বিংশ অধ্যায়ঃ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারঃ
প্রসঙ্গঃ কোরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি
=========
নবী করিম [ﷺ] তিন বৎসর পর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের অনুমতিপ্রাপ্ত হন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেক তিনি দাওয়াতী কাজের প্রোগ্রাম ও পরিকল্পনা তৈরী করেন। আল্লাহ তায়ালা প্রথমে নির্দেশ দিলেন নিকটাত্মীয়দেরকে দাওয়াত দেয়ার জন্য - (سورة الشعراء - الآية 214) وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ
--”আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন”
তারপর নির্দেশ দিলেনঃ (سورة الحجر - الآية 94) فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
--”আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং এ কাজে মুশরিকদের পরওয়া না করে কাজে ঝাপিয়ে পড়ুন।”
নবী করিম [ﷺ] ধৈর্য্যের সাথে ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কোরাইশদের মধ্য থেকে দু’একজন করে মুসলমান হতে লাগলেন। কোরাইশগণ প্রবলভাবে বাধা দিতে লাগলো। তাদের একাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো নবীজী [ﷺ]-র আপন চাচা আবু লাহাব। সে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে লোকদেরকে নিষেধ করতো। কিন্তু বড় চাচা আবু তালেব নবীজী [ﷺ]- কে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন এবং তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। এজন্য একাজের পুরস্কার স্বরূপ তিনি পরকালে নবীজীর একটি সুপারিশ লাভ করবেন- তাঁকে দোযখের ভিতরে না নিয়ে বহির্দেশে রেখে সবচেয়ে হালকা শাস্তি প্রদান করা হবে। নবীজী [ﷺ]-র সাথে শুধু মহব্বৎ পোষণ করে যদি একজন অমুসলিমও বিরাট উপকার পেতে পারে তাহলে একজন আমলধারী আশেকে রাসূলের পুরস্কার কি হবে—তা কোরআন হাদীসে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা নবীজীর শাফাআতে বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে।
কোরাইশদের অত্যাচার এক পর্যায়ে চরমে পৌঁছে। ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা নবীজীকে যাদুকর বলতো। অন্যরা পাগল ও শায়ের বলে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে লাগল। ওকবা নামে এক দুষ্টলোক নবীজীর গলা চেপে ধরতো- যখন তিনি খানায়ে কা’বায় নামাযে সিজদারত থাকতেন। বোখারী শরীফের বর্ণণা অনুযায়ী আবু জাহলের নির্দেশে একদল দুষ্টমতি লোক সিজদারত অবস্থায় নবীজীর পিঠে উটের নাড়িভূঁড়ি এনে চাপিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها) তখন ছোট কিশোরী। তিনি আব্বার এ অবস্থা দেখে দুশমনদেরকে গালাগাল দিয়ে অতিকষ্টে পশুর নাড়িভূঁড়ি সরিয়ে দিতেন। নামায শেষে নবী করিম [ﷺ] দুহাত তুলে বলতেন- ”হে আল্লাহ! তুমি আমর ইবনে হিশাম, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ, ওকবা ইবনে মুয়ীত, উমারা ইবনে ওয়ালিদ- এদের সকলের বিচার কর।” পরবর্তীকালে বদরের যুদ্ধে এদের মধ্যে অধিকাংশ নেতাই নিহত হয়।
এর পরপরই মক্কায় আপন চাচা হযরত হামযা (رضي الله عنه) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বীরপুরুষ। তাঁর প্রভাবে এবং শক্তি মত্তার কারণে কুরাইশেদের অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা কমে আসে।
এবার কোরাইশরা নূতন চাল শুরু করলো। তারা ধন-দৌলত, রাজত্ব ও নারীর টোপ ফেলে নবীজী [ﷺ]-কে আয়ত্ব করতে চাইলো। নবী করিম [ﷺ] অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলেন- ”তোমাদের প্রস্তাবিত তিনটি সুযোগ-সুবিধার কোনটিতেই আমার প্রয়োজন নেই। এমনকি আমার এক হাতে চন্দ্র, আর এক হাতে সূর্য্য এনে দিলেও আমাকে মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ করা যাবেনা।”
