প্রসঙ্গঃ দূর্গ জয়ের গায়েবী সংবাদ, হযরত আলীর চক্ষুরোগ থুথু মোবারকের মাধ্যমে প্রশমন, ডুবন্ত সূর্যকে পুনঃ উদিতকরণের মো’জেযা প্রদর্শন, ইহুদী রমনী কতৃক খাদ্যে বিষ মিশ্রণ ও নবীজীর ক্ষেত্রে বিষক্রিয়া নিস্ক্রিয়করণ-ইত্যাদি
ঘটনাঃ
খায়বর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৭ম হিজরীর মুহররম ও সফর মাসে। ১৯ দিন খায়বরের ইহুদী দূর্গ অবরোধের পর অবশেষে হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর হাতে দূর্গের পতন হয়।
বিবরণঃ
মদীনা হতে বিতাড়িত বনূ নযীর ও বনূ কাইনুকা ইহুদী গোত্রদ্বয় খায়বরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এবং তারা মদীনা শরীফ আক্রমণের ষড়যন্ত্র করছিল। মদীনা থেকে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াতের পথে খায়বরের ইহুদীরা উৎপাত করতো। তাই হোদায়বিয়া হতে প্রত্যাবর্তনের পরপরই নবী করীম [ﷺ] চৌদ্দশত পদাতিক ও দুই শত অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে খায়বর যাত্রা করেন। মুহররমের শেষের দিকে তিনি এই যুদ্ধযাত্রা করেন। লটারীর মাধ্যমে সাথে নেন বিবি উম্মে সালামা (رضي الله عنها)-কে।
বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে, নবী করীম [ﷺ] রাত্রিবেলায় খায়বরে উপস্থিত হন। কিন্তু রাতে আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন। এটাই ছিল তাঁর নিয়ম। ভোরে ইহুদীরা দূর্গ থেকে বের হয়ে মুসলিম বাহিনী দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারা চিৎকার করে বলে উঠে- আশ্চার্য্য! মুহাম্মদ [ﷺ] এবং তাঁর বাহিনী এসে গেছে!
নবী করীম [ﷺ] তাদের উদ্দেশ্যে “আল্লাহু আকবর" ধ্বনী দিয়ে বলে উঠলেন- “আমরা যে ময়দানেই অবতরণ করি, সেখানকার বাসিন্দাদের প্রাতঃকাল ভয়াবহ হয়ে থাকে।" একথা বলেই তিনি সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দূর্গ অবরোধ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা ইহুদীদের মজবুত প্রাচীর-অবরোধ ভাঙ্গতে পারেননি। ১৯ দিন পর অবশেষে তিনি ঘোষণা দিলেন, “আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ইসলামী পতাকা ও নেতৃত্বের দায়িত্ব দেবো - যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল [ﷺ] বিশেষভাবে ভালবাসেন। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমেই বিজয় দিবেন।" (খাসায়েসে নাসায়ী: ৬, সহীহ বুখারী ৫:৮৭/১৯৭-২৭৯/২৩১, সহীহ মুসলিম ৪:১৮৭১/৩২-৩৪, সুনানে তিরমিযী ৫:৬৩৮/৩৭২৪, মুসনাদে আহমাদ ১:১৮৫ ও ৫: ৩৮৫)
পরদিন সকালবেলা সকল সাহাবী নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে হাযির হলেন- নতুন নেতা বরণ করার জন্য সকলেরই আশা ছিল- নবী করীম [ﷺ] হয়তো তাঁর হাতে পতাকা দেবেন। কিন্তু নবী করীম [ﷺ] হযরত আলীকে খোঁজ করলেন। তখন হযরত আলী (رضي الله عنه) চোখের অসুখের কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। সকলে বললেন- তিনি চোখের অসুখে অসুস্থ। নবী করীম [ﷺ] তাঁকে ডেকে এনে তাঁর চোখে সামান্য থুথু মোবারক লেপন করে দিলেন। এবং আরোগ্যের জন্য দোয়া করলেন। সাথে সাথে হযরত আলীর চোখ ভাল হয়ে গেল। এরপর থেকে তাঁর ঐ চোখে আর কোন দিন অসুখ হয়নি। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, এরপর থেকে আমি ঐ চোখে অধিক পরিষ্কার দেখতাম।
[যুদ্ধ জয়ের ভবিষ্যৎবাণী ছিল নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েবের মোজেযা এবং চক্ষুরোগ আরোগ্যকরণ ছিল সর্বরোগহরা থুথু মোবারকের বরকত।]
