নামকরণ
পবিত্র কোরআন শরীফের ১১৪খানা সূরার মধ্যে সর্ব প্রথম সূরা হচ্ছে “আল ফাতিহা”। অর্থ হলো আরম্ভ বা শুরু। যেহেতু কোরআন শরীফ এ সূরা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে সেজন্য তাঁকে “ফাতিহাতুল কিতাব” বলা হয়। এ সূরার আরেকটি নাম “আলহামদু শরীফ”। সূরায়ে ফাতেহার আরেকটি নাম হচ্ছে “উম্মুল কোরআন” বা কোরআনের জননী (মা)। পুরো কোরআন শরীফের সারবস্তু সূরায়ে ফাতিহায় নিহীত বা পুরো কোরআন শরীফ হলো সূরায়ে ফাতিহার ব্যাখ্যা। তাই এ সূরাকে কোরআনের মা বলা হয়েছে। এ সূরার আরেকটি নাম হলো “সাবউ মছানী”। অর্থাৎ এ সূরাটিতে রয়েছে অনুপম সাতটি বাণী বা আয়াত। মাছানি বলা হয় এ কারণে যে, সূরাটি একবার মক্কায় ও একবার মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকতর বিশুদ্ধমতে, মক্কা শরীফেই এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়।
আল্লামা ইবনে জরীর (রাঃ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, হযরত রাসূলে কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সূরা ফাতিহা অর্থাৎ আলহামদু শরীফ হচ্ছে, উম্মুল কোরান, ফাতিহাতুল কিতাব, সাবউমাছানি। এ সূরার আরেকটি নাম হচ্ছে “সূরায়ে কাঞ্জ” (ভান্ডার)। হযরত আলী (রাঃ) হতে ইসহাক ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, এ সূরাটি আরশের নিম্নস্থিত ভান্ডার থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।

ফজীলত
সূরা ফাতিহাকে হাদীছ শরীফে “সূরায়ে শিফা” বলা হয়েছে। সূরা ফাতিহা হলো সকল রুগের প্রতিষেধক (কুরতুবী)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমার জীবনাধিপতি ওঁই সত্ত্বার শপথ, সূরা ফাতিহার মতো কোন সূরা তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল অথবা কোন আসমানি কিতাবে নেই। এটা সেই অনুপম ও অনন্য বাণী সপ্তক যা আল্লাহ পাক আমাকেই দান করেছেন। হযরত জাবের (রাঃ) থেকেবর্ণিত , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হে জাবের! আমি কি বলবো কোরআনের সর্বোত্তম সূরা কোনটি ? হযরত জাবের বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরশাদ করুন,হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ”সূরা ফাতিহা”। ইমাম বুখারী (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বলেছেন, সূরা ফাতিহা কোরআনের দুই তৃতিয়াংশ।
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াত আমল করবে তাঁর জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ থাকবে। শয়তান চারবার চীৎকার করে কেঁদেছিলো। ১) আদম (আঃ) কে সিজদা না দেয়ায় আল্লাহ তাকে লা’নত দেন তখন ২) জান্নাত থেকে আজাজীলকে বের করে দেয়ার সময় ৩) ঈদ-ই মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিন ও ৪) সূরা ফাতিহা নাযীলের দিন। (বেদায়া ওয়ান নেহায়া)

মাহাত্ত্ব
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হয়, পাঠ করা ওয়াজিব। আল্লাহ পাক ছালাত বা নামাজ ফরজ করেছেন, কোরআন শরীফে ৮২বার নামাজের কথা বলেছেন, কিন্তু একবারও সূরা ফাতিহা পড়ার কথা বলেন নি, বরং বলেছেন, “ফা আকরাউ মা তাইয়াস সারা মিনাল কোরআন” নামাজে কোরআনের যে কোন যায়গা হতে পাঠ কর। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا صلوة الا بفتحة الكتاب “লা ছালাতা ইল্লা বে ফাতিহাতিল কিতাব” অর্থাৎ সূরা ফাতিহা পাঠ না করা ব্যতীত নামাজ নাই। নামাজ হলো আল্লাহ্’র ইবাদত আর নামাজের নিয়ম কানুন শিখায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবীজি বলেন, “ছাল্লু কামা রায়াইতুমুনি উছাল্লি” অর্থাৎ তুমরা ছালাত আদায় করো যেমনি ভাবে আমাকে আদায় করতে দেখো। কয় ওয়াক্ত নামাজে কয় রাকাত নামাজ, প্রতি রাকাতে কয় রুকু, কয় সিজদা তা আল্লাহ পাক কোরআনে বলেননি, বলেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আসসালাতু মিফতাহুল জান্নাহ” অর্থাৎ জান্নাতের চাবি হলো নামাজ। আর আল্লাহ পাক নামাজের চাবি দান করেছেন নবীজির হাতে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাকাত নামাজে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। প্রমাণিত হলো ইসলামের শরীয়তের বিধানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ-বিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। সুবাহানআল্লাহ!
(তাফসীরে জালালাইন, মাযহারী, নঈমী, বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইত্যাদি)।
মাসআলাঃ-
প্রতি ওয়াক্ত প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব। ইমাম ও একাকী নামাজ আদায় কারীর জন্য নিজ মূখে উচ্চারণ করে এবং মুক্তাদীর জন্য হুকুমী (পরোক্ষ ভাবে) বা ইমামের সাথে মনে মনে শ্রবণ বা পাঠ করা। সহহী হাদীছ শরীফে আছে- قرأة امام له قرأة (ক্বিরআতুল ইমামে লাহু ক্বিরআতুন) অর্থাৎ ইমামের পাঠ করাই মুক্তাদীর পাঠ করা। কোরআন শরীফে মুক্তাদীকে নীরব থাকার এবং ইমামের ক্বিরাত শ্রবণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
ازا قرىء القران فاستمعوا له وانصتوا (ইজা ক্বুরেয়াল কোরআনু ফাসতামে’উ লাহু ওয়ান চিতু) অর্থাৎ যখন কোরআন শরীফ তালাওয়াত করা হয় তখন তোমরা তা মনযোগ সহকারে শ্রবন করো এবং নিশ্চুপ থাকো। মুসলীম শরীফের হাদীছে আছে- ازا قرأ فانصتوا (ইজা ক্বারাআ ফানচিতু) অর্থাৎ ইমাম যখন ক্বিরাত পাঠ করেন তখন তোমরা চুপ থাকো। এটাই হানাফী মাযহাবের অভিমত।
জানাজার নামাজে দো’আ স্মরণ না থাকলে ‘সূরা ফাতিহা’ দো’আর নিয়তে পাঠ করা জায়েয; কিন্তু ক্বিরাতের নিয়তে জায়েয নয়। (কানযুল ঈমান,আলমগীরী ইত্যাদি)
সূরা ফাতিহা ‘কোরআনের মা’ প্রতি রাকাত নামাজে পাঠ করা ওয়াজিব করা হয়েছে, এই সাত আয়াতের সূরা ফাতিহা’র মধ্যে কি রয়েছে? সূরা ফাতিহা নামাজে আমরা পড়ি ঠিক কিন্তু এর হাকীকত অর্থ আমরা বুঝিনা, বুঝতে চাইনা বা একদল ভূল বুঝাচ্ছেন। বিভিন্ন তাফসীরের আলোকে সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াতের এক একটি আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইনশা’আল্লাহ। যদিও হযরত আলী (রাঃ) বলেন, সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াতের ব্যাখ্যা যদি করি ৭০টি উঠ লাগবে তা বহন করতে। সূবাহান আল্লাহ!

