★ আমাদের পরিচয় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ কেন?
সুন্নাহ ও জামাআর আনুসারী যারা তারাই ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’। তাই ‘সুন্নাহ’ ও ‘জামাআহ’ কী, বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। এখানে সংক্ষেপে উক্ত দু’টি বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
সুন্নাহ: মানে রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাজ ও মনোসম্মতির অনুসরন।
জামাহ : মানে রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাহাবীগনের, তাবেয়ীগনের ও তাবে-তাবেয়ীগনের অনুসারী।
আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ‘অনুসৃত দলীল’ আকড়ে ধরার জন্য। তাই ‘অনুসৃত দলীল’ অনসন্ধান করা আমাদের জন্য জরুরি। আল্লাহ তাআলা মানবজীবনের উন্নতি ও সফলতার জন্য পবিত্র গ্রন্থ ‘আল কুরআন’ নাযিল করেছেন। আর এর ব্যাখ্যা করে তাকে সমাজ্জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণ করেছেন রাসূল মুহাম্মদ সা.কে। আর রাসূল সা. যেসময় যে সমাজে আগমন করেন, তখন সে সমাজে বিরাজ করছিল মানবেতিহাসের সব চেয়ে খারাপ অবস্থা। সমাজের এই খারাপ ও অস্থিতিশীল অবস্থা মুহূর্তেই বদলে যায়নি। রাসূল মুহাম্মদ সা. এর প্রতি ধাপে ধাপে ওহী প্রেরণ করে আল্লাহ তাআলা সমাজকে পরিশুদ্ধ করেন। নবুওয়াতের দীর্ঘ ২৩ বছরে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে যা একটি পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা তথা ‘শরীয়াহ’র রূপ লাভ করে।
এখানে একটি লক্ষণীয়। আর তা হলো, ওহীর মাধ্যমে রাসূল সা. বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পর্যায়ক্রমে যেসব বিধান প্রবর্তন করেছেন, তার কোনোটা ছিলো সাময়িক, কোনোটা স্থায়ী। আর তা ছিলো সামাজিক প্রয়োজনেই। পরবর্তীতে রাসুল সা. সাময়িক বিধানগুলোর কোনোটা রহিত ঘোষণা করেছেন, কোনোটা আংশিক পরিবর্তিত আকারে রেখেছেন, আবার কোনোটা অপরিবর্তিত অবস্থায়ই রেখে দিয়েছেন। তাই একথা বলাই বাহুল্য যে, কিছু হাদীসের উপর সাহাবায়ে কেরামের আমল আছে আর কিছু হাদীসের উপর নেই। কিছু হাদীস অনুসৃত আর কিছু হাদীস অনুসৃত নয়। তাই প্রশ্ন হলো, ‘হাদীস’ এর বিশাল ভান্ডার থেকে ‘অনুসৃত দলীল’ হিসাবে কোন্ ধরনের ‘হাদীস’ গৃহীত হবে?
এব্যাপারে গভীর অধ্যয়নের পর জানা যায়, ‘হাদীসে’র দু’টি অবস্থা আমাদের সামনে বিদ্যমান। যার একটি ‘হাদীস’ নামেই প্রসিদ্ধ। অপরটি ‘সুন্নাহ’ হিসাবে পরিচিত। ‘হাদীসে’র বিশাল ভান্ডারের যেসবের উপর উম্মতের ‘আমল’ বিদ্যমান, তাকেই ‘সুন্নাহ’ বলে। অর্থাৎ ‘সুন্নাহ’র উপর উম্মতের ‘আমল’ রয়েছে, তাই ‘অনুসৃত দলীল’ হিসাবে এই ‘সুন্নাহ’-ই নির্ধারিত, ‘হাদীস’ নয়।
বিষয়টি দলীল-প্রমাণের সাহায্যে স্পষ্ট করার প্রয়াস পাবো।
★ ‘সুন্নাহ’কে ‘অনুসৃত দলীল’ বলার কারণ দু’টি। যথা-
ইসলাম মুসলমানদের একমাত্র জীবনাদর্শ। তাই ইসলামী শরীয়তকে জীবনের সর্বোত্র বাসত্মবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে অসংখ্য হাদীসে। আর হাদীসে যেখানেই এই তাগিদ দেয়া হয়েছে, সেখানেই ‘সুন্নাহ’র কথা বলা হয়েছে, হাদীস নয়।
★ রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন,
من رغب عن سنتى فليس منى ـ رواه البخارى عن أنس بن مالك : ২/৭৫৭
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, সে আমার দলভূক্ত নয়। (বুখারী: ২/৭৫৭)
عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ ـ رواه ابوداؤد عن العرباض بن ساريةصـ ২/৬৩৫, والترمذى وابن ماجه واحمد
অর্থ: তোমরা আমার সুন্নাহের এবং হেদায়াত ও সুপথপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাহের অনুসরণ করো এবং তা সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরো। (আবু দাউদ: ২/৬৩৫, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: تركت فيكم أمرين لن تضلوا ماتمسكتم بهما- كتاب الله وسنة نبيه ـ رواه مالك صـ ৩৬৩
অর্থ: নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন- আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত এদুটিকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; – আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।- মুয়াত্তা ইমাম মালিক: ৩৬৩
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال العلم ثلاثة أية محكمة، وسنة قائمة ، وفريضة عادلة.أخرجه إبن ماجه فى سننه عن عبد الله بن عمرو صـ৬
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ইলম তিন প্রকার- আয়াতে মুহকামা, সুন্নাতে কায়েমা ও ফারিযায়ে আদেলা।
উপরে চারটি ‘হাদীস’ পেশ করা হয়েছে। প্রতিটি ‘হাদীসে’ ‘শরীয়তে ইসলাম’ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার প্রতি ‘উম্মত’কে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয়, প্রতিটি ‘হাদীসে’ ‘‘সুন্নাহ’’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে, ‘হাদীস’ নয়। তাই কোনো বিষয়ে কোনো ‘হাদীস’ পাওয়া গেলেই তা নির্দ্বিধায় আমলযোগ্য বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারন হতে পারে হাদিসটি রহিত হয়ে গেছে।
২. সহজের জন্য দ্বিতীয় কারণটি আলোচনার পূর্বে জানা দরকার ‘হাদীস’ কী?
