কি আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে তাওয়াস্সুল, উসিলা বা মাধ্যম জায়েজ?
শিয়া ও আহলে সুন্নত এ দুই সম্প্রদায়ের মূল গ্রন্থসমূহে কোরান করিমের আয়াত ও নবী করিম (সা.) এর রেওয়ায়েতের প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদের বিশেষ করে নবী করিমকে (সা.) তাওয়াস্সুল বা উসিলা (মাধ্যম) করার বিষয়টি জায়েয বা বৈধ বলে প্রমাণ করে।
তাওয়াস্সুলের জাওয়ায বা বৈধতার বিষয়ে আলোচনা করলে মনে একটি প্রশ্নই জেগে ওঠে যে, কারা এবং কোন্ বিষয়ে নবীদের (আ.) ও হযরত মোহাম্মাদ (সা.) ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদের তাওয়াস্সুল বা উসিলা করাকে অস্বীকার করেছেন এবং এ সম্পর্কে তাদের দলিল প্রমাণই বা কি ?
যে কোন অবস্থাতে (পৃথিবী সৃষ্টির পূর্ব থেকে ও তাদের জীবনে এবং তাদের মৃত্যুর পরে) আম্বিয়ায়ে কেরামদের বিশেষ করে নবী করিমকে (সা.) তাওয়াস্সুল বা উসিলা করা হচ্ছে বৈধ। এখানে যে সব ভুল ধারণা ও প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়, তা আসলে ঠিক নয়, কেননা আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদেরকে খোদার কাছে মাধ্যম ও উসিলা করা শিরকও নয় বিদআতও নয়। এই পবিত্র ব্যক্তিগণ তাদের জীবিত কালের মত মৃত্যুর পরও আল্লাহর অনুমতিক্রমে মানুষের প্রয়োজন মিটাতে এবং শাফায়াত করার সামর্থ্য রাখেন।
ইতিহাস সাক্ষী যে, আল্লাহর দরবারে আন্বিয়া ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদেরকে উসিলা ও মাধ্যম করার বৈধতা একটি ব্যবহারযোগ্য বিষয় ছিল এবং ঐশী বাণী বহনকারী এবং তাদের প্রকৃত অনুসারীদের কখনই তা থেকে বারণ করা হয়নি। আর যদি যুগের সাথে সাথে কুসংস্কারের ধুলোতে তার রূপ পাল্টে গিয়ে থাকে তাহলে প্রকৃত ধর্মের সমর্থক বা অনুসারীরা যতদিন সম্ভব এই ধুলো পরিষ্কার করেছেন।
ইসলামের প্রথম থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যেও আম্বিয়ায়ে কেরাম বিশেষ করে নবী করিমকে (সা.) উসিলা বা মাধ্যম করার প্রতি কোন সন্দেহ ছিল না। সকল ইসলামি ফেরকা ও মাযহাবসমূহ তাতে বিশ্বাস করতো। সপ্তম শতাব্দীর পর কিছু লোক ভুল ধারণা উপস্থাপন করে, যার কারণে শেষ শতাব্দীতে এসে মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ ফেরকার সৃষ্টি হয়। তাই আজ যখন, কিছু কিছু বিষয়ের বৈধতা নিয়ে আলোচনা হয়, আসল কথা সেই ফেরকার লোকদেরই হয়, যারা এ বিষয়কে অবৈধ বলে বিশ্বাস ও পীড়াপীড়ি করে এবং যারা বৈধ ও জায়েয মনে করে তাদেরকে কাফের ও মুশরিক বলে নিন্দা করে।
এ প্রবন্ধতে আমরা সংক্ষেপে আহলে সুন্নত(১) ওলামাদের দৃষ্টিতে উসিলা বা মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করবো। যাতে বুঝা যায় যে, তাদের (তাওয়াস্সুলের অস্বীকারকারী) উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শিয়ারাই নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের বেশিরভাগ অংশ। আর তাদের ধারণায় যদি তাওয়াস্সুল ও উসিলার বিশ্বাসকারী কাফের বা মুশরিক হয়ে থাকে তাহলে সকল ইসলামি ফেরকাসমূহরাই এর অন্তরভুক্ত।
তাওয়াস্সুলের অর্থ
ক) আভিধানিক অর্থে তাওয়াস্সুল
« و يقال: توسّل فلان الي فلان بوسيلة، ای تسبّب اليه بسبب و تقّرب اليه بحرمة آصرة تَعطِفُه(تُعطِفه)عليه ».
