সাইত্রিশতম অধ্যায়ঃ খন্দকের যুদ্ধঃ
প্রসঙ্গঃ কুরাইশদের শেষ আক্রমণ, হুযুর [ﷺ] -ইলমে গায়েব প্রকাশ
==========
কোরাইশদের পক্ষ থেকে সর্বশেষে আক্রমণাত্মাক বৃহত্তম যুদ্ধ ছিল খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জঙ্গে আহযাব নামেও পরিচিতি। আহযাব অর্থ বিরাট বাহিনী। এ যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তারা ৫ম হিজরীর যিলক্কদ মাসে মদিনা আক্রমণ করে। কোরাইশ ছাড়াও মদিনায় বিশ্বঘাতকতা ইহুদী, গাতফান-প্রভৃতি গোত্র তাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলো। এই অন্যতম রণকৌশল-পরিখা খনন এবং আল্লাহর গায়েবী সাহায্য হিসাব তীব্র হিমপ্রবাহ কোরাইশদের অভিযানকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
যুদ্ধের কারণঃ
মদিনায় ইহুদী সম্প্রদায় বনু কোরায়যা পুর্বচুক্তি ভঙ্গ করে মক্কার কোরাইশদেরকে মদিনা আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এ উদ্দেশ্যে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধি দল মক্কায় গমন করে। তারা মক্কাবাসীদেরকে বলে, তোমরা মদিনা আক্রমণ করলে আমরা মদিনার ইহুদী সম্প্রদায় তোমাদের সাথে থাকবো এবং মুসলমানদেরকে সমূলে উৎপাটিত করবো। এভাবে তারা মক্কবাসীকে যুদ্ধের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে সক্ষম হয় এবং ঐক্যমত্যে পৌছে। অতঃপর বনু গাতফান গোত্রে গমন করে এবং কোরাইশদের প্রস্তুতির কথা জানায়। এভাবে কোরাইশ, গাতফান ও মদিনার ইহুদীদের সম্মিলিত বাহিনী যুদ্ধ-প্রস্ততি গ্রহণ করতে থাকে। কোরেশ বাহিনীর সর্দার আবু সুফিয়ান, গাতফান বাহিনীর দুই উপ গোত্রের দুই সর্দার উরাইনা ও হারিছ বিভিন্ন গোত্র থেকে দশ হাজার সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করতে থাকে। এ সংবাদ দ্রুতবেগে মদিনায় পৌছে যায়। নবী করিম [ﷺ] সাহবায়ে কেরামকে নিয়ে পরার্শ সভায় বসেন। নও মুসলিম বৃদ্ধ সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) ছিলেন যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী নবী করিম [ﷺ] মাত্র তিন হাজার সৈন্যের বাহিনী তৈরী করলেন এবং মদিনা শরীফের উত্তর-পশ্চিম দিকে পরিখা খনন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি তিন হাজার সৈন্যের মধ্যে খাল কাটার কাজ বন্টন করে দিলেন। এক এক গ্রুপের উপর নির্ধারিত স্থান খননের দায়িত্ব অর্পিত হলো।
পরিখা খননকালে এমন কতিপয় মো’জেযা প্রকাশ পেলো যা নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েব, গায়েবী খাদ্য প্রদান, ইসলামী হুকুমতের সীমানা সম্প্রসারণের ভবিষৎবানী প্রদান এবং শক্রুদের আক্রমণাত্মক শক্তির পরিসমাপ্তি - ইত্যাদি ঘটনা হুযুরের বিস্ময়কর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ বহন করে। নিম্মে তা উল্লেখ করা হলোঃ-
(ক) বিরাট প্রস্তরখন্ড আবিস্কার এবং নবী করিম [ﷺ] কর্তৃক তা বিচূর্ণ করণঃ