জ্ঞাতব্য
এ সূরাটি মক্কা ও মদীনা দুই পূণ্যময় স্থানে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশের মতে মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা ফাতিহায় ৭টি আয়াত, ২৭টি পদ ও ১৪০টি বর্ণ রয়েছে। কোন আয়াত ‘নাসেখ’ (রহিতকারী) ওমানসূখ ( রহিতকৃত) নয়।

ইসতি’আযাহ বা তাআব্বুজঃ- اعوز بالله من الشيطان الرجيم (আ’উজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম) অর্থঃ আল্লাহ’র নিকট পানাহ চাই বিতাড়িত শয়তান হতে।
মাসআলাঃ- কোরআন তেলওয়াতের পূর্বে ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’
পাঠ করা সূন্নত। (তাফসীরে খাযেন)
২য়তঃ কোরআন শরীফ পাঠের পূর্বে ‘আউজুবিল্লাহ’ পাঠ করা ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুন্নাত বলে স্বীকৃত হয়েছে।

মাসআলা
নামজের মধ্যে ইমাম কিংবা একাকী নামাজ আদায় কারীর জন্য ‘সানা’ (সূবহানাকা—-) পাঠ করার পর নীরবে ‘আউজুবিল্লাহ’ পাঠ করা সুন্নাত। (শামী)
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- فازا قرأت القران فاسعز بالله من الشيطان الرجيم
(ফাইজা ক্বারাআতাল কোরআনা ফাসতাইজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম) অর্থাৎ যখন কোরআন পাঠ শুরু করো তখন আল্লাহ’র নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে পানাহ চাও। অতএব প্রমাণীত হলো কোরআন তেলওয়াতের সময় ‘আউজুবিল্লাহ পাঠ করা আল্লাহ’র হুকুম। কোরআন পাঠ ব্যতীত অন্যান্য কাজে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা সুন্নাত, ‘আ’উজুবিল্লাহ’ নয়। কোরআন তেলওয়াত কালে উভয়টি পাঠ করা সুন্নাত। (আলমগীরি)
তাসমীয়াহঃ- بسم الله الرحمن الرحيم (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম) পাঠ করা।
অর্থঃ- আল্লাহ’র নামে শুরু যিনি পরম দয়ালু করুণাময়।

জ্ঞাতব্য
প্রকাশ থাকে যে, بسم الله الرحمن الرحيم কোরআনের আয়াতের আংশ। সূরায়ে নমলের একটি আয়াত বা অংশ। সূরা ‘তাওবা’ ব্যতীত প্রত্যেক সূরার প্রারম্ভেبسم الله الرحمن الرحيم লিখা বা পাঠ করা হয়। তাসমীয়াহ সূরা ফাতিহার অংশ, না অন্যান্য সকল সূরারই অংশ এতে ইমাম, মোজতাহিদ ও তাফসীরবিদগণের মতানৈক্য রয়েছে। ইমামে আ’জম আবু হানীফা (রাঃ) বলেছেন, بسم الله الرحمن الرحيم সূরা নমল ব্যতীত অন্য কোন সূরার অংশ নয়। তবে এটি এমন একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আয়াত যা প্রতিটি সূরার প্রথমে লিখা এবং দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম হাকেম, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রাঃ) এর নীতিমালা অনুস্মরণে বিশুদ্ধ হাদীছ রুপে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম প্রথম দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ণে অসুবিধার সম্মূখীন হতেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ’ অবতীর্ণ হয়। (মাযহারী)

মাসাআলা
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” কোরআন শরীফেরই আয়াত, তবে সুরা ফাতিহার অংশ নয়। এ জন্য তেলয়াতের সময় উচ্চরবে তা পাঠ করা হয়না। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীছে বর্ণিত আছে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক ও হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা ‘আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন’ থেকেই নামাজে ক্বিরাত পড়া শুরু করতেন। অর্থাৎ সূরা ফাতিহার সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উচ্চ রবে পাঠ করতেন না (মনে মনে পড়তেন)।
কোরআন তেলওয়াত ও প্রত্যেক নেক কাজ বিসমিল্লাহ’র সাথে আরম্ভ করার আদেশঃ-
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে লোকদের প্রথা ছিল, তারা তাদের প্রত্যেক কাজ দেব-দেবীদের নামে শুরু করতো। এ প্রথা রহিত করার জন্য হযরত জিব্রাঈল (আঃ) পবিত্র কোরআনের সর্ব প্রথম যে আয়াত নিয়ে এসেছিলেন , তাতে আল্লাহ’র নামে আরম্ভ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ’র প্রেরিত প্রথম ওহী- اقرأ باسم ربك (ইকরা বিসমে রাব্বিকা) অর্থাৎ পাঠ করুন আপনার প্রভূ’র নামে।
কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রথমে কোন কাজ আরম্ভ করতে বলতেন- باسمك اللهم (বিসমিকা আল্লাহুম্মা) এবং কোন কিছু লিখতে হলেও একথা লিখতেন। কিন্তু بسم الله الرحمن الرحيم অবতীর্ণ হওয়ার পর সর্বকালের জন্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে সকল নেক কাজ আরম্ভ করার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। (কুরতুবী, রুহুল মা’আনী)