হুযুর [ﷺ] হযরত আলীর হাতে পতাকা দিয়ে বললেনঃ “তুমি শেরে খোদা-আছাদুল্লাহ।" উল্লেখ্য- হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর কয়েকটি উপাধী স্বয়ং রাসুলুল্লাহ [ﷺ] কর্তৃক প্রদত্ত। যথাঃ (১) আছাদুল্লাহ বা শেরে খোদা (২) কাশিফুল কুরবাত বা মুশকিল কুশা (৩) মাওলা আলী (৪) আবু তুরাব। (আল-বেদায়া)
পতাকা হাতে নিয়ে হযরত আলি (رضي الله عنه) আরয করলেন- "ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা যুদ্ধ করেই ইহুদীদেরকে মুসলমান বানাবো।" নবী করীম [ﷺ] তাঁকে উপদেশ দিয়ে বললেন, “একটু ধীরে সুস্থে কাজ করো। প্রথমে তাদের দূর্গ অবরোধ করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেবে এবং আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করবে। আল্লাহর শপথ! যদি একটি লোককেও আল্লাহ তায়ালা হেদায়ত নসিব করেন, তাহলে তা হবে অজস্র মূল্যবান লাল উটের চেয়েও উত্তম।"
হযরত আলী (رضي الله عنه) সেদিন যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, তা ছিল ইতিহাসের বিস্মিত ঘটনা। তিনি একাই আল-কামুছ দূর্গের লোহার ভারী গেইটটি উৎপাটন করে দূরে নিক্ষেপ করে ফেলে দিলেন। এবং ভিতরে প্রবেশ করে আক্রমণ পরিচালনা করলেন এই আক্রমণে দূর্গ জয় হলো। ইহুদীদের ৯৩ জন এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং ১৫ জন মুসলমান সাহাবী (رضي الله عنهم) শাহাদাত বরণ করেন।
ইহুদী সর্দার আবুল হোকাইক ও তার পরিবারের নিকট হতে গাধার চামড়ার বাক্সে ও সিন্ধুকে রক্ষিত হীরা-মানিক্য ও ধন-সম্পদ উদ্ধার করা হয়। অসংখ্য গণিমতের মাল হস্তগত হয়। বিজিত অঞ্চল কতিপয় শর্তের মাধ্যমে করদ রাজ্য হিসাবে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়। শুধু ফিদাক নামক অঞ্চলটি হুজুর [ﷺ] নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন- পরিবার পরিজনের ভরণ-পোষণের উদ্দেশ্যে।
ঐ যুদ্ধে প্রাপ্ত হযরত হারুন (عليه السلام)-এঁর বংশধর ইহুদী কন্যা হযরত বিবি সফিয়া (رضي الله عنها)-কে আজাদ করে মুসলমান বানিয়ে নবী করীম [ﷺ] তাঁকে বিবাহ করেন। বিবি সফিয়া (رضي الله عنها)-এঁর স্বামী ঐ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।
পূর্ব স্বামীর সাথে বিবাহ হওয়ার পর এক রাত্রিতে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন- “আকাশের চাঁদ টুকরো হয়ে তাঁর কোলে পতিত হয়েছে।" এ স্বপ্ন স্বামীর কাছে খুলে বললে স্বামী তাঁর গালে একটি চপেটাঘাত করে বলেছিল- “চাঁদ-বদন তুল্য অন্য স্বামীর সংসার স্বপ্নে দেখেছো তুমি।" তাঁর সে স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হলো। সে চাঁদ হলেন শিশুকালে চাঁদের খেলার সাথী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]।
বিবি সফিয়া (رضي الله عنها)-এঁর সাথে হুজুরের বাসর রাতে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) তাঁবু পাহারা দিচ্ছিলেন এই আশংকায় যে- যদি বিবি সফিয়া (رضي الله عنها) কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন। ভোরে উঠে রাসুলে করীম [ﷺ] পাহারারত আবু আইয়ুব আনসারি (رضي الله عنه) কে দেখে হেসে বললেন- “তুমি আমার হেফাযতের নিয়তে রাতভর বিনিদ্র-রজনী কাটিয়েছো- আল্লাহ তোমার দেহকে এভাবে হেফাযত করুন।"
