❏ সাগর ও নদ-নদী

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


وَهُوَ ٱلَّذِی سَخَّرَ ٱلۡبَحۡرَ لِتَأۡكُلُوا۟ مِنۡهُ لَحۡمࣰا طَرِیࣰّا وَتَسۡتَخۡرِجُوا۟ مِنۡهُ حِلۡیَةࣰ تَلۡبَسُونَهَاۖ وَتَرَى ٱلۡفُلۡكَ مَوَاخِرَ فِیهِ وَلِتَبۡتَغُوا۟ مِن فَضۡلِهِۦ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ۝ وَأَلۡقَىٰ فِی ٱلۡأَرۡضِ رَوَ ٰ⁠سِیَ أَن تَمِیدَ بِكُمۡ وَأَنۡهَـٰرࣰا وَسُبُلࣰا لَّعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ۝ وَعَلَـٰمَـٰتࣲۚ وَبِٱلنَّجۡمِ هُمۡ یَهۡتَدُونَ ۝ أَفَمَن یَخۡلُقُ كَمَن لَّا یَخۡلُقُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ۝ وَإِن تَعُدُّوا۟ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحۡصُوهَاۤۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَغَفُورࣱ رَّحِیمࣱ


[Surat An-Nahl ১৪ - ১৮]


অর্থাৎ—তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মাছ খেতে পার এবং যাতে তা থেকে আহরণ করতে পার রত্নাবলী, যা তোমরা ভূষণরূপে পরতে পার এবং তোমরা দেখতে পাও, তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে এবং তা এ জন্য যে, তোমরা যেন তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর;


এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় এবং স্থাপন করেছেন নদ-নদী ও পথ, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছুতে পার; এবং পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহও। আর তারা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের নির্দেশ পায়।


সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তারই মত, যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু। (১৬ঃ ১৪-১৮)


وما يستوي البحران هذا عذب فرات ساءغ شرابه وهذا ملح أجاج ومن كل تأكلون لحما طريا وتستخرجون حلية تلبسونها وتر الفلك فيه مواخر لتبتغوا من فضله ولعلكم تشكرون.


অর্থাৎ—সমুদ্র দুটো একরূপ নয়- একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অপরটির পানি লোনা, খর। প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত আহার কর এবং অলংকার যা তোমরা পরিধান কর এবং রত্নাবলী আহরণ কর এবং তোমরা দেখ তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। (৩৫ঃ ১২)


وهو الذى مرج البحرين هذا عذب فرات وهذا ملح أجاج وجعل بينهما برزخا حجرا محجورا.


অর্থাৎ—তিনিই দু’দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট সুপেয় এবং অপরটি লোনা, খর; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান। (২৫ঃ ৫৩)


مرج البحرين يلتقيان بينهما برزح لا يبغيان.


অর্থাৎ তিনি প্রবাহিত করেন দু’দরিয়া, যারা পরস্পর মিলিত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (৫৫ঃ ১৯, ২০)


মোটকথা, দু’দরিয়া দ্বারা লোনা, খর দরিয়া এবং সুমিষ্ট দরিয়া বুঝানো হয়েছে। ইবন জুরায়জ প্রমুখ ইমাম বলেন, সুমিষ্ট দরিয়া হলো, সৃষ্টিকুলের স্বার্থে দেশের আনাচে-কানাচে যে সব নদ-নদী প্রবহমান রয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


ومن أياته الجوار في البحر كالأعلام إن يشأ يسكن الريح فيظلن رواكد على ظهره إن في ذالك لأيات لكل صبار شكور . أو يؤبقهن بما كبوا ويعفو عن كثير.


অর্থাৎ তার অন্যতম নিদর্শন সমুদ্রে পর্বততুল্য চলমান নৌযানসমূহ। তিনি ইচ্ছা করলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন, ফলে নৌযানসমূহ নিশ্চল হয়ে পড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠে। নিশ্চয় তাতে নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। অথবা তিনি তাদের কৃতকর্মের জন্য সেগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারেন এবং অনেককে তিনি ক্ষমাও করেন। (৪২ঃ ৩২-৩৪)


الم تر أن الفك تجري في البحر بنعمة الله ليريكم من أياته إن في ذاليك لأيات لكل صبار شكؤر. وإذا غشيهم موج كالظلل دعوا الله مخلصين له الدين فلما نجاهم إلى البر فمنهم مقتصد وما يجحد بآياتنا إلا كل ختال كفور.