বলা হয়ে থাকে যে, ওমুক ব্যক্তি ওমুক লোকের সাথে উসিলার মাধ্যমে নৈকট্য হাসিল করেছে, অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে নৈকট্য হাসিরের জন্য মাধ্যম করেছে। সেই উসিলার বিশেষতটা হচ্ছে যার জন্য উসিলা করা হয়েছে তার কাছে এ লোকটির সম্মান রয়েছে। তাই তাওয়াস্সুলকারীর প্রতি তার ভালবাসা হয়েছে। (আযহারি, প্রকাশ কাল: ১৪২২ হিজরী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮৯২)।
উসিলার অর্থ হচ্ছে কোন বস্তুকে মাধ্যম করা যা আগ্রহ ও ইচ্ছার সাথে হয়। (রাগেব ইসফাহানী, পৃষ্ঠা: ৫২৩ - ৫২৪)। উসিলার অর্থ হচ্ছে যা একজনকে অন্যজনের কাছাকাছি করার কারণ হয়। (আমিদ, প্রকাশ কাল: ১৩৬০ হিজরী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৯৫০)।
খ) পারিভাষিক অর্থে তাওয়াস্সুল
উসিলা এমন এক জিনিস যার মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্যে পৌঁছানো যায়। (ইবনে কাসির, প্রকাশ কাল: ১৩৭৯ ফারসি সাল, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৫৬৩)। কুরতুবি উসিলাকে সান্নিধ্য ও নৈকট্যের অর্থে ব্যবহার করেছে যার মাধ্যমে কোন বিষয় হাসিল করার উপযুক্ত হয়। (কুরতুবি, প্রকাশ কাল: ১৪০৫ হিজরী, ৬ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৯)। যামাখশারি বলেছে, যা কিছু সান্নিধ্য ও নৈকট্য হাসিল করার কারণ হয়, সেটা আত্মীয়তা হোক কিম্বা অন্য কিছু তাকে উসিলা বলা হয়। যার মাধ্যমে যে কোন কিছুর জন্য খোদার কাছে তাওয়াস্সুল করা হয়। (যামাখশারি, প্রকাশ কাল: ১৪২১ হিজরী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৬৬২)। মোট কথা উসিলার অর্থ ব্যাপক যা অনেক বিষয়কেই শামিল করবে।
তাওয়াস্সুলের বৈধতার পক্ষে মশহুর দলিল প্রমাণ
তাওয়াস্সুলের বৈধতা সেই ইসলামের প্রথম থেকেই বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে মুসলমানদের মধ্যে একটি গ্রহনীয় বিষয় ছিল। সামহুদি বলেন: “আল্লাহর দরবারে নবী করিমের কাছে তাওয়াস্সুল, ইসতেগাসা বা সাহায্য প্রর্থনা ও শাফায়াত চাওয়া বৈধ বরং উত্তম কাজ। যে কোন ধর্মভীরু এ কাজকে সুনিশ্চিত বৈধ মনে করে এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম, সালেহ বান্দা ও ইসলামের ওলামায়ে কেরামদের সীরাহ তার প্রকাশ্য প্রমাণ। সপ্তম সতাব্দী পর্যন্ত কোন দ্বীনদার ব্যক্তিই তাওয়াস্সুলের বৈধতাকে অস্বীকার করেনি। কমপক্ষে আমাদের চোখে ধরা পড়েনি”। (সামহুদি, প্রকাশ কাল: ১৩৭১ ফারসি সাল, ৩-৪ খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৩৭১)।
১। বুদ্ধিবিত্তিক প্রমাণ
বুদ্ধি ও আকলের দিক থেকে তাওয়াস্সুল হচ্ছে একটি বৈধ বিষয়, যখন কোন মানুষ অবাধ্যতার কারণে তার মালিকের দৃষ্টিতে তার প্রতি মনোযোগ কম হয়ে যায়, এমন কোন ব্যক্তি যে তার মালিকের কাছে বন্ধু ও সম্মানিত তাকে মাধ্যম করে নেয়; আর এ কাজটি আকল বিরোধী নয়, বরং মালিক সেই মাধ্যমের মদ্যস্থতার কারণে তার অধীনস্থের অবহেলাকে ক্ষমা করে দেয়। কারণ শেষ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার হিকমত, বুযুর্গি ও ক্ষমতার জন্য তার অভাবী, মুখাপেক্ষী ও শাস্তিযোগ্য বান্দাকে তার নবীদের ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদের কাছে তাওয়াস্সুল করার কারণে সেই ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ দেবে এবং তার ইচ্ছা পূরণ করবে এবং তার অবহেলা ও দোষকে ক্ষমা করে দেবে। একটি কথা মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, আমাদের এই কথা সে স্থানের জন্য যেখানে তাওয়াস্সুল উবুদিয়্যাত ও দাসত্ব এবং ইখলাসের সাথে সংমিশ্রণ যাতে না হয়ে যায়।
২। কোরানের আয়াতসমূহ
মানুষদের জন্য খোদার ঐশী বাণী হিসেবে পবিত্র কোরান তাওয়াস্সুলকে বারণ তো করেইনি বরং তার বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তাওয়াস্সুলের বৈধতাকে প্রমাণ করা যেতে পারে। দুই সম্প্রদায়ের (শিয়া ও সুন্নি) মূল গ্রন্থসমূহের ভিত্তিতে ওলামা ও চিন্তাবিদগণ বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তাওয়াস্সুলের বৈধতা সম্পর্কে যুক্তি প্রমাণ দিয়েছেন, যা এখানে আয়াতের ব্যাখ্যায় উদাহরণস্বরূপ সংক্ষেপে আহলে সুন্নতের কিছু কথা আমরা উল্লেখ করবো:
১। সুরা মায়েদার ৩৫ নম্বর আয়াতে এসেছে:
« يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَ ابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَ جاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ».