মাসআলা
১) কোরআন শরীফের ‘সূরা তাওবা’ ব্যতীত প্রত্যেক সূরা ‘বিসমিল্লাহ’ এর সাথে আরম্ভ করতে হয়। ২) ‘খতম তারাবীহ’র নামাজে’ একবার উচ্চ রবে ‘বিসমিল্লাহ’ অবশ্যই পড়তে হবে। যাতে একটা আয়াত বাদ না পরে। ৩) প্রত্যেক ‘মুবাহ’ বা বৈধ কাজ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আরম্ভ করা মুস্তাহাব। ‘নাজায়েয’ বা অবৈধ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া নিষেধ। ৪) কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ রয়েছে, প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহ বলে আরম্ভ করা। ৫) হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়য়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে কাজ বিসমিল্লাহ ব্যতীত আরম্ভ করা হয়, তাতে কোন বরকত থাকেনা। ৬) অন্য হাদীছে এরশাদ হয়েছে, ঘরের দরজা বন্ধ করতে, বাতি নেভাতে ও পাত্র আবৃত করতে বিসমিল্লাহ বলবে। কোন কিছু খেতে, পান করতে, অজু করতে, সওয়ারীতে আরোহণ করতে এবং তা থেকে অবতরণ কালেও বিসমিল্লাহ বলার নির্দেশ কোরআন-হাদীছে বার বার এসেছে। (কুরতুবী)

বিসমিল্লাহ’র তাফসীর
‘বিসমিল্লাহ’ অর্থ আমি আল্লাহ’র নামে আরম্ভ করছি। ‘বিসমি’ শব্ধটি গঠিত হয়েছে ‘বা’ এবং ‘ইসিম’ শব্দ দু’টি দিয়ে। অতি ব্যবহারের ফলে ইসিমের ‘আলিফ’ অক্ষরটি লুপ্ত হয়েছে। ‘ইসিম’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে ‘সামু’ থেকে। ‘বা’ অক্ষরটি সঙ্গী ও সাহায্য কামনা অথবা বরকত অর্জনের জন্য ব্যবহ্রত হয়েছে। আল্লাহ পাকের জিকির দ্বারা সাহায্য কামনা করা হয়ে থাকে। ‘বা’ অব্যয়টি ‘আররাহীম’ শব্দের পরে লুপ্ত একটি ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ ‘আকরাউ’ বা আমি পড়ি। যেমন ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা’ বাক্যটিতে দেখা যায়। বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে-প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ’ উল্লেখ থাকাই বাঞ্ছনীয়। আব্দুল কাদীর (রঃ) তাঁর ‘হাবী আরবাইন’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- যে কাজ বিসমিল্লাহ’র সাথে শুরু না হয় সে কাজ অসমাপ্ত থাকে। অর্থাৎ সহজ কথায় এ রকম বলা কর্তব্য যে, আল্লাহ’র নামে আমি পাঠ আরম্ভ করলাম।
আল্লাহঃ- একক ও অবিনশ্বর মহান সৃষ্টিকর্তার জাতি নাম ‘আল্লাহ’। কেহ কেহ আল্লাহ নামটি ‘ইসমে আজম’ বলেছেন। কারো কারো অভিমত হচ্ছে ‘আল্লাহ’ শব্ধটি একটি মৌল শব্দ। কিন্তু প্রকৃত কথা হচ্ছে ‘আল্লাহ’ শব্ধটির উৎপত্তি ঘটেছে ‘ইলাহ’ (উপাস্য) শব্ধটি থেকে। ইলাহ শব্দের ‘হামজা’র স্থলে ‘আলিফ’ ও ‘লাম’ যুক্ত করা হয়েছে। আর এমন সংযুক্ত করা হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে, যার দারুন ‘আল্লাহ’ শব্দটি সিদ্ধ। পরিশেষে বলা যায় ‘আল্লাহ’ শব্দটি ঐ চিরস্থায়ী সত্তার মহিমান্বিত নাম, যা সকল প্রকার অপরিচ্ছন্নতা ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্র। এজন্যই নামটি স্বমহিমায় ভাস্বর। তাই একত্ব প্রকাশের পবিত্র বাক্যটি হচ্ছে- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।
আর রাহমানির রাহীমঃ- ‘রহমান’ ও ‘রাহীম’ শব্দ দু’টির অর্থ- দাতা ও দয়ালু। দু’টি শব্ধই উৎপন্ন হয়েছে ‘রহমত’ শব্দটি থেকে। রহমত অর্থ আন্তরিক নম্রতা। যার পরিণতি হচ্ছে কল্যাণ ও অনুগ্রহ।
কোন কোন তাফসীর কারকের মতে- ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ শব্দ দু’টি সম অর্থ জ্ঞাপক। বিশেষণের আধিক্য বুঝাতে শব্দ দু’টি একত্রে ব্যবহ্রত হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো- ‘রহীম’ শব্দটির তুলনায় ‘রহমান’ শব্দটি ব্যপক আর্থ বোধক। সহজ ভাবে বলতে গেলে এ দুনিয়াতে আল্লাহ ‘রহমান’ অর্থাৎ তাঁর দয়া-দান ব্যপক- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রসারিত। কিন্তু আখেরাতে তিনি ‘রহীম’ অর্থাৎ পরকালে তাঁর দয়া-দান শুধু পূণ্যবানদের জন্য।
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাক্যটিতে ১৯টি আক্ষর রয়েছে। প্রতি অক্ষরে ১০টি নেকী তাই একবার ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ পাঠ করলে একশত নব্বই নেকী আমল নামায় যোগ হবে।
(তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে রুহুল মা’আনী, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে নঈমি, খাজাইনুল ইরফান, বুখারী, মুসলিম, কুরতুবী ইত্যাদি)
তাফসীরঃ- – الحمد لله رب ٍالعلمين
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।
অর্থঃ- সকল প্রশংসা আল্লাহ’র প্রতি, যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক।
ব্যাখ্যাঃ- “ আলহামদুলিল্লাহ”এখানে তিনটি শব্দ, ‘আল’ ‘হামদু’ লিল্লাহ’।আল- আলীফ+ লাম, আলীফ-লাম এখানে দুই অর্থে ব্যবহ্রত হতে পারে, ১) আলীফ লামে ‘এস্তেগরাকী ২) আলীফ লমে ‘অহুদী। (তাফসীরে রুহুল বয়ান) হামদ এর পূর্বে ‘আলীফ-লামেএস্তেগরাকী’ হলে অর্থ হবে, সব সময়-সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রসংসা বা গুণকীর্তন আল্লাহ’র জন্য। পার্থিব সৌন্দয্যের মৌখিক প্রকাশের নাম ‘হামদ’। সে সৌন্দয্যের সাথে নে’য়ামত বা অনুগ্রহ রাজী সম্পৃক্ত থাকুক বা না থাকুক। ‘হামদ’ শব্দটি ‘মাদাহ’ শব্দটির সঙ্গে সাধারণভাবে তুলনা মূলক সম্পরক ধারী। পার্থিব কিংবা অপার্থিব সৌন্দরয্য প্রশংসিত হলে, ঐ প্রশংসাকে ‘মাদহা’ বলে। ‘হামদ’ এর সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে সুনির্দিষ্ট শব্দটি গঠিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে- এই সুনির্দিষ্ট অবস্থাটি কি? একটিতো জাতি বাচক বিশেষণ যা সর্ব জন বিদিত। আর অপরটি হচ্ছে সামষ্টিক প্রকাশ। সমষ্টি গত ভাবে সকল প্রশংসাইতো আল্লাহ পাকের জন্যে। তিনি তাঁর বন্দাগণের কারয্য সমূহের স্রষ্ঠা। আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা যা কিছু নে’য়ামত পেয়েছো, সে সমস্ত আল্লাহ’র দিক থেকেই এসেছে’। এতে এরকম ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ পাক জীবিত, ক্ষমতাশালী, অভিপ্রায়কারী ও শক্তির মালিক। এ কারণে তিনি সকল প্রশংসার অধিকারী।
এরপরের শব্দটি হলো- ‘লিল্লাহ’। ‘লিল্লাহ’ শব্দের অর্থ শুধু আল্লাহ’র জন্য। ‘লি’ আল্লাহ শব্দটি কে সুনির্দিষ্ট করেছে। আরবী ভাষারীতি অনুযায়ী ‘আলহামদুলিল্লাহ’ একটি পূর্ণ বাক্য- যার অর্থ হলো, সমস্ত প্রশংসা কেবলই আল্লাহ’র। এ বাক্যটির মাধ্যমে বান্দাদেরকে প্রশস্তি প্রকাশের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আর বাক্যের উহ্য অংশটিসহ পূর্ণ বাক্যটি হবে এ রকম- ‘কুল আলহামদুলিল্লাহ’ অর্থাৎ হে মানব মন্ডলী! বলো, সকল প্রশংসা শুধু আল্লাহ’র জন্যে। (তাফসীরে মাযহারী)
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ পাক কোরআন শরীফের শুরুতে নিজের প্রশংশা দিয়ে শুরু করেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আল্লাহ এমনই এক পবিত্র স্বত্তা যার কোন আ’য়িব নেই বা অপ্রশংসা নেই। যাবতীয় দুষ-ত্রুটি থেকে তিনি মুক্ত। অতএব দেওবন্দী-কওমীদের কথা, ‘আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন, তবে বলেন না’ (নাউজুবিল্লাহ) একটি কুফুরী মতবাদ। একথাটি আল্লাহ পাকের শানের খেলাফ। নাস্তিক- মুরতাদরাই একথা বলতে পারে।