অর্থাৎ—তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহর অনুগ্রহে নৌযানগুলো সমুদ্রে বিচরণ করে, যা দিয়ে তিনি তোমাদেরকে তার নিদর্শনাবলীর কিছুটা প্রদর্শন করেন। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।


যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘের ছায়ার মত, তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছান, তখন তাদের কেউ কেউ সরলপথে থাকে; কেবল বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিরাই তাঁর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে। (৩১ঃ ৩১-৩২)


إن في خلق السموت والأرض واختلاف الليل والنهار والفلك التى تجري في البحر بما ينفع التاس. وما أنزل الله من السماء ما من ماء فأحيا به الأرض بعد موتها . وب فيها من كل دابة تصريف الرياح والسحاب المسخر بين السماء والأرض لأيات لقوم يعقلون.


অর্থাৎ-আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে, যা মানুষের হিতসাধন করে তা সহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে বারিবর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তারণে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (২ঃ ১৬৪)।


এসব আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদের জন্য যে সাগরমালা ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মহাসাগর ও তার শাখা-প্রশাখা সবই লোনা ও খর। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে এতে বিরাট হিকমত রয়েছে। কারণ যদি তা মিঠা হতো; তাহলে তাতে যে সব প্রাণী আছে তা মরে পরিবেশ দূষিত এবং আবহাওয়া কলুষিত হয়ে যেত এবং তা মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিত। তাই পরিপক্ব প্রজ্ঞার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষের স্বার্থে তা এমন হয়েছে। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সমুদ্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেনঃ هو الطهور ماءه الحل ميتة "তার পানি পাক, তার মৃত জীব হালাল।"


পক্ষান্তরে নদীর পানি পানকারীর জন্যে সুমিষ্ট ও সুপেয়। আল্লাহ তাকে প্রবহমান করেছেন এবং এক স্থানে তা উৎসারিত করে মানুষের জীবিকার সুবিধার্থে তা অন্যান্য স্থানে পরিচালিত করেন। মানুষের প্রয়োজন ও উপকারের চাহিদা অনুপাতে নদ-নদীর কোনটা বড়, আবার কোনটা ছোট হয়ে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও তাফসীর বিশারদগণ সমুদ্র ও বড় বড় নদ-নদীর সংখ্যা, তার উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন, যাতে মহান সৃষ্টিকর্তার কুদরতের অনেক নিদর্শন রয়েছে এবং এ প্রমাণও রয়েছে যে, তিনি নিজ এখতিয়ার ও হিকমত মোতাবেক কাজ করেন।


সূরা তুর-এর ষষ্ঠ আয়াতঃ والبحر المسجور (এবং শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের) সম্পর্কে দু’টি অভিমত রয়েছে। প্রথমত, এর দ্বারা পাহাড়ী মেষ সংক্রান্ত হাদীসে উল্লেখিত ঐ সমুদ্রই বুঝানো হয়েছে, যা আরশের নিচে অবস্থিত এবং যা সপ্ত আকাশের উপরে রয়েছে এবং যার নিচ ও উপরের মধ্যে এতটুকু ব্যবধান, যতটুকু এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের। পুনরুত্থানের পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা এ সমুদ্র থেকেই বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তাতে দেহসমূহ কবর থেকে পুনর্জীবিত হয়ে উঠবে। রবী ইব্‌ন আনাস এ অভিমতটিই গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, البحر জাতিবাচক বিশেষ্য। পৃথিবীর সব সমুদ্রই এর আওতাভুক্ত। এটাই অধিকাংশ আলিমের অভিমত।


المسجور এর অর্থ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেনঃ المسجور অর্থ পরিপূর্ণ। কেউ বলেন, সমুদ্রটি কিয়ামতের দিন প্রজ্বলিত আগুনে পরিণত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত সকলকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। যেমনটি আলী, ইবন আব্বাস, সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) ও ইবন মুজাহিদ (رحمة الله) প্রমুখ থেকে তাফসীর গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি। কারো কারো মতে, المسجور দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সংযত ও প্রহরাধীন বুঝানো হয়েছে। যাতে তা উদ্বেলিত হয়ে পৃথিবী ও তাতে বসবাসকারী প্রাণীদেরকে ডুবিয়ে মারতে না পারে। ওয়ালিবী (رحمة الله) তা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এটাই সুদ্দী (رحمة الله) প্রমুখেরও অভিমত। নিচের হাদীসটিতে এর সমর্থন মিলে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) উমর ইবন খাত্তাব (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ


ليس من ليلة الا والبحر يشرف فيها ثلاث مرات يستأذن الله عز وجل أن ينقصه عليهم فيكفه الله عز وجل -


অর্থাৎ—“উদ্বেলিত হয়ে সবকিছু ডুবিয়ে দেয়ার জন্য সমুদ্র প্রতি রাতে তিনবার করে আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাকে সংযত করে রাখেন।"