নবী করীম [ﷺ]-এঁর ভবিষ্যৎবাণী ও দোয়া অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। ৪৮ হিজরী সনে আমীর মোয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর খেলাফতকালে কুসতুনতুনিয়া (বর্তমান ইস্তাম্বুল) অভিযানে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) ইস্তাম্বুলে গিয়ে প্লেগ-রোগে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হন। ইস্তাম্বুল জয় করা তখন সম্ভব হয়নি। ইস্তাম্বুলের দূর্গ-প্রাচীরের নিকটে হযরত আবু আইয়ুব (رضي الله عنه)-কে দাফন করার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে হযরত আবু আইয়ুব (رضي الله عنه)-এঁর মাযারের উছিলায় সেখানে মুসলিম সমাজ গড়ে উঠে এবং উসমানী খলিফাগণ ইস্তাম্বুল জয় করতে সক্ষম হন।
মাযার সংরক্ষণঃ
মাযার ও স্মৃতি-নিদর্শনসমূহ রক্ষা করার মধ্যে ইসলামের অসংখ্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অলী-গাউছদের মাযারের উছিলায় সেখানে পরবর্তীতে মুসলিম সমাজ গড়ে উঠে। যেমন- আজমীর ও সিলেট। এটা ইসলামের বাস্তব প্রমাণ। কাজেই অলী-গাউছদের স্মৃতি-নিদর্শন ধ্বংস না করে তা সংরক্ষণ করাই কর্তব্য। মাযার সমূহ হচ্ছে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক বা শিয়ারে ইসলাম (তাফসীরে রুহুল বয়ান)।
দুঃখের বিষয়, মক্কা ও মদীনায় ওহাবী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯২৫-২৬ সালে সেখানকার সাহাবা ও অলীগণের হাজার হাজার মাযার ধ্বংস করে দেয়া হয়। বাদশাহ আবদুল আজিজের নির্দেশে একাজ করা হয়েছে। বিবি খদিজার (رضي الله عنها) ও বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها) সহ হাসান-হোসাইন বংশের ইমামগণের মাযার ধূলিস্যাত করে দেয়া হয়েছে। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার ১৯২৫-২৬ সালে মক্কা মদীনায় একটি ভারতীয় খেলাফত প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে ঐ ধ্বংসলীলার চিত্র সংগ্রহ করেন। আল্লামা আরশাদুল ক্বাদেরী (বিহার) তাঁর “তাবলীগী জামাআত" গ্রন্থে এসব ধ্বংসলীলার চিত্রসমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বাদশাহর কর্মকান্ডে তখন ভারতের মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে ৮ বছর পর্যন্ত মুসলমানগণ সুষ্ঠুভাবে হজ্জ্ব করতে পারেননি।
বর্তমানে সৌদী আরবে মসজিদে নববীতে সংরক্ষিত নবী করীম [ﷺ] ও তাঁর সাহাবাদ্বয়ের (رضي الله عنهما) রওযা মোবারক ব্যতীত অন্য কোন মাযারের চিহ্ন নেই। আমাদের দেশের ওহাবীপন্থী তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের অলী-আল্লাহগণের মাযারসমূহ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে রেখেছে - যদি কোন সময় তারা সুযোগ পায়। [তারা এর মধ্যেই কয়েকবার সিলেটে হযরত শাহজালাল (رحمة الله عليه) সহ কয়েকটি মাজারে বোমা হামলা করেছে এবং ধরা পড়ে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলেছে। তবে তাদের এ পরিকল্পনা তারা পরিত্যাগ করেনি।
ওহাবীপন্থী অর্ধশিক্ষিত ওয়ায়েজীনরা বলে বেড়ায়- সৌদি আরবে কোন পাকা মাযার নেই। কাজেই এটা হারাম। এসব জ্ঞানপাপীরা জেনে-শুনেই ইতিহাস বিকৃত করছে এবং মাযার ধ্বংসের আসল তথ্য জনগণকে জানাচ্ছে না। ইরাক-ইরান-মিশর-লিবিয়া-জর্দান-সিরিয়া সর্বত্রই অসংখ্য নবী-অলীর পাকা মাযার বিদ্যমান রয়েছে। ঐ সব দেশের মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে ইসলামী জযবায় উজ্জীবিত। ইরাকে শীশ পয়গম্বর (عليه السلام), হযরত ইউনুছ (عليه السلام), হযরত আইউব (عليه السلام)-এঁর মাযারসহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম, ওলী গাউছগণের মাযার এখনো অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। ইরাকের মাযার সমূহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন (رحمة الله عليه)।