মাসাআলা
প্রতিটি কাজে ‘বিসমিল্লাহ’র’ মতো ‘হামদ’ বা আল্লাহ’র প্রশংসার মাধ্যমে আরম্ভ করা।
‘হামদ’ কখনো ওয়াজিব; যেমন জুম’আর খোতবায়। কখনো মুস্তাহাব; যেমন বিবাহের খোতবায়, দোয়ায়, প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রারম্ভে এবং প্রত্যেক পানাহারের পর। কখনো সূন্নাতে মুয়াক্কাদাহ; যেমন হাঁচি আসার পর।(তাহতাবী শরিফ)

জ্ঞাতব্য
‘আলহামদুলিল্লাহ’ কোরআনের শুরুতে বলারকারণএওহতেপারেযে, হযরতআদম (আঃ) প্রথমসৃষ্টিহওয়ারপরহাঁচিআসে, তখনতিনিবলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এ কারণে আল্লাহ পাক কোরআনের শুরুতে এবাক্যটি এনেছেন। কারণ এটি আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম জিকির বা কথা বা আল্লাহ’র প্রশংসা। আর একারণে আমাদের উপরও এ হুকুম হাঁচি আসলে ‘ আলহামদুলিল্লাহ’ বলা, আর শ্রবনকারী উত্তরে বলবে ‘ইয়ারহামু কুমুল্লাহ’। তাছাড়া ‘ আলহামদুলিল্লাহ’ এর মধ্যে ৮টি অক্ষর এবং জান্নাত ও ৮টি। বিশুদ্ধ অন্তরে যে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়বে জান্নাতের ৮টি দরজা তার জন্য খোলা থাকবে। এটাও বুঝানো হয়েছে পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠকারী শুরুতেই জান্নাতের খোশ খবরী নিয়ে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত আরম্ভ করবে।
(তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে নঈমী, খাজাইনুল ইরফান, তাহতাবী শরিফ ইত্যাদি)
رب العلمن “রাব্বিল আ’লামীন”ঃ- “আলহামদুলিল্লাহ” এর পরেই আল্লাহ পাকের গুন বাচক নাম ‘রাব্বুল আ’লামীন’ উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় ‘রাব্বুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘মালিক, সর্দার ও পালন কর্তা’। এ তিনটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য।
লালন-পালন বলতে বুঝায়, কোন জীবকে তার সমস্ত মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধীরে ধীরে বা পর্যায় ক্রমে সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়।
‘রব’ শব্দের আরেকটি অর্থ ‘স্বত্বাধিকারী’। যেমন বলা হয়, রব্বিদ দার’-গৃহের স্বত্বাধিকারী। ‘রব’ শব্দটি ‘তরবিয়ত’ অর্থেও ব্যবহ্রত হতে পারে। কোন কিছুকে ক্রম-পরিণতির দিকে পৌছানোর নাম ‘তরবিয়ত’। ‘রব’ শব্দটি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে না। আর বিশ্ব জগত সমূহের উন্মেষ, স্থিতি ও স্থায়িত্ব রবের মূকাপেক্ষী। প্রাকাশ থাকে যে, কোরাআনের শুরুতে আল্লাহ’র গুণ বাচক নামের মধ্যে ‘রব’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। কারণ আখিরাতের প্রথম মঞ্জিল ‘কবরে’ প্রথম প্রশ্ন করা হবে, ‘মার রাব্বুকা’ বা তুমার রব বা প্রভূকে? উত্তরে বলতে হবে ‘ রাব্বি আল্লাহ’ বা আমার প্রভূ বা প্রতিপালক আল্লাহ। এ শিক্ষাটুকু কোরআনের শুরুতে আল্লহপাক দিচ্ছেন।
আ’লামীনঃ- আরবী ‘আলম’ শব্দের বহু বচন ‘আলামীন’। যার অর্থ সমস্ত মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগত। আল্লাহ পাক নিজের শানে বলেছেন ‘রাব্বিল আ’লামীন’ বা সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রভূ, আর ছাহেবে কোরআন আল্লাহ’র হাবীবের (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে বলেছেন, ‘রাহমাতাল্লীল আ’লামীন’ অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টি জগতের ‘রহমত’। আল্লাহ- রব আর নবী-রাহমত। জগতের রয়েছে বহু স্তর বিন্যাস। তাই এখানে ‘আলামীন’ বহু বচনের ব্যবহারই সঙ্গত হয়েছে। তন্মধ্যে পৃথিবী ১টি আলম। বিশ্ব সমূহের তুলনায় পৃথিবী যেন সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে একটি তস্তুরী বা প্লেইট। হযরত কা’ব আহরার (রাঃ) বলেছেন, আলম সমূহের সংখ্যা এবং আল্লাহ পাকের সৈন্য সংখ্যা আল্লাহ পাক ছাড়া অন্য কারো জানা নাই। কেহ কেহ বলেছেন, জ্ঞান সম্পন্ন সৃষ্টি কুলের নাম ‘আলম’। যেমন মানুষ, ফেরেশতা ও জ্বীন। অন্যান্য সৃষ্টি এদের অধীন।