ইসহাক ইবন রাহওয়ে (رحمة الله) এক বয়োঃবৃদ্ধ সীমান্ত প্রহরীর বরাতে বলেন, এক রাতে আমি পাহারার জন্য বের হই। তখন আমি ছাড়া আর কোন প্রহরী বের হয়নি। এক সময়ে আমি বন্দরে পৌঁছে উপরে উঠে তাকাতেই আমার কাছে মনে হচ্ছিলো সমুদ্র যেন পাহাড়ের চূড়ায় উঁচু ঢেউ রূপে এগিয়ে আসছে। কয়েকবারই এরূপ ঘটলো। আমি তখন জাগ্রত। তারপর হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর আযাদকৃত গোলাম আবু সালিহ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি বললেন, উমর ইবন খাত্তাব (رضي الله عنه) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ


ما من ليلة إلا والبحر يشرف ثلاث مرات يستأذن الله أن يتفصح عليهم فيكفه الله عز وجل.


অর্থাৎ- ‘উদ্বেলিত হয়ে সব তলিয়ে দেয়ার জন্য সমুদ্র প্রতি রাতে তিন বার আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে কিন্তু আল্লাহ তাকে সংযত করে রাখেন।’ এ সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী আছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


এটা বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে সমুদ্রের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। তাকে তাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, ফলে নৌযানে চড়ে তারা তার উপর দিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদির উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত দেশে ভ্রমণ করে থাকে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্ট নক্ষত্ররাজি ও পর্বতমালা তাতে পথের দিশা লাভ করে থাকে। আরো তারা উপকৃত হয় সমুদ্রে সৃষ্ট অতি উত্তম ও মূল্যবান মণিমুক্তা দ্বারা যা তিনি সমুদ্রে সৃষ্টি করে রেখেছেন এবং মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন, এমনকি তার মৃত প্রাণীগুলো পর্যন্ত। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ احل لكم صيد البحر وطعامه


অর্থাৎ- তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও তা ভক্ষণ হালাল করা হয়েছে। (৫ঃ ৯৬) নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ هو الطهور ماءه الحل ميتته


অর্থাৎ- সমুদ্রের পানি পবিত্র ও মৃত জীব হালাল।


অন্য হাদীসে আছেঃ


أحلت لنا ميتتان ودمان السمك والجراد والكبد والطحال.


অর্থাৎ- আমাদের জন্য দু’টো মৃত প্রাণী ও দু’টো রক্ত হালাল করা হয়েছে। মাছ ও পঙ্গপাল এবং কলিজা ও প্লীহা।’ এটি আহমদ ও ইবন মাজাহ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদ প্রশ্নাতীত নয়।


হাফিজ আবু বকর বাযযার তার মুসনাদে বলেছেন যে, আমি মুহাম্মদ ইবন মু’আবিয়া আল-বাগদাদী (رحمة الله) রচিত একটি কিতাবে পেয়েছি, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ পশ্চিমের ও পূর্বের এ সমুদ্রগুলোর সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন। তিনি পশ্চিমের সমুদ্রকে বলেন, তোমাতে আমি আমার কতিপয় বান্দাকে বহন করাতে চাই, তাদের সঙ্গে তুমি কিরূপ আচরণ করবে? সমুদ্র বলল, আমি তাদেরকে ডুবিয়ে মারব। আল্লাহ বললেনঃ “তোমার অকল্যাণ হোক এবং তাকে অলংকার ও শিকার থেকে তিনি বঞ্চিত করে দেন। পক্ষান্তরে পূর্বের সমুদ্রকে যখন বললেন, “আমি তোমাতে আমার কতিপয় বান্দাকে বহন করাব, তাদের সঙ্গে তুমি কিরূপ আচরণ করবে?" তখন সে বলল, আমি তাদেরকে আমার নিজ হাতে করে বহন করব এবং সন্তানের জন্য মায়ের মত হবো। ফলে পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাকে অলংকার ও শিকার সম্ভার দান করেন। তারপর বলেছেন যে, একথা কাউকে জানতে দিও না।


এ হাদীসের সনদে এক পর্যায়ে এমন একজন রাবী এককভাবে রয়েছেন— যিনি মুনকারুল হাদীস।৬৯ (মুনকারুল হাদীস ঐ দুর্বল রাবীকে বলা হয়ে থাকে যার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।) আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه) সূত্রেও মওকূফ পদ্ধতিতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আমার মতে, এটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, তিনিই ইয়ারমুকের যুদ্ধের দিন আহলি কিতাবদের কিতাব বোঝাই দুটো বাহন পেয়েছিলেন। ফলে সেগুলো থেকে তিনি ইসরাঈলিয়াতের অনেক তথ্য বর্ণনা করতেন, যার কতকটা সাধারণভাবে জ্ঞাত ও প্রসিদ্ধ এবং কতকটা প্রক্ষিপ্ত ও প্রত্যাখ্যাত। আবদুর রহমান ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইবন হাফস-ইবন আসিম ইবন উমর ইবন খাত্তাব আবুল কাসিম আল-মাদানী এককভাবে তার গ্রহণযোগ্য অংশগুলো বর্ণনা করেছেন। তার সম্পর্কে ইমাম আহমদ (رحمة الله) বলেছেন, লোকটি আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়। আমি তার থেকে হাদীস শুনেছিলাম। কিন্তু পরে তা ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলি। সে ছিল একজন ডাহা মিথুক এবং তার হাদীছসমূহ মুনকার পর্যায়ের। দ্রুপ ইবন মাঈন, আবূ যুর’আ, আবূ হাতিম, জাওয়জানী, বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ তাকে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। ইবন আদী বলেছেন, তাঁর হাদীসগুলো মুনকার। তন্মধ্যে দুর্বলতম হলো সমুদ্র সংক্রান্ত হাদীসটি।


দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, সমুদ্র, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, প্রান্তরাদি, পৃথিবীর শহর-বন্দর, বিজনভূমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকাসমূহ, পারিভাষিক অর্থের সাত মহাদেশ, সুবিদিত দেশসমূহ এবং বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত, খনিজ ও বাণিজ্যিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোকপাতকারী তাফসীরবিদগণ বলেন, গোটা পৃথিবীর একভাগ স্থল এবং তিনভাগ পানি। এ ভূ-ভাগের পরিমাপ হচ্ছে নব্বই ডিগ্রী। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করেই এ বিশাল পানি রাশিকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রেখেছেন যাতে করে প্রাণীকুল জীবন যাপন করতে পারে এবং শস্যাদি এবং ফলমূল উৎপন্ন হতে পারে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


والأرض وضعها للانام فيها فاكهة والنخل ذات الأمام. والحب ذوالعصف والريحان. فبای الاء ربكما تكذبان.


অর্থাৎ তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য, এতে আছে ফলমূল এবং খেজুর গাছ, যার ফল আবরণযুক্ত এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধ গুল্ম। অতএব, তোমরা (জিন ও মানবজাতি) উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রই অস্বীকার করবে? (৫৫ঃ ১০-১৩)


তাঁরা বলেন, পৃথিবীর স্থল ভাগের তিন ভাগের দু’ভাগ বা তদপেক্ষা একটু বেশিতে মানুষের বসবাস রয়েছে। এর পরিমাপ ৯৫ ডিগ্রী।৭০ (মূল আরবীতে ৯৫ ডিগ্রী লিখিত আছে যা সম্ভবত মুদ্রণ প্রমাদ। কেননা গোটা স্থলভাগই ৯০ ডিগ্রী বলে লেখক উল্লেখ করেছেন।)


তারা আরো বলেন, সমুদ্রসমূহের মধ্যে একটি হলো, পশ্চিম মহাসাগর যাকে আটলান্টিক মহাসাগরও বলা হয়। এ মহাসাগরই পশ্চিমের দেশগুলোকে ঘিরে আছে। এর পশ্চিম ভাগে আছে দু’টি দ্বীপ। এ মহাসাগরও এর উপকূলের মাঝে প্রায় এক মাসের পথে দশটি ডিগ্রী রয়েছে। এটি এমন এক সাগর অধিক ঢেউ এবং আবহাওয়া ও তরঙ্গ সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এতে চলাচল করা অসম্ভব প্রায়। তাতে কোন শিকারও নেই এবং তা থেকে কোন কিছু আহরণও করা হয় না এবং বাণিজ্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাতে ভ্রমণও করা যায় না। দক্ষিণ দিক ঘেঁষে এটি কামার পর্বতমালার দিকে চলে গেছে। এ কামার পর্বতমালাই মিসরের নীল নদের উৎসস্থল। তারপর বিষুবরেখা অতিক্রম করে তা চলে গেছে পূর্ব দিকে। তারপর আরও পূর্ব দিকে মহাসাগরটি অগ্রসর হয়ে তাই পৃথিবীর সর্বদক্ষিণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেখানে কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে যা আযযাবিজ দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এ মহাসাগরটির উপকূল অঞ্চলে প্রচুর অনাবাদী এলাকা রয়েছে। তারপর পূর্ব দিকে গিয়ে তা চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তারপর পূর্ব-উত্তর দিকে গিয়ে পৃথিবীর পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। সেখানেই চীন সাগরের অবস্থান। তারপর চীনের পূর্বে মোড় নিয়ে তা উত্তর দিকে চলে গিয়ে চীন দেশ অতিক্রম করে চলে গেছে ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার এমন একদিকে মোড় নিয়েছে যার অবস্থা কারো জানা নেই। তারপর পৃথিবীর উত্তর-প্রান্তে পশ্চিম দিকে রাশিয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে এবং তা অতিক্রম করে আবার পশ্চিম-দক্ষিণে মোড় নিয়ে পৃথিবী ঘুরে এসে পুনরায় সোজা পশ্চিম দিকে গিয়ে পশ্চিম থেকে প্রণালী৭১ (লেখক এখানে জিব্রালটার প্রণালীর কথা বলেছেন।) অঞ্চলের দিকে চলে যায়, যার শেষ প্রান্ত সিরিয়ার দিকে গিয়ে ঠেকেছে। তারপর রোমের পথ ধরে তা কনস্টান্টিনিপল প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে মিলিত হয়েছে।