ইমামা নাছায়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليهما) হযরত বারাৱ’ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণানা করেন। বর্ণানাকারী সাহাবী বারা’ (رضي الله عنه) বলেন-হুযুর পাক [ﷺ]-এঁর নির্দেশ মোতাবেক আমরা খন্দক খনন করার কাজে লেগে গেলাম। মাটির নীচে এক বিরাট পাথর আবিস্কৃত হলো। আমাদের কোদাল বা সাবল দ্বারা ঐ পাথর ভাঙ্গা কিছুতেই সম্বব হলোনা। আমরা নবী করিম [ﷺ]-এঁর খেদমতে এ ঘটনা পেশ করলাম। নবী করিম [ﷺ] তশরীফ এনে সাবল হাতে নিলেন। ”বিছমিল্লাহ” বলে আঘাত করতেই পাথরের এক তৃতীয়াংশ খন্ডিত হয়ে গেলো। রাসুল করিম [ﷺ] “আল্লাহ আকবর” বলে তকবীর ধ্বনী দিলেন এবং এরশাদ করলেন। “আল্লাহর শপথ! আমাকে সিরিয়ার ধন ভান্ডারের চাবিসমূহ দান করা হয়েছে। আমি এই মূহুর্তে সিরিয়ার সমস্ত প্রাসাদ এবং মূল্যবান স্বর্ণের ধনরাজী প্রত্যক্ষ করছি।” (সোবহানাল্লাহ)
আবার তিনি ঐ পাথরে আঘাত করলেন। এবার অপর দ্বিতীয়াংশ ভেঙ্গে গেল। নবী করিম [ﷺ] দ্বিতীয়বার “আল্লাহু আকবর” ধ্বনী দিয়ে বলে উঠলেন- “আল্লাহর শপথ ! আমাকে পারস্যের ধন ভান্ডারের চাবিসমূহ অর্পণ করা হয়েছে। আমি এই মূহুর্তে মাদায়েন শহরের (ইরাক) শ্বেতশুভ্র প্রাসাদরাজী অবলোকন করছি।”
আবার তিনি তৃতীয়বার আঘাত করলেন। এবার বাকী অংশটুকু ও ভেঙ্গে গেল। নবী করিম [ﷺ] ”আল্লাহ আকবার” ধ্বনী দিয়ে বলে উঠলেন- “আল্লাহর শপথ! আমাকে ইয়েমেনের চাবিসমূহের মালিক বানানো হয়েছে। আমি এই মুহূর্তে ইয়েমেনের সানা শহরের গেইটসমূহ অবলোকন করছি।” (সোবহানাল্লাহ)
এ ঘটনায় লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে-
প্রথমতঃ অন্যান্য সাহাবীগণের সম্মিলিত শক্তি যেখানে নিষ্ক্রয় হয়ে গেলো- নবী করিম [ﷺ] একা সেই দুঃসাধ্য সাধন করলেন। হযুরের শক্তির কোন তুলনা নেই।
দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের এহেন বিভীষিকাময় মুর্হুতে আল্লাহর পক্ষে হতে ভবিষৎ বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান। নবী করিম [ﷺ]-এঁর জীবদশায়ই ইয়েমেন বিজিত হয়। হুযরে পাক [ﷺ]-এঁর ইনতিকালের পর ইয়ারমূক যুদ্ধে সিরিয়া এবং কাদেসিয়া যুদ্ধে পারশ্যে ও মাদায়েন বিজয় সমাপ্ত। পাথরখন্ডের মধ্যে আঘাতের কারণে আলো বিচ্ছুরণের মধ্যে নবী করিম [ﷺ] ভবিষ্যৎ বিজয় ও মহাশক্তিগুলোর পরাজয় প্রত্যক্ষ করে নিয়েছেন। এই ভবিষৎবাণীকেই ইলমে গায়েব আতায়ী বা আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব বলা হয়। ভবিষৎ বিজয়ের রেকর্ড হুযুরের শিলারের মধ্যে প্রদর্শন করা হলো।
(খ) হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এঁর বাড়ীতে দাওয়াতঃ খন্দক খননকালে নবী করিম [ﷺ]-এঁর বাহিনীতে খাদ্যভাবে ছিল প্রকট। নবী করিম [ﷺ] ছিলেন অতি ক্ষুধার্ত। হযরত জাবের (رضي الله عنه) এই অবস্থা দেখে ঘরে এসে নিজের স্ত্রী উম্মে সোলায়মাকে জিঞ্জেস করলেন- ঘরে খাবার কিছু আছে কি? বিবি বললেন, এক ছা’ বা চার সের পরিমাণ আটা এবং একটি মোটা তাজা ছোট ভেড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। স্বামীর নির্দেশে তিনি উক্ত ভেড়াটি যবেহ করলেন এবং আটা গুলে নিলেন। গোস্ত চুলায় চড়িয়ে হযরত জাবের (رضي الله عنه) নবী করিম [ﷺ]-এঁর খিদমতে হাযির হয়ে চুপে চুপে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ [ﷺ]! আমরা ছোট একটি ভেড়া যবেহ করেছি এবং এক ছা’ পরিমাণ আটার খামিরা তৈরী করেছি। অনুগ্রহ করে আপনি এই পরিমান সঙ্গী নিয়ে আমাদের ঘরে তশরীফ নিয়ে আসুন। নবী করিম [ﷺ] খন্দক খননে অংশগ্রহনকারী সাহাবীদের মধ্যে ঘোষণা করে দিলেন- হে খন্দকবাসী! জাবের খানা তৈরী করেছে। তোমরা সকলে শীঘ্র করে খানা খেতে চলো। এ যেন হযরত জাবেরর (رضي الله عنه) মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত! তাঁর মনের অবস্থা লক্ষ্য করে নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করলেন- “আমি না যাওয়া পযর্ন্ত চুলার গোস্ত নামাবে না এবং খামিরা দিয়ে রুটীও পাকবে না।”
