একচল্লিশতম অধ্যায়ঃ বিদেশে ইসলামের দাওয়াতঃ ৭ম হিজরীঃ
প্রসঙ্গঃ ছয়জন সাহাবী দূতকে একমূহুর্তে ঐ দেশিয় ভাষা শিক্ষাদান, নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণ, পারস্যরাজের বেয়াদবী ও তার পরিণাম, রুম সম্রাট ও মিশর অধিপতি কতৃক পত্রের সম্মান প্রদর্শন।
=========
হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির পর নবী করিম [ﷺ] মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধিপতিদের নামে ইসলামী দাওয়াতপত্র লিখে ছয়জন সাহাবীকে দূত মনোনীত করে তাঁদের কাছে পবিত্র পত্র অর্পণ করেন। সাথে কিছু প্রতিনিধি সদস্যও দিলেন। ৭ম হিজরীতে তাঁরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে সকলেই ঐ দেশের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁদের এই ভাষাজ্ঞান অর্জন ছিল নবী করিম [ﷺ]-এঁর নেক নযরের বরকতে।
হযরত আদম (عليه السلام) পাঁচ লক্ষ- মতান্তরে সাত লক্ষ ভাষা জানতেন (বেদায়া-নেহায়া)। আমাদের প্রিয়নবী [ﷺ] যে কেবল বিভিন্ন দেশের মানুষের ভাষাই জানতেন, তা নয়, বরং জ্বীন, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ- এমনকি, নির্জীব পাথরের সাথেও কথা বলেছেন। হযরত আদম (عليه السلام) এবং সমস্ত নবীগণের এলেম এক পাল্লায় রাখা হলে আর নবী করিম [ﷺ]-এঁর এলেম অন্য পাল্লায় রাখা হলে এটিই ভারী হবে। “অন্য নবীগণের এক ফোটা পানির তূল্য এবং নবী করিম [ﷺ]-এঁর এলেম সাগরতূল্য” (কসিদায়ে বুরদা ও রুহুল বয়ান)।
কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়- দেওবন্দের মাওলানা খলিল আহমদ আম্বেটী বারাহীনে কাতেয়া গ্রন্থে তার একটি স্বপ্ন বৃত্তান্ত এভাবে লিখেছে- “নবী করিম [ﷺ] তার সাথে স্বপ্নে দেখা দিয়ে উর্দ্দূতে কথা বলছিলেন। খলিল আহমদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলো- হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তো আরবীভাষী- উর্দ্দূ শিখলেন কোত্থেকে? উত্তরে নবী করিম [ﷺ] নাকি বললেন- “যেদিন থেকে দেওবন্দের ওলামাদের সাথে মেলামেশা শুরু করেছি, সেদিন থেকেই।” তাহলে বুঝা গেল- দেওবন্দের হুজুরগণ নবীজীর উর্দূর ওস্তাদ। (নাউযুবিল্লাহ)
ছয়জন সাহাবীকে যিনি একমূহুর্তে অন্য ভাষা শেখাতে পারেন- তিনি দেওবন্দে এসে উর্দূ শিখবেন কেন (?) কুফুরী কাকে বলে? দেওবন্দীরা স্বপ্নের দ্বারা নবীজীর ভাষাজ্ঞানের অভাব প্রমাণ করছে। নাউযুবিল্লাহ!