হে ! তোমরা যারা ঈমান এনেছ (মুমিনগণ) তাকওয়াধারী হও এবং আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে উসিলা বা মাধ্যম গ্রহণ করো। আর খোদার পথে জিহাদ করো হয়তো তোমরা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে যেতে পারো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতে মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন:
ক) আল্লাহর তাকওয়া অর্জন;
খ) প্রভুর নৈকট্য অর্জনের জন্য উসিলা নির্ধারণ;
গ) খোদার পথে জিহাদ করা।
অতএব, মানুষ যা কিছুর মাধ্যমে খোদা পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তার নৈকট্য হাসিল করে, যেমন: ভাল কাজ বা আমালে সালেহ ও দোয়া ইত্যাদিকে উসিলা বা মাধ্যম বলা হয়ে থাকে। (ফারনাতি, প্রকাশ কাল: ১৪১৬ হিজরী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৪১)।
যদিও আহলে সুন্নতের বেশিভাগ মুফাস্সিরগণ উসিলাকে আনুগত্যের কাজ করা (ফেলুত তা’আ) ও পাপ কাজ বর্জন করার প্রতিই বলেছেন অথবা কোন শর্ত ছাড়াই উল্লেখ করেছেন (كلّ ما يتوسّل به...), আর নবী করিমের (সা.) তাওয়াস্সুল করাকে আয়াতে দৃষ্টান্ত হিসেবে না বারণ করেছেন আর নাইবা বৈধতার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আয়াতে উসিলা কোন শর্ত ছাড়াই এসেছে, যেভাবে আমালে সালেহ বা ভাল কাজকে শামিল করবে, দোয়া ও আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে ইলাহিদেরকে ও কোন পবিত্র স্থানকে মাধ্যম করাকেও শামিল করবে। আর যা কিছু মানুষকে খোদার কাছাকাছি নিয়ে যায় (অর্থাৎ পারিভাষিক অর্থে) তাকেও শামিল করবে। যামাখশারির পূর্বের কথা ও ফাখরে রাযির কথা হচ্ছে এরূপ:
« فالوسيلة هي التي يتوسّل بها الي المقصود ».
প্রত্যেকটি জিনিসই হচ্ছে উসিলা যার মাধ্যমে নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সব বিষয়কেই শামিল করবে। (ফাখরে রাযি, ১১তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৯)।
যদি আল্লাহর কাছে উসিলা করাটা শিরকের কারণ হত, তাহলে কখনই খোদা সেটাকে মুক্তি ও পরিত্রাণের উপাদান করতো না এবং তার জন্য হুকুম করতো না।
খোদার নৈকট্য হাসিল করার জন্য উসিলার নির্ধারণের হুকুম বিশেষ কোন দলের জন্য নয়, অনেকে নিজেদের পাপের মার্জনার খাতিরে, আবার অনেকে আত্মিক ও বস্তুবাদী প্রয়োজনীয়তার খাতিরে আর কিছু লোকের সফলতার পথ অতিক্রম করার জন্য ও পূর্ণতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে উসিলার প্রয়োজন।
ভুলে গেলে চলবে না যে, উসিলা হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য। আর এটা তখনই সত্য বলে প্রমাণিত হবে যখন স্বয়ং নিজেই আল্লাহর কাছে ঘনিষ্ঠ হবে; যদি উসিলা আল্লাহর দরবারে পরিচিত না হয় অথবা তার অপছন্দনীয় হয় এমতাবস্থায় তাওয়াস্সুল অর্জন হবে না।
২। সুরা নেসার ৬৪ নম্বর আয়াতে এসেছে:
« وَ ما أَرْسَلْنا مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ لِيُطاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَ لَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جاؤُكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَ اسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّاباً رَحِيماً ».