– الرحمن الرحيم
(আর রাহমানির রাহিম)
(তিনি) পরম দাতা ও দয়ালু

‘রাব্বুল আ’লামীনের’ কারণ স্বরূপ ‘আর রাহমানির রাহীম’ উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কেন তিনি বিশ্ব সমূহের প্রভূ? উত্তর হলো- এ কারণে যে, তিনি রহমান ও রহীম। রাহমান ও রাহীম শব্দ দু’টি সমার্থবোধক হলেও গুনগত দিক থেকে পার্থক্য বিদ্যমান, যেমন এ দুনিয়াতে আল্লাহ পাক ‘রহমান’, এর ব্যপকতা রয়েছে। অর্থাৎ পাপি-তাপী, ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সবার প্রাতি তিনি দয়ালু, তাই তিনি এ দুনিয়ার জন্য ‘রাহমান’। কিন্তু পরকালে তিনি ‘রহীম’, অর্থাৎ শুধু নেককারদের দয়া করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, মহান রাব্বুল আ’লামীনের জাতী নাম দু’টি ‘ আল্লাহ’ ও ‘রহমান’। যেমন সূরায়ে বণী-ইসরাঈলের ১১০নং আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ”কুল উদওল্লাহা আওয়িদউর রহমান” অর্থাৎ (হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি বলুন! তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাকো অথবা ‘রাহমান’ নামে ডাকো।
তাছারা এও হতে পারে যে, ‘হামদ’ বা প্রশংসা এর সাথে রহমত জড়িত। যে আল্লাহ’র প্রশংসা করবে সে অবশ্যই আল্লাহ’র রহমত লাভ করবে। হযরতআদম (আঃ) পয়দা হওয়ার পর পরই হাঁচি দিয়ে বলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ সাথে সাথে ফিরিশতারা জবাবে বলেন ‘ইয়ার হামু কাল্লাহ’।
ملك يوم الدين
মালিকি ইয়াউ মিদ্দিন
বিচার বা প্রতিফল দিবসের মালিক
মালিকঃ- এ শব্দটি দু’ রকম ক্বিরাতে পড়া যায়। মালিক ও মা-লিক। ‘মালিক’ ও ‘মা-লিক’ এর অর্থ একই। যেমন, ‘ফারিহীন’ ও ‘ফা-রিহীন’, ‘হাজিরীন’ ও ‘হা-জিরীন’। প্রকৃত কথা হচ্ছে, সত্ত্বাধিকারী হিসেবে ব্যবহ্রত ‘মা-লিক’ শব্দটি ‘মালিক’ শব্দ থেকে গঠিত হয়েছে। আরবী ভাষায় প্রবাদ রয়েছে ‘মা-লিকুদ্দার’ অর্থ ‘রাব্বুদ্দার’ অর্থাৎ ঘরের সত্ত্বাধিকারী। ‘মালিক’ শব্দের অর্থ রাজা বা সম্রাট- যা গঠিত হয়েছে ‘মূলুক’ শব্দটি থেকে। ‘মালিক’ ও ‘মা-লিক’ এ দু’ রকম উচ্চারণই আল্লাহ পাকের বিশেষণ রূপে সুবিদিত। কেউ বলেছেন, মালিক অথবা মা-লিক তিনিই, যিনি অনস্তিত্বকে অস্তিত্ব দান করতে সক্ষম। তাই এ শব্দ দু’টিকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা বৈধ নয়।
ইয়াউ মিদ্দিনঃ- অর্থ প্রতিফল দিবস। ঐ দিবসকে প্রতিফল দিবস বলে, যে দিন পুরুস্কার ও তিরস্কার কার্যকর হবে। ‘কামাতুদিনু তুদান’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘দ্বীন’ শব্দ হতে। এর অর্থ হচ্ছে, যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থই সলাম ও আনুগত্যও হতে পারে। কেননা ঐ সময় ইসলাম ও আনুগত্য ব্যতীত অন্য কিছুই ফলদায়ক হবে না।
প্রতিফল দিবসের স্বরূপ ও তার প্রয়োজনীয়তাঃ-
প্রথমতঃ প্রতিদান দিবস কাকে বলে এবং এর স্বরূপ কি? দ্বিতীয়তঃ সমগ্র সৃষ্টির উপর প্রতিদান দিবসে যেমনি ভাবে আল্লাহ তা’য়ালার একক অধিকার থাকবে, অনুরূপ ভাবে আজও সকল কিছুর উপর তাঁরইতো একক অধিকার রয়েছে; সুতরাং প্রতিফল দিবসের বৈশিষ্ট্য কোথায়?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, প্রতিদান-দিবস ঐদিনকেই বলা হয়, যে দিন আল্লাহ তা’আলা ভাল-মন্দ সকল কাজ-কর্মের প্রতিদান দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রোজে- জাযা শব্দ দ্বারা বোঝানু হয়েছে যে, এ দুনিয়া ভাল-মন্দ কাজ-কর্মের প্রকৃত ফলাফল পাওয়ার স্থান নয়; বরং এটি হলো কর্মস্থল; কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জায়গা। যথার্থ প্রতিদান ও পুরুস্কার গ্রহণের স্থান এটি নয়। এতে একথাও বুঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে কারও অর্থ- সম্পদের আধিক্য ও সূখ-শান্তির ব্যপকতা দেখে বলা যাবেনা যে, এ ব্যক্তি আল্লাহ’র দরবারে মাকবুল।
এ জন্যই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এ দুনিয়ার জীবনে সর্বাপেক্ষা বেশী বিপদাপদে পতিত হয়েছেন এবং তারপর আউলিয়াগণ অধিক বিপদে পতিত হন। কিন্তু দেখা গেছে বিপদের তীব্রতা যতই কঠিন হউক না কেন, দৃঢ় পদে তাঁরা তা সহ্য করেছেন। এমনকি আনন্দ চিত্তে তাঁরা তা মাথা পেতে নিয়েছেন। মোটকথা, দুনিয়ার আরাম আয়াশকে সত্যবাদিতা ও সঠিকতা এবং বিপদাপদকে খারাপ কাজের নিদর্শন বলা যায় না।
অবশ্য কখনো কোন কোন কর্মের সামান্য ফলা ফল দুনিয়াতে ও প্রকাশ করা হয় বটে, তবে তা সে কাজের পূর্ণ বদলা হতে পারে না। এগুলো সাময়িক ভাবে সতর্ক করার জন্য একটু নিদর্শন মাত্র।