যাই হোক, যে ছয়জনকে নবী করিম [ﷺ] পত্রবাহক দূত হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, তাঁরা হলেন- (১) আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজজাশী আসহামার দরবারে প্রেরিত হযরত আমর ইবনে উমাইয়া দামিরী (رضي الله عنه), (২) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে প্রেরিত হযরত দাহইয়া কলবী (رضي الله عنه), (৩) পারস্যরাজ খসরু পারভেজের দরবারে প্রেরিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হোযাফা সাহমী (رضي الله عنه), (৪) মিশর অধিপতি মুকাইকিছ-এঁর দরবারে প্রেরিত হযরত হাতেব ইবনে আবু বোলতাআ, (৫) গাসসানী শাসক হারেছের দরবারে প্রেরিত হযরত সুজা ইবনে হাদরামী (رضي الله عنه), (৬) বাহরাইন অধিপতি মুনযির-এঁর দরবারে প্রেরিত হযরত আলা ইবনে হাদরামী (رضي الله عنه)।
এছাড়াও সুমামা, ওমান, ইয়েমেন- ইত্যাদি স্থানের অধিপতিদের নিকটও দাওয়াতীপত্র প্রেরণ করা হয়েছিল। উক্ত পত্র আরবীতে লিখা ছিল এবং পত্রের নীচে আংটি দ্বারা সই-মোহর অঙ্কিত ছিল। উক্ত সিলে লেখা ছিল- ক্রমান্বয়ে নীচ থেকে উপরের দিকে “মোহাম্মদ-রাসুল-আল্লাহ।” উক্ত মোবারক পত্রের ভাষা ছিল অত্যন্ত সরল অথচ তেজোদীপ্ত। বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট মুসলমান হওয়ার দাওয়াতনামা প্রেরণ করা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু সেই কঠিন কাজটিই করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ]।
নাজ্জাশীর (رحمة الله عليه) ইসলাম গ্রহণঃ
সর্বপ্রথম পত্র বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়ার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশী ১৫/১৬ বৎসর পূর্ব হতেই ইসলামের সাথে পরিচিত ছিলেন। নবুয়তের ৫ম সালে মক্কা শরীফ হতে মুসলমানদের দুটি দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নাজ্জাশীর আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হযরত ওসমান (رضي الله عنه) ও হযরত রোকাইয়া (رضي الله عنها) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁদের চালচলন- ইত্যাদি দেখে নাজ্জাশী মুগ্ধ হয়েছিলেন- যদিও তিনি ছিলেন খৃষ্টান রাজা। প্রতিনিধি হযরত আমর ইবনে উমাইয়া (رضي الله عنه) পত্র হস্তান্তর করলে বাদশাহ নাজ্জাশী মনোযোগ দিয়ে পত্র পাঠ শুনলেন এবং সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে জাবাবী পত্র লিখলেন এভাবে-
“বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম! আল্লাহর প্রিয় রাসুল মোহাম্মদ [ﷺ]-এঁর খেদমতে আসহামা নাজ্জাশী (সম্রাট)-এঁর পত্র। হে আল্লাহর রাসুল। আপনার উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত অবর্তীণ হোক- যিনি ভিন্ন অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি আমাকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দান করেছেন। হে আল্লাহর প্রিয় রাসুল! আপনার পবিত্র দাওয়াতনামা আমি পেয়েছি। আপনি পত্রে হযরত ঈছা (عليه السلام) সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন- তা হুবহু সত্য। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- নিশ্চয় আপনি সত্য রাসুল। আমি আপনার নিকট ইসলামের উপর বাইআত করলাম এবং প্রেরিত প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আপনার চাচাতো ভাই হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব-এঁর নিকটও বাইআত করলাম। আমি তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করলাম। আপনার প্রতিনিধি দলের সাথে আমার ছেলেকে পাঠালাম। নির্দেশ পেলে আমি নিজে খেদমতে হাযির হবো। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- আপনার যাবতীয় কথা সত্য। ওয়াস সালাম।” (নাজ্জাশী ছিলেন তাবেয়ী)
এই নাজ্জাশী (رحمة الله عليه) ৯ম হিজরীতে রমযান মাসে ইনতিকাল করেন। নবী করিম [ﷺ] তাবুকের যুদ্ধ হতে সবেমাত্র মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। মদিনা শরীফ থেকে তিনি নাজ্জাশীর লাশ দেখতে পেলেন এবং সাহাবীদের নিয়ে জানাযার নামায আদায় করলেন।