আমরা কোন নবীকেই প্রেরণ করিনি, শুধুমাত্র এই জন্য যে, তার হুকুমে তার আনুগত্যতা করা হোক, আর যদি এই বিরোধী লোকেরা যখন নিজের উপর অত্যচার করছিল তোমার কাছে আসতো এবং খোদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো আর নবী করিমও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতেন তখন তারা খোদাকে তাওবা গ্রহণকারী ও মেহেরবান পেতো।
এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইবনে কাসির বর্ণনা করে: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পাপী বান্দাদেরকে ইরশাদ করছেন যে, নবী করিমকে (সা.) যেন তারা খোদার দরবারে উসিলা করে নেন এবং নিজেও ক্ষমা প্রার্থনা করুক এবং নবী করিমকেও (সা.) আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য মাগফেরাত চাওয়ার জন্য বলুক। এমতাবস্থায় আল্লাহর রহমতে শামিল হতে পারবে, তাদের তাওবাও কবুল করা হবে। অতঃপর (ইবনে কাসির) উদাহরণস্বরূপ নবীর (সা.) কবরে একজন আরব লোকের তাওয়াস্সুলের ঘটনা ও খোদার ক্ষমার বর্ণনা করে। (ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা: ৩২৮ - ৩২৯)।
কুরতুবি হযরত আলী (আ.) হতে অনুরূপ একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেন:
« روي ابو صادق (الازدي الكوفي) عن علي (ر) قال: قدم علينا اعرابيّ بعد ما دفّنّا رسول اللهبثلاثة ايّام، فرمي بنفسه علي قبر رسولالله و حث علي رأسه من ترابه، فقال: يا رسولالله فسمعنا قولك، و وعيت عن الله فوعينا عنك وكان فيما انزل الله « و لو انّهم اذ ظلموا انفسهم...» و قد ظلمت نفسي و جئتك تستغفرلي، فنودي من القبر انّه قد غفر لك ».
আবু সাদেক আযদি হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করে যে, একজন আরব লোক রাসুলুল্লাহর (সা.) দাফনের তিন দিন পর নিজেক তাঁর কবরের উপর ফেলে দিয়ে তার ধুলো মাটি নিয়ে নিজের মাথায় ঢালছিল আর বলছিল: হে ! আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনার বাণী শুনেছি, আমরা আপনার কাছে চাচ্ছি আর আপনি খোদার কাছে চান । যে আয়াত আপনার উপর অবতীর্ণ হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, “যদি আমার কোন বান্দা নিজের উপর যুলুম অত্যাচার করে, তারা তোমার কাছে আসবে তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও তাদের তাওবা কবুল করবেন”, আমি নিজের উপর যুলুম করেছি, এখন এসেছি যাতে আপনি আমার জন্য খোদার দরবারে মাগফেরাত ও ক্ষমা কামনা করেন; অতঃপর নবী করিমের (সা.) কবর থেকে আওয়াজ এলো যে, তোমার মার্জনা হয়েছে। (কুরতুবি, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৬৫)।
এই হাদীস হতে আমরা বুঝতে পারি যে, আরব লোকটি কোরানের আয়াতকে ধারণ করার মাধ্যমে নবী করিমকে (সা.) উসিলা করলো এবং খোদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো আর এই তাওয়াস্সুল ফল দিলো এবং সে লোকটিকে আল্লাহ ক্ষমা করলেন।
যখন কোন পাপী ও প্রয়োজনীয় ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের (সা.) দারস্থ হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তখন তার বান্দার জন্য তাঁর শাফাআতকে ফিরিয়ে দেন না।
ফাখরে রাযি বর্ণনা করে:
« و انّهم اذا جائوه فقد جائوا من خصّه الله برسالته و اكرمه بوحيه و جعله سفيرا بينه و بين خلقه و من كان كذلك فانّ الله لا يرد شفاعته ».
