইমাম হাসান ও হোসাইন (رضي الله عنهما)-এঁর বংশ ছাড়া কেউ ‘আওলাদে রাসূল’ দাবী করলে তা মিথ্যা হবে। আজকাল সৈয়দ বা আওলাদে রাসূল নাম ধারণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়- যার কারণে প্রকৃত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রাসূল খুঁজে বের করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ইমাম হাসান ও হোসাইন (رضي الله عنهما) পর্যন্ত পুরুষ কুষ্ঠিনামা বা নসবনামা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হলে তাঁকে প্রকৃত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রাসূল বলা যাবে না। পিতা সাইয়েদ না হলে মায়ের কারণে সন্তানগণ সৈয়দ বলে গণ্য হবে না।
হযরত বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) হুযুরের নবুয়ত ঘোষণার পূর্বে ১৫ বৎসর এবং নবুয়ত ঘোষণার পর ১০ বৎসর হুযুর [ﷺ]-এঁর ঘর-সংসার করেছেন। তাঁর অগাধ সম্পদ নবীজীর চরণে সঁপে দিয়েছিলেন। নবী করীম [ﷺ] গরীব, মিছকিন, ইয়াতীম, কাঙ্গাল, বিধবা ও সহায়-সম্বলহীন জনগণের পুনর্বাসনে সব সম্পদ দান করে দেন। মক্কার কুরাইশগণ কর্তৃক তিন বৎসরকাল ‘বয়কট’ সময়ে বিবি খদিজা (رضي الله عنها) নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাথে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছিলেন এবং ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ছাল বাকল পর্যন্ত খেয়েছিলেন। একজন ধনবতী মহিলার এই স্বামীপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ একমাত্র আইয়ূব (عليه السلام)-এঁর বিবি ও ইউসুফ (عليه السلام)-এঁর কন্যা হযরত রহিমার সাথেই তুলনীয় হতে পারে। (তাফসীরে সাভী, সূরা ইউসুফ)।
[বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর স্বামীপ্রেম ও স্বামীভক্তি আমাদের নারীসমাজের জন্য এক চমৎকার অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় আদর্শ।]
নবী করীম [ﷺ]-এঁর দাম্পত্য জীবনের প্রথম ১৫ বৎসরের বিস্তারিত দৈনন্দিন ঘটনাবলী জানা না গেলেও মোটামুটিভাবে নিম্নরূপ ছিল। ২৭ বৎসর বয়সে হুযুর আকরাম [ﷺ]-এঁর প্রথম সন্তান হযরত কাশেম (رضي الله عنه) জন্মগ্রহণ করেন এবং দুই বৎসর পর ইনতিকাল করেন। ৩০ বৎসর বয়সের সময় বিবি যয়নাব (رضي الله عنها) জন্মগ্রহণ করেন। এর পর পর অন্যান্য সাহেবজাদা ও সাহেবজাদীগণ জন্মগ্রহণ করেন ৪০ বৎসর বয়সের মধ্যেই।
যখন নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স ৩২ বৎসর, তখন আপন চাচাত ভাই হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর জন্ম হয়। জন্মের পর নবী করীম [ﷺ] আপন চাচা আবু তালেবের নিকট থেকে হযরত আলীকে লালন-পালনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) আপন সন্তানবৎ হযরত আলীকে লালন পালন করেন। এটা ছিল চাচার প্রতিপালনের বিনিময়ে প্রতিদানস্বরূপ। হযরত আলী (رضي الله عنه) শিশুকাল থেকেই নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিশেষ যত্নে ও সান্নিধ্যে গড়ে উঠেন এবং পরবর্তীকালে বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها)-এঁর যোগ্য স্বামী হবার গৌরব অর্জন করেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর সাথে বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها)-এঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।
বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণকাল থেকে বিবাহোত্তর ১৫ বৎরের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-
(১) নবী করীম [ﷺ] যৌবনের প্রারম্ভেই 'আল আমীন' খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন- যা ছিল দুর্লভ গৌরব।
(২) হুযুর আকরাম [ﷺ] জীবিকা অর্জনের জন্য মেষ চড়ানো ও ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ করতেন। হুযুর আকরাম [ﷺ] এরশাদ করেন, “সকল নবীগণই নিজ হাতে অর্জিত হালাল রুজী দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমানতদার সত্যবাদী ব্যবসায়ীগণ কিয়ামতের দিনে নবীগণ, ছিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সাথে থাকবেন।" (মিশকাত শরীফ)
(৩) বিবি খাদিজা (رضي الله عنها)-এঁর সম্পদ লাভ করেও নবী করীম [ﷺ] মনি-কাঞ্চনে বিভোর ছিলেন না। সম্পদ ছিল তাঁর আয়ত্বাধীন। তিনি কখনও সম্পদের অধীন বা ভোগ-বিলাসী ছিলেন না। এখানেই দুনিয়া ও আখেরাতের পার্থক্য নির্ধারিত হয়।
(৪) অসহায়, ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব-মিছকিনদের সেবা করা নবীজীবনের প্রথম উত্তম সমাজ সেবামূলক কাজ ছিল।
(৫) কেউ উপকার করলে তার বিনিময়ে প্রতিদান দেয়া ও স্বীকৃতি প্রদান করা নবীজীর তরিক্বা। যেমনঃ তিনি করেছিলেন হযরত আলীর প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
(৬) চরিত্র মাধুর্য বড় সম্পদ। চরিত্রবান লোক সকলের নিকটই প্রশংসার পাত্র।
(৭) বিবাহবন্ধন একটি পবিত্র কাজ ও সভ্যতার মূলভিত্তি। একাজে অভিভাবকগণের সম্মতি জরুরী। বর্তমানকালের যুবক-যুবতীগণ এ আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। নতুবা আদালতে জনসমক্ষে অপমানিত হতে হবে এবং পরবর্তী দাম্পত্য জীবনও বিষময় হয়ে উঠবে।
(৮) দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য হলো - সন্তানাদির দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা, শুধু ভোগ বিলাস নয়।
(৯) বৈরাগী জীবন ইসলাম সম্মত নয়। "লা রাহবানিয়াতা ফিল ইসলাম।"
(১০) নবী করীম [ﷺ]-এঁর নবুয়তপূর্ব এবং নবুয়ত-পরবর্তী সমগ্র জীবনই আমাদের জন্য আদর্শ।
যারা শুধু ২৩ বৎসরকে মডেল ধরে ইসলামের নামে সংগ্রাম করে, তারা ভ্রান্ত।
(১১) শিশুকাল হতেই নবুয়তের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ এবং বাণিজ্য কাফেলায় ফেরেশতাদ্বয়ের ছায়া প্রদান নবুয়ত প্রকাশের পূর্বাভাস।