অতঃপর নবী করিম [ﷺ] তশরীফ নিয়ে আসলেন এবং জাবের (رضي الله عنه)-এঁর স্ত্রীকে আটার খামিরা সামনে আনার জন্য বললেন। নবী করিম [ﷺ] উক্ত সামান্য আটার খামিরে থুথু নিক্ষেপ করলেন এবং বরকতের জন্য দোয়া করলেন। এরঃপর গোস্তের ডেকচির দিকে অগ্রসর হয়ে তাতেও পবিত্র থুথু নিক্ষেপ করে বরকতের জন্য দোয়া করলেন। এরপর এরশাদ করলেন- “হে জাবের জায়া, তুমি রুটি প্রস্তুতকারিণী মহিলাদেরকে ডেকে আনো। তারা তোমার সাথে রুটি বানাবে -আর গোস্তের পাতলের মুখ ঢেকে রাখবে এবং উনুনের উপর থেকে ডেকচি নামাবেনা।”
তাই করা হলো। নবী করিম [ﷺ] ডেকচির নিকটে গিয়ে বসলেন এবং উনুন থেকে গোস্ত বন্টন করতে লাগলেন। দলে দলে সাহবীগণ আসতে লাগলেন এবং গোস্ত ও রুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন। হযরত জাবের (رضي الله عنه) বলেন, “সাহবীগণের সংখ্যা ছিল এক হাজার। সবার খানা সমাপ্ত হয়ে গেলো। কিন্তু আমারদের ডেকচির গোস্ত তখনো উনুনে টগবগ করছিল এবং রুটিও অনুরূপ রয়ে গেলো। (বুখারী ও মুসলিম এতোটুকু রেয়ায়েত করে ক্ষান্ত হয়েছেন।)
(গ) হযরত জাবেরের ২ ছেলে ও যবেহকৃত ছাগলকে জীবিত করাঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে নাঈমী, যিকরে যামিল ও “ ইসলাম প্রসঙ্গে” কৃত ডঃ মুহাম্মদ শহীদউল্লাহ, প্রভৃতি গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য সহী হাদীসগ্রন্থ হতে এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তা হলো-
হযরত জাবের (رضي الله عنه) ভেড়া যবেহ করে যখন নবী করিম [ﷺ]-কে দাওয়াত করতে গেলেন- এসময়ে হযরত জাবেরের দুই ছেলে ভেড়া যবাইর নকল করতে গিয়ে একজন ছুরিতে যবাই হলো, অন্যজন মায়ের ভয়ে ঘরের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে শহীদ হলো। ধৈর্যশীল মা উভয় সন্তানকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন। এমনকি- স্বামীকেও এ সংবাদ জানালেন না- পাছে স্বামী অধৈর্য্য হয়ে পড়েন এবং নবী করিম [ﷺ] দাওয়াতে না আসেন।
আল্লাহর কুদরত! সকলকে খানা খাওয়ানোর পর নবী করিম [ﷺ] জাবেরকে নিয়ে খানা খেতে বসলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি হাত গুটিয়ে নিয়ে বললেন, তোমার ছেলেরা কোথায়? তাদেরকে নিয়ে এসো। হযরত জাবের ঘরের ভিতরে গিয়ে সব ঘটনা দেখলেন এবং এসে বললেন- তারা ঘুমিয়ে আছে। নবী করিম [ﷺ] তাদেরকে খানায় শরীক করার জন্য ডেকে আনতে বললেন। এবার জাবের (رضي الله عنه) কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং সব ঘটনা খুলে বললেন। অতঃপর নবী করিম [ﷺ] নিজে ছেলেদের শিয়রে গিয়ে ডাক দিতেই তারা জীবিত হয়ে নবীজিকে সালাম করলেন এবং খানায় শরিক হলেন (মাদারেজুন্নবুয়াত ও মাজমুউল ফতেয়া ২য় খন্ড)।