পূর্ব মহাসাগর থেকে আরো কয়েকটি সমুদ্র প্রবাহিত হয়েছে। সেগুলোতে অনেক দ্বীপ আছে। এমনকি কথিত আছে যে, কেবল ভারত সাগরেই জনশূন্য দ্বীপসমূহের কথা বাদ দিলেও শহর-বন্দর ও অট্টালিকাদি বিশিষ্ট দ্বীপের সংখ্যা এক হাজার সাতশ’। এই সাগরসমূহকে বাহরে আখসারও বলা হয়ে থাকে। এর পূর্বাংশে চীন সাগর, পশ্চিমে ইয়ামান সাগর, উত্তরে ভারত সাগর এবং দক্ষিণে কী আছে তা অজ্ঞাত।


বিশেষজ্ঞগণ বলেন, ভারত সাগর ও চীন সাগরের মধ্যখানে দু’য়ের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টিকারী কয়েকটি পাহাড় আছে এবং তাতে স্থলপথের ন্যায় কয়েকটি প্রশস্ত পথ আছে যা দিয়ে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


وجعلنا في الأرض و اسی أن تميد بهم وجعلنا فيها فجاجا سبلا. لعلهم يهتدون-


অর্থাৎ- এবং আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছি সুদৃঢ় পর্বত যাতে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঢলে না যায় এবং আমি তাতে করেছি প্রশস্ত পথ যাতে তারা গন্তব্যস্থলে পৌছুতে পারে। (২১ঃ ৩১)।


ভারত উপমহাদেশের বাতলীমূস নামক জনৈক রাজা তাঁর “মিজেসতী’ নামক গ্রন্থে খলীফা মামুনের আমলে যা আরবীতে অনূদিত হয়েছিল, যা এ সংক্রান্ত বিদ্যার উৎস বলে পরিগণিত তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম, পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর মহাসাগর থেকে প্রবহমান সমুদ্রের সংখ্যা অনেক। এগুলোর মধ্যে এমনও রয়েছে যা আসলে একই সাগর, তবে পার্শ্ববর্তী জনপদের নামানুসারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, বাহরে কুলযুম বা লোহিত সাগর। কুলযুম হচ্ছে আয়লার কাছাকাছি সমুদ্রের উপকূলবর্তী একটি গ্রাম। আরো আছে পারস্য সাগর, কাস্পিয়ান সাগর, অরনক সাগর, রোম সাগর, বানতাশ সাগর ও আযরাক সাগর। আযরাক উপকূলবর্তী একটি শহরের নাম। একে কারম সাগরও বলা হয়। এটি সংকীর্ণ হয়ে দক্ষিণ কনস্টান্টিনিপলের নিকট ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। এটি কনস্টান্টিনিপলের উপসাগর। আর এ কারণেই কারম সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। আর এ কারণেই কারম সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে আসার সময় নৌযানসমূহ দ্রুত চলে কিন্তু পানির বিপরীতে প্রবাহের কারণে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কারমে আসার সময় চলে ধীর গতিতে। আর এটি পৃথিবীর একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কারণ, যত প্রবহমান পানি আছে সবই মিষ্ট, কিন্তু এটি তার ব্যতিক্রম আর সকল স্থির সমুদ্রের পানি লোনা, খর। কিন্তু কাস্পিয়ান সাগর তার ব্যতিক্রম। একে জুরজান সাগর ও তাবারিস্তান সাগরও বলা হয়। পর্যটকদের বর্ণনা, এর বিরাট এক অংশের পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়।


জ্যোতির্বিদগণ বলেন, এ সাগরটি প্রায় গোলাকার। কেউ কেউ বলেন, তা নৌকার পালের ন্যায় ত্রিকোণা বিশিষ্ট। মহাসাগরের কোন অংশের সঙ্গে তার সংযোগ নেই বরং তা সম্পূর্ণ আলাদা। তার দৈর্ঘ্য আটশ’ মাইল ও প্রস্থ ছয়শ’ মাইল। কেউ কেউ এর বেশিও বলেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।