খায়বরের ইহুদী নারীর বিষ প্রয়োগঃ
খায়বরের যুদ্ধের পর জয়নব বিনতে হারেছ নাম্নী জনৈকা ইহুদী মহিলা ছাগলের ভূনাগোস্তে বিষ মিশিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে হাদিয়া হিসাবে প্রেরণ করেছিল। নবী করীম [ﷺ] এবং কতিপয় সাহাবী উক্ত ভূনা গোস্তের কিছু অংশ খেয়ে ফেললেন। নবী করীম [ﷺ] হঠাৎ বলে উঠলেন, তোমরা সকলে হাত তুলে নাও এবং খানা বন্ধ করো। নবী করীম [ﷺ] উক্ত ইহুদী মহিলাকে ডেকে আনলেন এবং গোস্তে বিষ মিশানোর কথা জিজ্ঞাসা করলেন। মহিলা ঘটনা স্বীকার করলো এবং নবীজী কিভাবে বিষের ঘটনা জানলেন, তা জানতে চাইলো। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করলেন, “ছাগলের সামনের দুই বাহু আমাকে এই সংবাদ দিয়েছে।"
মহিলা বললো- "আমার উদ্দেশ্য ছিল, যদি আপনি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে বিষের ক্রিয়া আপনার মধ্যে নিশ্চয় হবে না। আর যদি নবী না হন, তাহলে বিষের ক্রিয়ায় আপনি নিহত হলে আমরা নিস্তার পাবো।"
উক্ত বিষে কতিপয় সাহাবী শহীদ হলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বুশর ইবনে বারা। কিন্তু নবী করীম [ﷺ]-কে বিষে ক্রিয়া করেনি। নবী করীম [ﷺ] নিজের বেলায় তাকে ক্ষমা করলেন। কিন্তু সাহাবীগণের হত্যার অপরাধে মহিলাকে তাদের আত্নীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করলেন। তারা উক্ত মহিলাকে খুনের অপরাধে হত্যা করলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর বেলায় বিষ তাৎক্ষণিক ক্রিয়া না করে ইনতিকালের সময় পুনরায় ক্রিয়া করতে থাকে। এতে নবী করীম [ﷺ] প্রত্যক্ষ শাহাদাতের মর্যাদাও লাভ করেন।
[আয়েশা (رضي الله عنها) বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ [ﷺ] যখন মৃত্যু রোগে আক্রান্ত তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আয়েশা! খায়বরে যে বিষমিশ্রিত খাদ্য আমি খেয়েছিলাম, সে বিষের প্রভাবে আমার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।‘ (বুখারি -৪৪২৮)]
খায়বর হতে মদীনার পথে সাহবা নামক স্থানে অন্তমিত সূর্য্যের পূনরোদয়ের ঘটনাঃ
কাযী আয়ায, ইমাম তাহাভী প্রমুখ মোহাদ্দেসগণ হযরত আসমা বিনতে ওমায়ছ (رضي الله عنها), হযরত আবু হোয়ায়রা (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণনা করেন-
“খায়বর থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে সাহবা নামক স্থানে নবী করীম [ﷺ] তাঁবু ফেলেন। সকলে মিলে আসরের নামায আদায় করেন। কিন্তু হযরত আলী (رضي الله عنه) তখনও আসর নামায আদায় করেন নি। এমন সময় নবী করীম [ﷺ]-এঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিলো। তিনি হযরত আলীকে ডেকে তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। ওহী নাযিল মাগরিব পর্যন্ত চলতে লাগলো। ইত্যবসরে সূর্য ডুবে গেল। এমন সময় জিব্রাইল (عليه السلام) বিদায় নিলেন। নবী করীম [ﷺ] হযরত আলীকে জিজ্ঞাসা করলেন- ’তুমি কি আসর পড়েছ?’ হযরত আলী বললেন, ’জ্বী-না’। নবীপ্রেমে হযরত আলী আসর নামায কাযা করে ফেললেন। নামায হলো আমল- আর নবী প্রেম হলো ঈমান। এমতাবস্থায় ঈমান রক্ষা করাই ফরয। নবী করীম [ﷺ] সঙ্গে সঙ্গে দোয়া করলেন, ’হে আল্লাহ! আলী তোমার এবং তোমার রাসূলের খেদমতে এতক্ষণ নিয়োজিত ছিল। তাই আসর কাযা হয়ে গেছে। হে আল্লাহ! তুমি সূর্যকে ফিরিয়ে দাও।’ হযরত আসমা বিনতে ওমায়ছ (رضي الله عنها) বলেন, আমি দেখতে পেলাম যে, অস্তমিত সূর্য পূনরায় পশ্চিম গগণে উদিত হলো এবং অনেকটুকু উপরে উঠে এলো। ইত্যবসরে হযরত আলী (رضي الله عنه) আছর পড়ে নিলেন। এরপর দেখলাম-সূর্য পুনরায় ডুবে গেল। আসমা (رضي الله عنها)-এঁর বর্ণনা নিম্নরূপঃ