اياك نعبد و اياك نستعين
ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন
(হে করুণা নিধান দয়াময়)
আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি
রাব্বিল আ’লামীন, আর রাহমানির রাহীম, মালিকি ইয়াউ মিদ্দিন এ সকল বর্ণনার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, আল্লাহ পাক সমস্ত স্তব-স্তুতির অধিকারী। তাই তিনি ব্যতীত উপাসনা লাভের যোগ্য কে?
ইয়্যাকা না’বুদু (আমরা তোমারই ইবাদত করি)- এ বাক্যটির ভূমিকা স্বরূপ প্রথমেই আল্লাহ তা’আলার গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে আল্লাহ তা’আলার একত্ব, পরাক্রম এবং দয়া দাক্ষিণ্যকে। এভাবেই প্রমাণিত হয়েছে সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার পার্থক্য। অর্থাৎ সৃষ্টি মাত্রই স্রষ্টার উপাসনা-বন্দেগী করবে। বান্দা এবার উচ্চারণ করুক ‘ ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন’ অর্থাৎ (হে দয়াময়) আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
আরবী ভাষায় বাক ভঙ্গির বিভিন্ন রূপান্তর রীতি সিদ্ধ। ‘প্রথম’ থেকে ‘মধ্যম’ পুরুষ এর কম বাক ভঙ্গি আরবী ভাষায় সুপ্রচল। এ রকম রূপান্তরশীল বাক ভঙ্গির উদ্দ্যশ্য হচ্ছে, শ্রোতার অন্তরে উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করা। ইবাদত বা উপাসনা হচ্ছে চরম অসহায়ত্ব ও চুড়ান্ত পর্যায়ে বিনয়-নম্রতার নাম।
‘ন’বুদু’ ও ‘নাসতাঈন’ শব্দ দু’টিতে উত্তম পুরুষের বহুবচন ‘আমরা’ ব্যবহ্রত হয়েছে। এতে করে পাঠকের সঙ্গে তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ সম অংশীদার হন। এ বর্ণনা ভঙ্গিটি হচ্ছে দলবদ্ধ উপাসনার প্রতি ইঙ্গিত।আরবী ব্যকরণ অনুযায়ী ‘ইয়্যাকা’ শব্দটি ক্রিয়া ও কতৃপদের পরে আসার কথা। কিন্তু এখানে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ পাকের মহিমা, উপাস্য হওয়া এবং সাহায্য দাতা হওয়ার বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট করা।
মাসা’আলাঃ- ‘না’বুদু’ বহু বচন ক্রিয়া পদ ইবাদতকে জামা’আত সহকারে বা দল বদ্ধ ভাবে আদায় করার বৈধতাও প্রমাণিত হয়। একথাও বুঝা যায় যে, সাধারণ মুসলমানের ইবাদত আল্লাহ’র প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের সাথে মিলে কবূলিয়াতের মর্যাদা লাভ করে। আর এতে শিরক বাতিল হয়েছে। কারণ আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর জন্য ইবাদত হতে পারে না।
প্রকাশ থাকে যে, ওহাবী পন্থীরা এ আয়াতে কারীমা দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া ‘শিরক’ বলে থাকে। যেহেতু এখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’।
এর জবাব হচ্ছে, এখানে সাহায্য বলতে যথার্থ বা প্রকৃত সাহায্যের কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মূলতঃ তোমাকেই প্রকৃত সাহায্যকারী হিসেবে বিশ্বাস করি। এখন রইলো বান্দার কাছ হতে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারটি। বান্দার কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া হয় তাদেরকে ফয়জে ইলাহী লাভের মাধ্যম রূপে বিশ্বাস করে। যেমন কোরআনে আছে, ‘ইনিলহুকমু ইল্লা লিল্লাহি’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম করার অধিকার নাই। অন্যত্র আছে- ‘লাহু মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ’ অর্থাৎ আসমান-জমিনে যা কিছু আছে সব কিছু আল্লাহ’রই। তারপরও আমরা সরকার বা শাসক বর্গের হুকুম মান্য করি। নিজেদের জিনিসের উপর মালিকানা দাবী করি। অতএব বুঝা যায় যে, উপরোক্ত আয়াত দ্বয়ে হুকুম ও মালিকানা বলতে, প্রকৃত হুকুম ও মালিকানাকে বুঝানো হয়েছে। বান্দাদের বেলায় কিন্তু হুকুম ও মালিকানা আল্লাহ প্রদত্ত।
তাছাড়া উক্ত আয়াতে যে ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে, এ দু’য়ের মধ্যে সম্পর্ক কি তা নির্ণয় করতে হবে। এ দু’টি বিষয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তাহলো, আল্লাহকে প্রকৃত সাহায্যের উৎস মনে করে সাহায্য প্রার্থনা করা ও ইবাদতের একটি অংশ। পুজারীগণ মূর্তি-পূজার সময় সাহায্যের আবেদন সম্বলিত শব্দাবলী উচ্চারন করে থাকে। যেমন, ‘মা-কালী’ তোমার দোহাই ইত্যাদি। এ উদ্দেশ্যেই ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনা কথা দু’টির একত্রে সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। আয়াতের লক্ষ যদি এই হয়ে থাকে যে, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো কাছ থেকে যেকোন ধরনের সাহায্য প্রার্থনাই ‘শিরক’ তাহলে পৃথিবীর বুকে কেহ মুসলমান থাকতে পারেনা। কারণ এখনো মসজিদ-মাদ্রাসার চাঁদার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি বর্গের সাহায্য ভিক্ষা চাওয়া হয়। মানুষ তার জন্ম লগ্ন থেকে কবরস্থ হওয়া পর্যন্ত, এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত বান্দাদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। ধাত্রির সাহায্যে জন্ম গ্রহণ করা, পিতা-মাতার মাধ্যমে লালিত-পালিত হওয়া, শিক্ষকের সাহায্যে জ্ঞান অর্জন করা, মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজন দ্বারা কবর খনন, কাফন-দাফন হওয়া ইত্যাদি কাজ গুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে আমরা কোন মুখে বলতে পারি যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো মুখাপেক্ষী নই? তাহলে বুঝা গেলো প্রকৃত সাহায্য আল্লাহ’রই কিন্তু অন্যের সাহায্য হলো উসীলা।