ঐ সমুদ্রগুলোর আরেকটি হলো বসরার নিকটবর্তী সাগর, যাতে জোয়ার-ভাটা হয়। সাগরের এলাকার দেশগুলোতেও৭২ (মরক্কো-তিউনিসিয়া অঞ্চল।) এর অনুরূপ সাগর রয়েছে। চান্দ্র মাসের শুরু থেকে পানি বাড়তে শুরু করে এবং পূর্ণিমা রাতের শেষ পর্যন্ত, তা অব্যাহত থাকে। এ হলো জোয়ার। তারপর কমতে শুরু করে মাসের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ হলো ভাটা। বিশেষজ্ঞগণ এসব সাগরের সীমারেখা এবং এগুলোর উৎস ও মোহনাসমূহের উল্লেখ করেছেন এবং পৃথিবীর ছোট ছোট নদ-নদী এবং খাল-নালার আলোচনাও তারা করেছেন। আবার বড় বড় প্রসিদ্ধ নদ-নদী এবং সেগুলোর উৎস ও মোহনাসমূহের কথাও তারা উল্লেখ করেছেন। আমরা এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না - আমরা কেবলমাত্র হাদীসে বর্ণিত নদীসমূহ সম্পর্কেই আলোকপাত করব।


আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


الله الذي خلق السموت والأرض و أنزل من السماء ماء فأخرج به من الثمرات رزقا لكم وسخر لكم الفلك لتجري في البحر بأمره وسخر لكم الأنهار وسخر لكم الشمس و القمر دائبين وسخر لكم الليل والنهار و أتاكم من كل ما سألتموه وإن تعدوا نعمة الله لا تحصوها إن الإنسان لظلوم كفار.


অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন, যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর বিধানে তা সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে।


তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে। এবং তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তোমরা তার নিকট যা চেয়েছ তা থেকে। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ। (১৪ঃ ৩২-৩৪)


সহীহ বুখারী ও মুসলিমে কাতাদা (رحمة الله) সূত্রে আনাস ইবন মালিক ও মালিক ইবন সা’সা’আ থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহার আলোচনাকালে বলেছিলেনঃ


فإذا يخرج من اصلها نهران باطنان ونهران ظاهران فأما الباطنان ففي الجنة واما الظاهران فالنيل والفرات.


অর্থাৎ-আমি দেখতে পেলাম যে, তার মূলদেশ থেকে দু’টো অদৃশ্য নদী ও দু’টো দৃশ্যমান নদী বেরিয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য দু’টো জান্নাতে আর দৃশ্যমান দু’টো হলো নীল ও ফোরাত।


সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ


سيحان وجيحان والفرات والنيل كل من أنهار الجنة.


অর্থাৎ আমু দরিয়া ও শির দরিয়া ফোরাত ও নীল সব কটিই জান্নাতের নদী। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ


فجرت أربعة أنهار من الجنة الفرات والنيل وسيحان وجيحان.


অর্থাৎ জান্নাত থেকে চারটি নদী প্রবাহিত করা হয়েছে। ফোরাত, নীল, আমু দরিয়া ও শির দরিয়া। ইমাম মুসলিমের শর্ত মোতাবেক এ হাদীসের সনদ সহীহ।


সম্ভবত এর দ্বারা পরিচ্ছন্নতা, স্বাদ ও প্রবাহের ক্ষেত্রে এ নদীগুলো জান্নাতের নদ-নদীর সাথে সাদৃশ্য রাখে বলে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। এ ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা আবু হুরায়রা সূত্রে ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণিত ও তার দ্বারা সহীহ বলে আখ্যায়িত- হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সেই হাদীসে রয়েছে যাতে তিনি বলেছেনঃ


العجوة من الجنة وفيها شفاء من السم.


“আজওয়া (উন্নতমানের এক প্রকার খেজুর) জান্নাতী খেজুর এবং তাতে বিষ-এর উপশম রয়েছে। অর্থাৎ-আজওয়া জান্নাতের ফল-ফলাদির সাথে সাদৃশ্য রাখে। এর অর্থ এ নয় যে, এটি জান্নাত থেকে আহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। কেননা, বাস্তবে এর বিপরীতটিই পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং এটা যে শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, তা স্পষ্ট। অনুরূপ অন্য হাদীসে তিনি বলেছেনঃ


الحمى من فيح جهنم فأبردوها بالماء.


অর্থাৎ জ্বর হলো জাহান্নামের তাপ। কাজেই তাকে তোমরা পানি দ্বারা ঠাণ্ডা কর। অপর একটি হাদীসে আছে।


إذا اشتد الحمی فابردو ها بالماء فإن شدة الحر من فيح جهنم.