যখন কোন প্রয়োজনীয় ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের (সা.) দারস্থ হয়, এমন লোকের দরজায় এসেছে যে, খোদা নিজেই তাঁকে নবী হিসেবে নির্ধরণ করেন এবং ঐশী বাণীর মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং নিজের ও বান্দাদের মাঝখানে দূত বানিয়েছে; আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ সকল ব্যক্তিদের শাফাআতকে ফিরিয়ে দেন না।
৩। সুরা বাকারার ৩৭ নম্বর আয়াতে এসেছে:
« فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِماتٍ فَتابَ عَلَيْهِ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ ».
অতঃপর আদম (আ.) নিজের প্রভুর কাছে কিছু শব্দাবলীর শিক্ষা নেন এবং তার মাধ্যমে তাওবা করেন এবং খোদা তার তাওবাকে কবুল করলেন, কেননা আল্লাহ রাব্বুর আলামিন তাওবা গ্রহণকারী ও মেহেরবান।
যখন হযরত আদম (আ.) আল্লাহর ইরশাদি হুকুমের বিরোধীতা করে অনুতপ্ত হলেন এবং আউলিয়ার স্থানে শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, খোদার দরবারে উসিলা করার জন্য কাউকে খুঁজছিলেন, তখন খোদা তাঁকে কিছু শব্দের শিক্ষা দান করলেন, যাতে করে তাকে তাওয়াস্সুল করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে পারেন। (দ্রষ্টব্য: আল মো’জামুল আকায়েদি, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৮৭)।
«كلمات» শব্দের জন্য বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসুলের (সা.) উপস্থিতি।
« و قالت طائفة: رأي مكتوبا علي ساق العرش (محمد رسول الله) فتشفّع بذلك ».
হযরত আদম (আ.) যখন উসিলা খুঁজছিলেন তখন আরশে হযরত নবী করিমের (সা.) পবিত্র নাম দেখতে পান, অতঃপর তাঁকে খোদার দরবারে শাফাআতকারী নির্দিষ্ট করেন। (কুরতুবি, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৪)।
আলুসি তফসির বর্ণনা করার পর উল্লেখ করে:
« و اذا اطلقت الكلمة علي عيسي فلتطلق الكلمات علي الروح الاعظم و الحبيب الاكرمفما عيسي بل و ما موسي (و ما. . . ) الاّ بعض من ظهور انواره و زهرة من رياض انواره ... ».
অর্থাৎ যখন শব্দটি হযরত ঈসা নবীর (সা.) ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা হবে অবশ্যই শব্দটি হযরত নবী করিমকেও (সা.) শামিল করবে, কেননা অন্যান্য নবীগণ রাসুলে আকরমের (সা.) নুরের একটি অংশ মাত্র। (আলুসি, ১ম ও ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৩৭)।
বর্ণনাকৃত আয়াতসমূহের ও তাদের তফসিরের পরিপ্রেক্ষিতে (এবং বাকি যে সকল আয়াত সংক্ষিপ্ততার কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে) নবী করিমকে (সা.) তাঁর শারীরিক প্রকাশের পূর্বে, তাঁর জীবনে ও মৃত্যুর পর তাওয়াস্সুল করা বৈধ ও জায়েয। আর তাওয়াস্সুলের বৈধতা ও জায়েয হওয়ার ব্যাপারে তাঁর উপস্থিতিতে কোন ধরণের পার্থক্য নেই। হাদীসেও অনুরূপ বর্ণনা করা হয়েছে।
৩। রেওয়ায়েত
লেখার বিষয়টি আমাদেরকে আহলে সুন্নতের হাদীস নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য করে। (তাই শিয়ার চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ও রেওয়ায়েত নিয়ে পর্যালোচনা করা আমাদের এই প্রবন্ধের ক্ষেত্রের বাইরে)। প্রথমে আমরা সেই হাদীসের উল্লেখ করবো যেখানে স্বয়ং নবী করিম (সা.) তাওয়াস্সুলের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী হতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি বলেন:
« كان رسول الله يقول: وسّلوا بمحبّتنا الي الله و استشفعوا بنا ».
রাসুল (সা.) বলেন: আমাদের ভালবাসার মাধ্যমে খোদার কাছে তাওয়াস্সুল কর এবং শাফাআত চাও। (হুসাইনি, ১৮তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৫২১)।
ইমাম মালেকও নবী করিমের (সা.) মাযারে মানসুর দাউয়ানেকিকে বললেন:
« هو وسيلتك و وسيلة ابيك آدم ».