فرأيتها غربت ثم طلعت بعد أن غربت -
অর্থাৎঃ “প্রথমে দেখলাম- সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। এরপর দেখলাম- অস্তের পর পুনরায় উদিত হয়েছে"
হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণনা নিম্নরূপঃ
نام رسول الله صلى الله عليه وسلم ورأسه فى حجر على ولم يكن صلى العصر حتى غربت الشمس فلما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم دعا له فرددت عليه الشمس حتى صلى ثم غربت ثانيا - (البداية والنهاية ٦)
অর্থঃ- “নবী করীম [ﷺ] হযরত আলীর কোলে মাথা মোবারক রেখে শয়ন করলেন। হযরত আলী তখনও আসর পড়তে পারেন নি। ইত্যবসরে সূর্য ডুবে গেল। অতঃপর নবী করীম [ﷺ] গাত্রোত্থান করলেন এবং আলীর জন্য দোয়া করলেন। সূর্য তাঁর জন্য ফিরে আসলো। ইত্যবসরে আলী (আছর) নামায আদায় করলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য পুনরায় ডুবে গেলো" (বেদায়া নেহায়া ৬ষ্ঠ খন্ড ৭৯ পৃষ্ঠা। একই দিনে দু’বার সূর্য্যোদয় ও দু’বার সূর্য্যাস্তের ঘটনা এটায় প্রথম। রাসুলে পাক [ﷺ]-এঁর মো’জেযার গুণ-ই আলাদা।
নবী করীম [ﷺ] হলেন একমাত্র মহামানব- যার খাতিরে ডুবন্ত সূর্য পুনঃ উদিত হয়েছে। কেয়ামতের পূর্বে আর একবার সূর্য পশ্চিম আকাশে পুনঃ উদিত হয়ে ডুবে যাবে বলে হাদীসে এসেছে। এরপর আর কারো তওবা কবুল হবেনা।
পৃথিবীর ১৩ লক্ষ গুণ বড় সূর্য্যের নিয়মিত গতি পালটিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আল্লাহর কত প্রিয় হলে তাঁর আবেদনে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সূর্যকে তিনি উল্টো ফিরিয়ে আনেন- এটা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সব নিয়মই রাসুলে পাক [ﷺ]-এঁর অধীন।
মক্কা শরীফে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়া, সাহবা নামক স্থানে সূর্যের পুনঃ উদয় হওয়া এবং গতি উল্টিয়ে যাওয়া কত বড় অলৌকিক শক্তি ও মো’জেযার প্রমাণ বহন করে- তা বিবেচনা করলে একজন ঈমানদার অলী-আল্লাহ হয়ে যেতে পারেন। উর্ধ্বজগতে নবীজী [ﷺ] এঁর কর্তৃত্বের এটাই প্রমাণ।
কিন্তু আশ্চার্যের বিষয়ঃ
ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়েম, ইবনে কাছির- প্রমূখ খারেজী আলেমগণ এই ঘটনাকে অস্বীকার করেছে। বর্তমানে ওহাবী-দেওবন্দী আলেমগণ ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করে চলে এবং এই বর্ণনাকে জইফ, মউযু ইত্যাদি বলে প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহ কখন তাদের হেদায়ত করবেন- তা তিনিই জানেন।
ইমাম তাহাভী ও কাযী আয়ায (رحمة الله عليهما)-এঁর ন্যায় বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দেসগণ এই হাদিসকে সহী ও নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। ওহাবীদের উদ্দেশ্য করে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله عليه) বলেন,
سورج الٹے پاؤں پلٹے چاند اشارے سے ھو چاق -
اندھے نجدی دیکہ لے قدرت رسول اللہ کی -
চন্দ্র হলো দ্বিখন্ডিত-সূর্য উলটোপথে,
অন্ধ নজদী! হয়নি একীন- নবীজীর কুদরতে? (অনুবাদঃ লেখক)