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো আশ্চর্যজনক! খাওয়া শেষে নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করলেন, হে জাবের দেখো- ডেকচিতে কি আছে? হযরত জাবের (رضي الله عنه) বললেন - গোস্ত এবং হাড্ডি। নবী করিম [ﷺ] হাড্ডিগোলো নামিয়ে এক জায়গায় রাখতে বললেন এবং তাতে ফুঁক দিলেন। সাথে সাথে একটি ভেড়া জিন্দা হয়ে কান ঝাড়তে লাগলো। নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করলেন, “হে জাবের! তোমার ভেড়া ও আটা তুমি নিয়ে যাও।” (যিকরে জামিল ও শানে হাবীব)
শিক্ষাঃ এ ঘটনায় শিক্ষাণীয় বিষয় হচ্ছে- সামন্য খাদ্য এক হাজার লোকে খেলেন। তারপরও খানা ‘যথা পূর্ব তথা পরং’ রয়ে গেলো। এই বাড়তি গোস্ত, পানি, সুরয়া, ঝোল, তৈল ও ঘি-মসল্লা কোথা থেকে আসলো? জবাব হলো - নবী করিম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা গায়েবী ধন -ভান্ডারের মালিক বানিয়েছেন- যার প্রমাণ হাদীসে এসেছে এভাবে -“আমাকে জিব্রাইল (عليه السلام) এসে ধন-ভান্ডারের চাবিসমূহ প্রদান করেছেন।” (হাদীস অবলম্বনে - সালতানাতে মোস্তফা)। হযুর পুরনূর (رضي الله عنه)-এঁর থুথু মোবারকেই এত গুপ্তধন ও নেয়ামত নিহিত রয়েছে। অন্যান্য অঙ্গে যে কত নিয়ামত লুকায়িত আছে - তা আল্লাহই ভাল জানেন। হাদীসে উল্লেখ আছে- একদিন সালাতুল খুসুফ (চন্দ্র গ্রহণের নামায) আদায় করার সময় নবী করিম [ﷺ] দু’হাত উপরের দিকে তুলে কি যেন ধরলেন - আবার ছেড়ে দিলেন। নামায শেষে সাহাবায়ে কেরাম কারণ জিঞ্জেস করলেন। নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করলেন-
“বেহেস্ত আমার নিকটে এসেছিল। আমি দু’হাত বাড়িয়ে বেহেস্তের আঙ্গুরের একটি খোসা হাতে ধরলাম। কিন্তু পরকালে এগুলো দিয়ে বেহেস্তীদের খানা দেয়া হবে। তাই পুনরায় ছেড়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! তোমরা কেয়ামত পযর্ন্ত আমার দু’হাতের ঐ খোসা খেলেও তা শেষে হতো না।” হাদিসে এমন আরও বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
(ঘ) রাসুলের দোয়ায় তীব্র বায়ু প্রবাহিত ও শত্রুশিবির লন্ডভন্ডঃ
খন্দক খনন সমাপ্ত হওয়ার পর নবী করিম [ﷺ] তিন হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে শহরের ভিতরে আত্মরক্ষামূলক লাইনে দাঁড়ালেন। কোরাইশগণ তাদের মিত্র বাহিনী - ইহুদী, গাতফান, বনু কেনানা, তিহামা ও নজদবাসীসহ দশ হাজার সৈন্য নিয়ে ঝড়ের বেগে ওহোদের দিক দিয়ে এসে মদিনা ঘেরাও করে ফেললো। তারা সামনে খন্দক বা খাল দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এর পূর্বে তারা এই নব-রণকৌশলের সাথে পরিচিত ছিলনা। খন্দকের দু’দিকে মুসলমান ও কাফেরগণ মুখোমখী দাঁড়ালো। মুহাজিরদের নেতা হলেন রাসুল [ﷺ]-এঁর পালিত পুত্র যায়েদ ইবনে হারিছা এবং আনসারদের নেতা হলেন সাআদ ইবনে ওবাদা। অপর দিকে মদিনার ইহুদী সম্প্রদায় বনু কোরায়যা চুক্তি ভঙ্গ করে কোরাইশদের সাথে যোগ দিল। মদিনার মোনাফেকরা মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার কাজে লেগে গেলো। এতদসত্বেও আল্লাহর হাবীব [ﷺ] দৃঢ়ভাবে শত্রুর মোকাবেলা করলেন। শত্রুরা মুসলমানদেরকে অবরোধ করে রাখল-কিন্তু যুদ্ধ হলো না। মাঝে মাঝে কিছু তীর বিনিময় হতো।