اهدنا الصراط المستقيم
ইহদিনাস সিরা-তালমুস্তাকীম
অর্থাৎ (হেআল্লাহ্!) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।
সোজা রাস্তা, যাতে কোন আঁকা-বাকা নেই। এ সরল পথই মানুষের চরম আর্তি এবং প্রাপ্তি। তাই পৃথক বাক্যের মাধ্যমে এ প্রার্থনাটি পেশ করা হয়েছে। হেদায়েতের প্রকৃত অর্থ হলো- বিনম্র পথ প্রদর্শন। কেবল কল্যাণ ও পূণ্য বুঝাতেই ‘হেদায়েত’ শব্দটি ব্যবহ্রত হয়। ‘আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করো’ এ প্রার্থনাটি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে উচ্চারিত তাঁর সকল উম্মতের প্রার্থনা। তাঁর হেদায়েত প্রাপ্তিতো পূর্বেই সুনিশ্চিত ছিলো। এ প্রার্থনাটি উচ্চারনের মাধ্যমে তিনি তাঁর উম্মতকে হেদায়েত প্রাপ্তির নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। অবশ্য হেদায়েত প্রাপ্তদের জন্যও এ প্রার্থনাটি জরুরী। প্রকৃত বিশ্বাসীদের অন্তরে অধিকতর হেদায়েত প্রাপ্তির কামনা চির বহ্নি মান। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এটাই মতাদর্শ যে, আল্লাহ পাকের করুণা ও হেদায়েত অন্তহীন। (তাফসীরে মাযহারি)
‘আমাদেরকে সরল পথ দেখাও’- আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয়ের পর ইবাদত, তারপর প্রার্থনা শিক্ষা দিচ্ছেন। এ থেকে এ মাস’আলা জানা যায় যে, বান্দাদের ইবাদতের পর দোয়ায় মগ্ন হওয়া উচিৎ। হাদিছ শরীফেও নামাজের পর দোয়া বা প্রার্থনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। (তাবরানী ফিল কবীর ও বায়হাকী)
‘সিরাতাল মুস্তাকীম’ দ্বারা ‘ইসলাম’ বা ‘কোরআন শরীফ’ কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূত-পবিত্র চরিত্র, অথবা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজন (আহলে বায়ত) ও সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম এর কথাই বুঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘সিরাতুল মূস্তাকীম’ হলো, আহলে সুন্নাতেরই অনুসৃত পথ; যারা আহলে বায়ত, সাহাবা-ই কিরাম, কোরআন ও সুন্নাহ এবং ‘বৃহত্তমজামাত’ সবাইকে মান্য করে। (খাজাইনুল ইরফান)
‘মুস্তাকীম’ অর্থ সমতল বা সরল। প্রকৃত অর্থ হলো সত্য পথ। কেউ কেউ অর্থ করেছেন ‘ইসলাম’। হজরত আবুল আলিয়া এবং ইমাম হাসান (রাঃ) বলেছেন, সিরাতুল মুস্তাকীম হচ্ছে হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর প্রধান সহচর হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এর পথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার পরে আমার আদর্শ এবং খোলফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধর। তিনি আরো নির্দেশ করেছেন, আমার পরে আবু বকর ও ওমরের (রাঃ) অনুসারী হইও। (তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে নঈমী,খাজাইনুল ইরফান ইত্যাদি)