হযরত মোহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন তোমার জন্য উসিলা যেরূপ তুমার পিতা হযরত আদম (আ.) এর জন্য উসিলা ছিলেন। (যাইনি দাহলান, প্রকাশ কাল: ১৩৬৪, পৃষ্ঠা: ১৫৭)।
মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের পর তার ভাই, শিফাউস সিকাম বইতে সাবকি এবং তাকে অনুসরণ করে ওয়াফাউল ওয়াফা বইতে সামহুদি প্রথম বারের মত আব্দুল ওয়াহাবের বিশ্বাস ও তার চিন্তা নিয়ে আলোচনা করেন।
সাবকি সুন্দরভাবে আলোচনা করেছে। সে যে কোন অবস্থাতে নবী করিমকে (সা.) উসিলা করাকে জায়েয বলে মনে করে। আর তাকে তিন ভাগে ভাগ করে:
ক) প্রয়োজনীয় ব্যক্তি নবী করিমকে (সা.) উসিলা করে আল্লাহর কাছে ইচ্ছা কামনা করা।
খ) প্রয়োজনকারী ব্যক্তি নিজের জন্য আল্লাহর রাসুলের (সা.) দোয়া চাওয়ার জন্য হযরত নবী করিমকে (সা.) মধ্যস্থতা বানিয়ে নেয়।
গ) তাওয়াস্সুলকারী স্বয়ং নিজেই রাসুলের (সা.) কাছে নিজেদের চাওয়া চাইবে।
- মোহাম্মদ ইব্রাহীম আখলাকি।(২)
সূত্রসমূহ:
১। আলুসি, সৈয়দ মাহমুদ, রুহুল মা’আনি, দারু এহইয়া আত তুরাস আল আরাবি, বাইরুত, ১ম খন্ড।
২। ইবনে কাসির, ইসমাঈল, তাফসির আল কোরানেল আযিম, দারুল ফিকর, বইরুত, ২য় খন্ড, প্রকাশ কাল ২য়: ১৩৬৮ ফারসি সাল।
৩। আযহারি, মোহাম্মদ বিন আহমাদ, মু’জামুত তাহযিবুল লোগাত, দারুল মারেফা, বইরুত, ৪র্থ খন্ড, প্রকাশ কাল প্রথম: ১৪২২ হিজরী।
৪। হুসাইনি, সৈয়দ নুরুল্লা, এহকাকুল হক, মাকতাবাতু আয়াতুল্লাহ মার’আশি, ১৮তম খন্ড।
৫। রাযি, মোহাম্মদ বিন ওমর (ফাখরুদ্দিন), আত তাফসিরুল কাবির, আল মাকতাবাতুত তাউফিকিয়্যাহ, কাহেরা, ১১তম খন্ড।
৬। যামাখশারি, মাহমুদ বিন ওমর, আল কাশ্শাফ আন হাকায়েকেত তানযিল, দারু এহইয়া আত তুরাস আল আরাবি, বইরুত, প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২১ হিজরী।
৭। যাইনি দাহালান, সৈয়দ আহমাদ, আদ দুরারুস সুন্নিয়্যা, আইনে ওয়াবিয়্যাতের বর্ণনাতে, জাফর সুবহানি, ইনতেশারাতে ইসলামি, কোম, ১৩৬৪ ফারসি সাল।
৮। সাবকি, তাকিউদ্দিন আস সাবকি, শিফাউস সিকাম, আল মুজামুল আকায়েদি।
৯। সামহুদি, আলী বিন আহমাদ, ওয়াফাউল ওয়াফা, দারু এহইয়া আত তুরাস আল আরাবি, বইরুত, ৩ - ৪ খন্ড, ৪র্থ প্রকাশ, প্রকাশ কাল:১৩৭১ ফারসি সাল।
১০। আমিদ, হাসান, ফারহাঙ্গে আমিদ, আমির কাবির, তেহরান, ১ম খন্ড, ৩য় সংস্করণ, ১৩৬০ হিজরী।
১১। ফারনাতি, মোহাম্মদ বিন আহমাদ বিন জাযি, আত তাসহিল লি উলুমিত তানযিল, দারুল আরকাম, বইরুত, ১ম খন্ড, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৬ হিজরী।
১২। কুরতুবি, মোহাম্মদ বিন আহমাদ, আল জামে লি এহকামিল কোরান, দারু এহইয়া আত তুরাস আল আরাবি, বইরুত, ৫ম ও ৬ষ্ঠ খন্ড, ১৪০৫ ফারসি সাল।