অর্থাৎ- জ্বর তীব্র আকার ধারণ করলে তাকে তোমরা পানি দ্বারা ঠাণ্ডা করে নিও। কেননা গরমের তীব্রতা জাহান্নামের তাপ বিশেষ।


তদ্রুপ এসব নদ-নদীর মূল উৎসও পৃথিবীতেই।


নীল নদঃ স্রোতের তীব্রতা, পানির স্বচ্ছতা এবং গতিপথের দৈর্ঘ্যের দিক থেকে গোটা পৃথিবীতে এটি অতুলনীয় নদী। এর শুরু হলো জিবালুল কামার বা শুভ্র পর্বতমালা থেকে। কারো কারো মতে, জিবালুল কামার দ্বারা চন্দ্রের পাহাড় বুঝানো হয়েছে। এটি পৃথিবীর পশ্চিমাংশে বিষুবরেখার পেছনে দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। কারো কারো মতে, তাহলো যার মধ্য থেকে উৎসারিত হয়েছে একাধিক ঝরনা। তারপর দূরে দূরে অবস্থিত দশটি স্রোতধারার সম্মিলন ঘটেছে। তারপর তার প্রতি পাঁচটি গিয়ে একত্রিত হয় একটি সাগরে। তারপর তা থেকে বেরিয়ে আসে ছ’টি নদী। তারপর তার প্রতিটি গিয়ে মিলিত হয় অন্য এক হ্রদে। তারপর তা থেকে বেরিয়ে আসে আরেকটি নদী। এটাই হলো নীল নদ। এ নদটি সুদান, নওবা ও আসওয়ান হয়ে অবশেষে মিসরে গিয়ে উপনীত হয়েছে। নওবার প্রধান শহর হচ্ছে দামকালা। হাবশার বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি এবং তার পলিমাটি মিসরে গড়িয়ে আসে। মিসরের এ দু’টো বস্তুরই প্রয়োজন রয়েছে। কারণ মিসরে বৃষ্টি এত কম হয় যে, তা ফসলাদি ও গাছ-গাছালির জন্য যথেষ্ট নয়। আর তার মাটি হলো বালুময়। যাতে কোন ফসলই উৎপন্ন হয় না। নীল নদ হয়ে যে পানি ও মাটি আসে তা থেকেই মিসরবাসীর প্রয়োজনীয় ফসলাদি উৎপন্ন হয়।


আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ


الم يروا أنا نسوق الماء إلى الأرض الجز فنخرج به زر عا تأكل منه انعامهم وانفهم أفلا تبصرون


অর্থাৎ তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমির উপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য যা হতে খাদ্য গ্রহণ করে তাদের গবাদি পশু এবং তারাও? তারা কি লক্ষ্য করে না? (সাজদাঃ ২৭)


মিসরের ক্ষেত্রেই সর্বাধিক প্রযোজ্য। তারপর মিসরের কিছু অংশ অতিক্রম করে উপকূলবর্তী শাতনূফ নামক একটি গ্রামের নিকট গিয়ে নীল নদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে তার পশ্চিমের শাখাটি রশীদ অঞ্চল অতিক্রম করে লোনা সমুদ্রে পড়েছে, অপরদিকে পূর্ব দিকের শাখাটি জাওজার-এর নিকট গিয়ে দুভাগ হয়ে শাখাদ্বয়ের পশ্চিম ভাগ দুমিয়াত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে। আর পূর্বভাগ আশমূনতান্নাহ হয়ে দুমিয়াতের পূর্বে অবস্থিত তান্নীস হ্রদ ও দুমিয়াত হ্রদে পড়েছে। নীল নদের উৎপত্তিস্থল ও সঙ্গম স্থলের মধ্যে এভাবে বিরাট দূরত্ব রয়েছে। আর এ কারণেই এর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ।


ইবন সীনা বলেন, নীল নদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা পৃথিবীর অন্য কোন নদ-নদীর নেই। প্রথমত, উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ প্রান্তের মাঝে এর দূরত্ব সর্বাধিক। দ্বিতীয়ত, তা প্রবাহিত হয় বড় বড় পাথর ও বালুময় প্রান্তরের উপর দিয়ে, যাতে কোন শাওলা ও ময়লা-আবর্জনা নেই। তৃতীয়ত, তার মধ্যে কোন পাথর বা কংকর সবুজ হয় না। বলা বাহুল্য যে, নদীটির পানির স্বচ্ছতার কারণেই এরূপ হয়ে থাকে। চতুর্থত, আর সব নদ-নদীর পানি যখন হ্রাস পায়, এর পানি তখন বৃদ্ধি পায় আর অন্যসব নদীর পানি যখন বৃদ্ধি পায়, এর পানি তখন হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে কেউ কেউ বলে যে, নীল নদের উৎস হলো কোন এক উঁচু স্থান, কেউ কেউ যার সন্ধান পেয়েছেন এবং তাতে ভীষণ এক ভয়ানক বস্তু কতিপয় রূপসী নারী এবং আরো অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেয়েছেন; এর সবই ঐতিহাসিকদের ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং মিথ্যাচারীদের কল্পকাহিনী মাত্র।