[হায় আফসোস! আমরা নবীর উম্মত হয়ে সামান্য প্রলোভনে পড়ে সত্যিকারের আদর্শ থেকে সরে দাঁড়াতে একটুও ইতস্ততঃ করিনা। পেট্রোডলারের প্রলোভনে পড়ে আমরা ওহাবীদের সাথে, মউদূদীদের সাথে এবং শিয়াদের সাথে গাঁটছড়া বেধে ফেলি।]
যাক, এবার শুরু হলো অত্যাচারের দ্বিতীয় পালা। কোরাইশরা ইসলামে নবদিক্ষীত ক্রীতদাসদের উপর অত্যাচার শুরু করলো। আবু জাহল হযরত আম্মার ইবনে ইয়াছির (رضي الله عنه)-এঁর মা হযরত ছুমাইয়া (رضي الله عنهما) কে বর্শা দিয়ে লজ্জাস্থানে আঘাত করে শহীদ করে ফেললো। তিনিই ইসলামে প্রথম শহীদ মহিলা। আম্মার (رضي الله عنه)-কে শহীদ করার চেষ্টা করে কোরাইশরা ব্যর্থ হয়। নবী করিম [ﷺ] ইলমে গায়েবের সাহায্যে বলে দিলেন, ”তোমাকে কোরাইশরা শহীদ করতে পারবে না। তুমি শহীদ হবে মুসলিম বিদ্রোহী দলের হাতে।”
[তিনি সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর পক্ষে যুদ্ধ করে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) প্রাদেশিক গভর্ণর হয়ে কেন্দ্রীয় খলিফা হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। হযরত আম্মার (رضي الله عنه)-এঁর শাহাদত দ্বারা প্রমাণিত হলো, হযরত আলী (رضي الله عنه)-র পক্ষই ছিল হক্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ছিলেন মুসলিম বিদ্রোহী। তিনি কাফের বা মুনাফিক ছিলেন না।] (কোরআন ছুরা হুজুরাত)।
এরপর উমাইয়া ইবনে খলফ তার ক্রীতদাস হযরত বেলাল (رضي الله عنه)-এঁর উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করলো। তপ্ত পাথরের উপর শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে হযরত বেলাল (رضي الله عنه)-কে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে ত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু হযরত বেলাল (رضي الله عنه) এই অগ্নি পরীক্ষায়ও টিকে গেলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) চল্লিশ হাজার দিরহামের বিনিময়ে হযরত বেলাল (رضي الله عنه)-কে খরিদ করে নবীজীর খেদমতে উভয়ে হাযির হয়ে আরয করলেন-
مثنوی)) گفت ما او بندگان کوی تو -کردمش ازاد هم بر وةی تو-
অর্থ- ”হে আল্লাহর প্রিয় রাসুল [ﷺ]! আমি (আবু বকর) ও বেলাল- উভয়েই আপনার দরবারের বান্দা বা গোলাম। আমি বান্দা আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আপনার অন্য এক বান্দাকে আযাদ করে দিলাম।” (মসনবী)
[নবী প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল এটি। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) নিজেকে নবীর বান্দা বলে প্রকাশ করেছিলেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) নিজেকে নবীজীর বান্দা বলে স্বীকার করেছেন এভাবে-
كنت مع النبى صلى الله عليه وسلم فكنته عبده وخادمه -
অর্থ- ”আমি (ওমর) রাসুল করিম [ﷺ]-এঁর একজন বান্দা ও খাদেম হিসেবে তাঁর সাথে ছিলাম।” (মোস্তাদরাক) ]
আজকাল এক শ্রেণীর বাতিল আক্বিদাপন্থী ওহাবী আলেম আবদুন্নবী, গোলাম নবী ইত্যাদি- নামকরণকে তাদের কিতাবে শিরক বলে লিখেছে। (বেহেস্তী জেওর ও ফতোয়া রশিদিয়া দ্রষ্টব্য।]
হযরত আবযর গিফারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন—সর্বপ্রথম সাতজন নিজেদের ইসলাম প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তন্মধ্যে হযরত নবী করিম [ﷺ], হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه), হযরত আম্মার (رضي الله عنه), হযরত বিবি ছুমাইয়া (رضي الله عنه), হযরত বেলাল (رضي الله عنه), হযরত ছোহায়ব (رضي الله عنه) ও হযরত মেকদাদ (رضي الله عنه)। এই ঘটনা নবুয়ত ও ইসলাম প্রচারের ৫ম সালের।