صراط الذين انعمت عليهم
সিরা-তাল্লাযীনা আন’আমতা আ’লাইহীম-
অর্থাৎ তাঁদের পথ যারা আপনার নে’আমত বা অনুগ্রহ লাভ করেছে।
এ আয়াতে কারীমা ‘সিরাতাল মুস্তাকীমের’ ব্যাখ্যা। যারা আপনার অনুগ্রহ বা দয়া পেয়েছে তাঁদের পথই সোজা-সরল রাস্তা। এতে করে এ কথাটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, ঐ সমস্ত প্রিয়জন লোকের পথ যাদের মুস্তাকীম হওয়ার বিষয়টি সুস্বীকৃত। এর অর্থ দাঁড়াবে এরকম- হে আল্লাহ্! আমাদেরকে ঐ সমস্ত লোকের পথানুগামী করো, যাঁদের কে তুমি করুণা সিক্ত করেছো। ঐ করুণা সিক্ত লোকেরাই ঈমান ও আনুগত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর করুণা সিক্ত বা অনুগ্রহ প্রাপ্ত প্রিয় ভাজন কারা আল্লাহ পাকই সূরা নিসা’র ৬৯নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন- “আল্লাজিনা আন’আমাল্লাহু আলাইহিম মিনা ন্নাবীয়্যিনা ওয়াস সিদ্দীকিনা ওয়াশ শোহাদায়ে ওয়াস সালেহীন” অর্থাৎ নে’আমত প্রাপ্তরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালেহীনগণ। আল্লাহ’র দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবীগণের। অতঃপর নবীগণের উম্মতের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী, তাঁরা হলেন ‘সিদ্দীক’ যাদের মধ্যে রূহানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে, সাধারন ভাষায় তাঁদেরকে ‘আউলিয়া’ বলা হয়। আর যারা দ্বীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালেহীন হলো সৎকর্ম পরায়নশীল তাঁরাও আউলিয়া শ্রেনী ভূক্ত।
অতএব, বুজুরগানে দ্বীন বা আউলিয়ায়ে কিরাম যে সকল আমল করেছেন বা যে পথে চলেছেন তা-ই ‘সিরাতাল মুস্তাকীম’।এছাড়াএটাওপ্রমাণিতহলোহযরতআবুবকরসিদ্দীক (রাঃ) এর খেলাফত হক্ব বা সঠিক। কেননা সিদ্দীকিনদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। ( দৈনিক নামাজের প্রতি রাকা’আতে আমরা সূরা ফাতিহা ওয়াজিব হিসেবে পাঠ করি, আর নবী-অলী’র পথ অনুস্মরণ করার জন্য ফরিয়াদ করি, কিন্তু বাস্তবে তা কয়জনে মানি?)
তাফসীরে জালালাইন, মাযহারী, কবীর, নঈমী, খাজাইনুল ইরফান, মা’আরেফুল কোরআন ইত্যাদি।

غير المغضوب عليهيم ولا الضالين
গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লিন (আমিন)-
অর্থাৎ যারা আপনার অভিসম্পাত গ্রস্ত বা গজব গ্রস্ত তাঁদের পথে নয়, তাদের পথেও নয় যারা পথহারা হয়েছে।
এ বাক্যটি ‘আন’আমতা আলাইহিম’ বাক্যের ব্যাখ্যা বোধক। এ বাক্যে ও হেদায়েত রয়েছে। অর্থাৎ যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর করুণা দানে ধন্য করেছেন, তারাই আল্লাহ’র গজব ও পথভ্রষ্ঠতা থেকে মুক্ত বা সুরক্ষিত।
প্রতি শোধ স্পৃহার উল্লাস ও উদ্দীপনার নাম গজব। কিন্তু এর সম্পর্ক যখন আল্লাহ’র সঙ্গে করা হয়, তখন তাঁর মর্ম হবে গজবের পরিণাম বা পরিসমাপ্তি। ‘আযাব’ এবং ‘দালালাহ’ শব্দ দু’টি হেদায়েতের পথের বিপরীত অর্থ বোধক শব্দ অর্থাৎ যে পথ আল্লাহ পর্যন্ত পৌছায়, ঐ পথের প্রতি বিমূখতাই দালালাহ বা পথভ্রষ্ঠতা। হযরত আদি বিন হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যাদের প্রতি গজব অবতীর্ণ হয়েছে তারা ‘ইহুদী’, আর যারা পথভ্রষ্ঠ তারা ‘খৃষ্টান’। এ হাদীছটি ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে হাব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে লিপি বদ্ধ করেছেন। তিরমীজি স্বীকার করেছেন হাদিছটি হাসান।
তাফসীরে মাযহারী লেখক বলেন, ‘গাইরীল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লিন’ অর্থাৎ গজব গ্রস্ত ও পথভ্রষ্ঠ- এ শব্দ দু’টিতে সাধারন ভাবে সকল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, অবাধ্য এবং বেদাতী সম্প্রদায় শামীল রায়েছে।
মাস’আলা- সত্য-সন্ধানীদের জন্য, আল্লাহ’র দুশমন থেকে দূরে থাকা এবং রীতি-নীতি থেকে বিরত থাকা একান্ত আবশ্যক। তিরমীজি শরীফের হাদিছ দ্বারা জানা যায়, ‘মাগদুবি আলাইহিম’ যারা ‘ইহুদী’ এবং ‘দোয়াল্লিন’ দ্বারা ‘খ্রিষ্টানদের’ কথা বুঝানো হয়েছে।
মাস’আলা- ‘দোয়াদ’ ও ‘যোয়া’ এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বৈশিষ্ঠ্যে অক্ষর দু’টির মিল থাকা, উভয়কে এক করতে পারে না।কাজেই ‘মাগদুবি’ এর মধ্যে ‘যোয়া’ সহকারে পাঠ করা যদি ইচ্ছা কৃত হয়, তাহলে তা হবে কোরআন শরীফের বিকৃতি সাধন ও কুফর নতুবা নাজায়েয।
মাস’আলা- যে ব্যক্তি ‘দোয়াদের’ স্থলে ‘যোয়া’ পড়ে সে ব্যাক্তির ইমামত জায়েয নয়।
আমিন- এর অর্থ হলো ‘এরূপকরো’ অথবা ‘কবুল করো’।
মাস’আলা- ‘আমিন’ এটা কোরআনের শব্দ নয়। সূরা ফাতিহা পাঠান্তে নামজে ও নামাজের বাইরে ‘আমীন’ বলা সূন্নাত। আমাদের হানাফী মাযহাবে নামাজে নীরবে আমিন বলতে হয়।
‘সূরা আল ফাতিহার’ আয়াত সাতটির তাফসীর শেষহয়েছে। এখন সমগ্র সূরার সার মর্ম হচ্ছে এ দোয়া- ‘হে আল্লাহ্! আমাদিগকে সরল পথ দান করুন। কেননা সরল পথের সন্ধান লাভ করাই সবচাইতে বড় জ্ঞান ও সর্বাপেক্ষা বড় কামিয়াবী। বস্তুতঃ সরল পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে। অন্যথায় অ-মুসলমানদের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুস্মরন করার আগ্রহ-আকুতির অভাব নেই। এ জন্যই কোরআন শরীফে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতেই সিরাতে মুস্তাকীমের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আর সূরায়ে ফাতিহাতে নবী-অলী’র পথকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলা হয়েছে। সূরা ফতিহাকে ‘উম্মূল কোরআন’ বলা হয়। যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা বুঝতে পারলো সে গোটা কোরআন শরীফ ও ইসলামকে বুঝতে পারলো। সমাপ্ত।

(তাফসীরে রুহুল বয়ান, মাযহারী, জালালাইন, কবীর, খাজাইনুল ইরফান, মা’রেফুল কোরআন, তিরমীজি শরিফ ইত্যাদি)

Top