[জানাযার নামাযে লাশ ইমামের দৃষ্টির সামনে থাকা শর্ত। লাশ সামনে না রেখে গায়েবী জানাযা পড়া হানাফী মযহাবমতে দূরস্ত নয়। নাজ্জাশীর ঘটনায় প্রমাণিত হলো- নবীজী হাযির ও নাযির। তিনি নিকটে ও দূরে একই রকম দেখেন ও শুনেন।]
রোমের সম্রাট পত্র পেয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন বটে, কিন্তু লোকের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারলেন না। কিন্তু পারস্যরাজ খসরু পত্র পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং পত্রখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো। আবদুল্লাহ ইবনে হোযাফা সাহমী (رضي الله عنه)-এঁর নিকট থেকে এই সংবাদ পেয়ে নবী করিম [ﷺ] মুখে উচ্চারণ করলেন- “তাঁর রাষ্ট্রই বরং টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।” পরবর্তীতে তাই হয়েছিল। মিশর অধিপতি মুকাইকিছ পত্র পেয়ে দূতকে সম্মান করলেন। প্রথা অনুযায়ী অনেক হাদিয়া তোহফা দিয়ে এবং উচ্চবংশীয় দু’জন কিবতী রমনীকে (হযরত মারিয়া ও তাঁর বোন শীরীন) হাদিয়া হিসাবে দান করে দূতের নিকট জবাবী পত্রে লিখলেন-
“আমি আপনার প্রেরিত দাওয়াতী পত্রখানা পাঠ করেছি এবং মর্ম অবগত হয়েছি। আমি জানি- একজন নবীর আগমন এখনো বাকী রয়েছে। আমার ধারণা ছিল- তিনি সিরিয়াতে আগমণ করবেন। আমি আপনার দূত (হাতেব) কে সম্মান প্রদর্শন করেছি। আপনার খেদমতে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রথা অনুযায়ী দু’জন উচ্চবংশীয় কিবতী রমনীকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রেরণ করা হলো। সাথে কিছু মূল্যবান পোষাক ও একটি উন্নতমানের খচ্চর প্রেরণ করা হলো। ওয়াস সালাম।”
হযরত মারিয়া কিবতিয়া (رضي الله عنها)-কে নিজে বিবাহ করে নবী করীম [ﷺ] অপর বোন শিরীন (رضي الله عنها)-কে হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه)- এর সাথে বিবাহ দেন। হযরত মারিয়া কিবতিয়া (رضي الله عنها)- এর গর্ভে নবী করীম [ﷺ]- এর এক শাহজাদা হযরত ইব্রাহীম (رضي الله عنه) জন্মগ্রহণ করেন এবং দুগ্ধ পানকালেই তিনি ইন্তিকাল করেন।
বাহরাইন অধিপতি মুনজির নিজে মুসলমান না হলেও পত্রপাঠে কিছুলোক মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু ইয়াহুদি ও অগ্নি উপাসকরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। দামেস্কের পথে বুছরার গাসসানী অধিপতি হারেছ-এঁর নিকট পত্রে নবী করীম সরাসরি তাকে মুসলমান হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সে ইসলাম গ্রহণ করেনি। নবী করীম এই সংবাদে বললেন, ”বাদা ওয়া বাদা মূলকুহু”, অর্থাৎ ”তার রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত।”
সপ্তম হিজরীতে দাওয়াতীপত্র প্রেরণের মাধ্যমে নবী করীম বিশ্বের দরবারে নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করলেন। তাঁর ইসলামী দাওয়াতকেই তাবলীগ বলা হয়। বিশ্ব্বব্যাপী সে সময়েই ইসলামী মূল তাবলীগ পৌঁছে গিয়েছিলো। ইসলামের তাবলীগী দাওয়াত হয় শুধু কাফেরদের জন্য (সুরা মায়েদা)। মুসলমানদের বেলায় ইসলামী নিয়ম কানুন, নামায-রোজা ইত্যাদি শিক্ষা দেয়াকে কোরআনের ভাষায় যিকরা বা তা’লীম ও নসিহত বলা হয় (আল-কোরআন)। এটাকে তাবলীগ বলা নবুয়তের দাবীর নামান্তর। মাদ্রাসা, খানকাহ ও ওয়ায়জের মাধ্যমে ইসলামী তা’লীম চিরদিন চলবে। ছুরা-কালাম শিক্ষা দেয়ার নাম তাবলীগ নয়, বরং তা’লীম।
আজকাল দিল্লীর যে তাবলীগ জামাত বের হয়েছে, তা মদিনার ইসলামী তাবলীগ নয়। কেননা, নবী করীম ও সাহাবায়ে কেরাম কোনোদিন ছয় উছুল নিয়ে এভাবে বিছানাপত্র ও হাণ্ডি-পাতিল নিয়ে কোন মুসলমানের এলাকায় যাননি এবং মসজিদেও রাত্রি যাপন করেননি। ইসলামের ইতিহাস তার সাক্ষী। তদুপরি - নবীজীর যুগে, সাহাবীগণের যুগে এবং বিগত ১৪ শত বৎসরে ছয় উছুল ছিল না। তাই এটা একটি নতুন বিদ’আতে ছাইয়্যেয়া বা হারাম বিদ’আত। ইসলামী পঞ্চবেনার সাথে এই ৬ উছুল সাংঘর্ষিক - তাই পরিত্যাজ্য।