হাদীসবিদগণ বিভিন্নভাবে হাদীসের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
الحديث هو أقوال النبى صلى الله عليه وسلم وأفعاله وسهوه وتقاريره وتروكه وماهمّ به ففعله أو لم يفعله وأحواله وشمائله وصفاته الخِلقية و الخُلُقية حتى الحركات والسكنات فى اليقظة والمنام سواء كان قبل البعثة أو بعدها ـ أنظر توجيه النظر ولمحات من تاريخ السنة و علوم الحديث صـ১১
অর্থ: হাদীস হল, নবী কারীম সা. এর কথা, কাজ, সাহু, সমর্থন, বর্জন এবং যা ইচ্ছা করেছেন বাস্তবে রূপান্তর করে থাকুন বা না থাকুন। তার অবস্থা, শামায়েল এবং তাঁর অবয়বগত ও চরিত্রগত গুণাবলী। এমনকি ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় নড়াচড়া এবং তা নবুওয়াতের পূর্বে হোক বা পরে।
★ শায়েখ তাহের জাযায়েরী হাদীসের সংজ্ঞায় বলেন,
الحديث ما أضيف إلى النبى صلى الله عليه وسلم من قول أو فعل أو تقرير أو ترك أو هَمٍّ أو سيرة أو حالة أو صفة خِلقية أو خُلُقية سواء كان قبل البعثة أو بعدها ـ أنظر توجيه النظر إلى أصول الآثر صـ ১/৩৭ للشيخ طاهر الجزائرى ومجموع الفتوى صـ ১৮/২-১০
অর্থ: নবী কারীম সা. এর দিকে সম্পৃক্ত কৃত কাজ, তার সমর্থন, বর্জন, ইচ্ছা, সীরাত, অবস্থা, অবয়ব ও চরিত্রগত গুণাবলী- তা নবুওয়াতের পূর্বে হোক বা পরে- তার সবই ‘হাদীস’। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: তাওযীহুন নজর ও মাজমুআতুল ফতওয়া ইবনে তাইমিয়্যা।
হাদীসের পরিচয় সংক্রান্ত হাদীস-বিশারদদের উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, হাদীসের একটি বড় ভান্ডার দখল করে আছে যেসব জিনিস তার মধ্যে রয়েছে-
ক. মানসূখ হাদীস,
খ. নবী কারীম সা. এর জন্য নির্ধারিত বিষয়াদি (যেমন, চারের অধিক বিবাহ),
গ. নবী কারীম সা. এর অবয়বগত গুণাবলী,
ঘ. নবুওয়াতের পূর্বের বিষয়াদি,
ঙ. জাল হাদীস … ইত্যাদি।
সচেতন পাঠক লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী যেসব বিষয় হাদীসের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে বা হয়ে থাকে, তার সবই ‘অনুসৃত’ নয়। তাই তা আমাদের দলীলও নয় এবং এসবের উপর আমল করাও জরুরি নয়। পক্ষান্তরে হাদীসে ইরশাদকৃত ‘সুন্নাহ’ হল, নবী কারীম সা. এর ঐসকল বিষয়াদি, যেগুলো আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য। এবং এটাই দীন ও শরীয়তের অনুসৃত পথ।
★ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ তিরমিযী শরীফে এসেছে,
২. عن عبد الله بن عمرو قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن بنى إسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وتفترق أمتى على ثلاث وسبعين ملة كلهم فى النار إلا ملة واحدة قالوا من هى يارسول الله! قال ماأنا عليه وأصحابى ـ رواه الترمذى فى أبواب العلم صـ ২/৯৩
অর্থাৎ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন, নিশ্চয় বনী ইসরাঈল বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত হয়েছে। আমার উম্মত তিহাত্তরটি দলে বিভক্ত হবে সকলেই জাহান্নামে যাবে শুধু মাত্র একটি দল ছাড়া। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? নবী কারীম সা. ইরশাদ করলেন, আমি ও আমার সাহাবারা যার উপর আছে।-তিরমিযী: ২/৯৩