একবার কাফেরগণ খালের একটি সংকীর্ণ স্থান দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে লম্প দিয়ে পার হয়ে আসে। অমনি হযরত আলী (رضي الله عنه) ও যোবাইর (رضي الله عنه) অগ্রসর হয়ে আমর ও নওফেল নামে দুই কাফেরকে খতম করে ফেললেন। আবশিষ্টরা পলায়ন করে চলে যায়। এই তীর বিনিময়ের সময় আনসার সর্দার হযরত ছাআদ ইবনে মোয়ায (رضي الله عنه) শত্রুর তীরে আঘাত প্রাপ্ত হন এবং কিছুদিন পর জখম থেকে রক্তক্ষরণের ফলে শাহাদত বরণ করেন। তার জানাযায় ৭০ হাজার ফেরেশতা যোগদান করেছিলো।
দীর্ঘ ১৫ দিন পর্যন্ত কাফেরদের অবরোধ চলতে থাকে। এতে মুসলমানদের মধ্যে ভয়-বিহবলতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় নবী করিম [ﷺ] কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট এভাবে দোয়া করেন। “হে আল্লাহ, হে কোরআন অবতীর্ণকারী, হে দ্রুত ফয়সালাকারী, তুমি এই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাভুত করো, হে আল্লাহ! তুমি তাদের পরাভূত করো। তাদের পদলঙ্খলন ঘটাও” (বোখারী)। অন্য রেওয়ায়াত মতে হুযুর [ﷺ] এই দোয়াও করেছিলেন- “হে পেরেশান হৃদয়ের আকৃতি শ্রবণকারী, তুমি আমার পেরেশানী ও চিন্তা দূর করো। তুমি তো দেখছো- আমাদের উপর কি আপদ নাযিল হয়েছে!”
এই দোয়ার সাথে সাথে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) এসে সু-সংবাদ দিলেন- আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর তীব্র বায়ূ প্রবাহিত করবেন এবং গোপন সৈন্য পাঠাবেন। নবী করিম [ﷺ] সাহাবায়ে কেরামকে এ সু-সংবাদ দিয়ে হাত তুলে- মুনাজাত করলেন এবং ‘শুকরান শুকরান’ বলতে লাগলেন। ঐ রাত্রেই প্রবল ঝঞ্জাবায়ূ প্রবাহিত হলো। ঝড় কুরাইশদের তাবু উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বৃষ্টি আর শীতে তারা বেদিশা হয়ে পড়লো। তারা মুসলমাদের দিক থেকে অস্ত্রের ঝনঝনানী আওয়ায ও তকবীর ধ্বনী শুনতে পেলো। এটা ছিল ফেরেশতাদের আওয়াজ। কোরাইশ বাহিনী প্রচুর মালপত্র ও যুদ্ধ সামগ্রী ফেলে রাত্রের মধ্যেই পলায়ন করলো। নবী করিম [ﷺ]-এঁর দোয়ার বরকতে শত্রুসৈন্য পরাজিত হলো। যিলক্কদ মাসের ৭ দিন বাকী থাকতে তিনি খন্দক থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ভবিষৎবানী করলেন- “এ বৎসরের পর হতে কোরাইশরা তোমাদের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করতে সাহস করবে না।” এটা নবী করিম [ﷺ]-এঁর স্পষ্ট ইলমে গায়েব এবং নবুয়তের দলীল।
৬ষ্ঠ হিজরী সন থেকে মুসলমানগণই কাফের-কোরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন। হোদায়বিয়া, ফতেহ মক্কা, হোনাইন, হাওয়াজেন যুদ্ধ- প্রভৃতি এরই স্বাক্ষ্য বহন করে। ফলকথা- খন্দকের যুদ্ধে নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েব, গুপ্ত ধন-ভান্ডারের মালিকানা, মৃতকে জীবিত করার এখতিয়ার, স্বল্প খাদ্যের মধ্যে বরকতের প্রস্রবণ সৃষ্টি, দোয়ার বরকতে শত্রু বাহিনীর পরাজয় এবং পরাক্রমশালী পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের পতনের ভবিষৎবানী- যা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল – এতগুলো মো’জেযা প্রকাশিত হয়েছিল। ইসলামরে মৌলিক আক্বিদা ও বিশ্বাসের উজ্জ্বল প্রমাণ এসব ঘটনা।