কায়স ইবন হাজ্জাজ সূত্রে জনৈক ব্যক্তি থেকে আবদুল্লাহ ইবন লাহীয়া বর্ণনা করেন যে, জনৈক ব্যক্তি বলেন, মিসর জয় করে আমর ইবন আস (رضي الله عنه) যখন অনারব কিবতী ক্যালেন্ডারের বু’না নামক মাসে তাতে প্রবেশ করেন তখন মিসরের লোকজন তাঁর নিকট এসে বলল, মাননীয় আমীর! আমাদের এ নীল নদের একটি প্রথা আছে, যা পালন না করলে তা প্রবাহিত হয় না। তিনি বললেনঃ কী সে প্রথাটি? তারা বলল, এ মাসের বার তারিখের রাত শেষ হলে আমরা বাবা-মার নিকট থেকে তাদের সম্মতিক্রমে একটি কুমারী মেয়ে নিয়ে আসি এবং উন্নতমানের অলংকারাদি ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিয়ে তাকে এ নীল নদে ফেলে দেই। শুনে আমর ইবন আস (رضي الله عنه) তাদেরকে বললেনঃ


إن هذا لا يكون في الإسلام وإن الا سلام يهدم ما قبله.


অর্থাৎ- ইসলামে এটা চলবে না। পূর্বের সব কুসংস্কারকে ইসলাম নির্মূল করে দেয়। অগত্যা বুনা মাসটা তারা এভাবেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু নীল নদে কোন পানি আসলো না। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, তারা বুনা, আবীব ও মাসরা এ তিন মাস অপেক্ষা করলো কিন্তু নীল আর প্রবাহিত হয় না। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা দেশ ত্যাগ করতে মনস্থ করে। অবশেষে আমর (رضي الله عنه) খলীফা উমর ইবন খাত্তাব (رضي الله عنه)-এর নিকট এ ব্যাপারে পত্র লিখেন। জবাবে উমর (رضي الله عنه) লিখে পাঠান যে, তুমি যা করেছ ঠিকই করেছ। আর তোমার নিকট একটি লিপি প্রেরণ করছি, তুমি তা নীল নদে ফেলে দিও। পত্রটি এসে পৌঁছুলে আমর (رضي الله عنه) লিপিটি খুলে দেখতে পেলেন যে, তাতে লিখা রয়েছে।


من عبد الله عمر أمير المؤمنين إلى نيل مصر اما بعد- فان كنت تجري من قبلك فلا تجر وان كان الله الواحد القهار هو الذي يجريك فنسأل الله أن يجريك.


অর্থাৎ- “আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন উমর-এর পক্ষ থেকে মিসরের নীল নদের প্রতি হামদ ও সালাতের পরঃ


যদি তুমি নিজ ক্ষমতায় প্রবাহিত হয়ে থাকো, তাহলে তুমি প্রবাহিত হয়ো না। আর যদি পরাক্রমশালী এক অদ্বিতীয় আল্লাহ তোমাকে প্রবাহিত করে থাকেন, তাহলে তারই কাছে আমরা প্রার্থনা করছি যেন তিনি তোমাকে প্রবাহিত করেন।”


আমর (رضي الله عنه)-এর চিঠিটি নীল নদে ফেলে দিলে শনিবার দিন সকালে দেখা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা নীল নদকে এমনভাবে প্রবাহিত করে দিয়েছেন যে, এক রাতে ষোল হাত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে আল্লাহ মিসরবাসী থেকে সে কুপ্রথা চিরতরে বন্ধ করে দেন।


ফোরাতঃ বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত হলো এর উৎপত্তিস্থল। সেখান থেকে মালতিয়ার নিকট দিয়ে অতিক্রম করে শমীশাত ও বয়রা হয়ে তারপর পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে বালেস ও জাবার কেল্লায় চলে গেছে। তারপর রিককা, রহবা, ’আনা, হায়ত ও কূফা হয়ে ইরাকের দিকে গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। এ নদীটির অনেক প্রসিদ্ধ উপনদী, শাখা নদী রয়েছে।


সায়হান (আমু দরিয়া)ঃ একে সায়হুনও বলা হয়। বাইজানটাইন এলাকা থেকে এর উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর প্রবাহ। জায়হানের পশ্চিমে এর অবস্থান এবং আকারে তারচেয়ে ছোট। যে ভূখণ্ডে এর অবস্থান, বর্তমানে তা সীস নামে পরিচিত। ইসলামী রাজত্বের প্রথমে তা মুসলমানদের হাতে ছিল। তারপর ফাতেমীগণ যখন মিসরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং সিরিয়া ও তার আশপাশের অধিকার লাভ করেন, তখন তারা তাকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তিনশ’ হিজরীর গোড়ার দিকে আর্মেনিয়ার অধিবাসী তাকফুর এ সীস নগরী দখল করে নেয়। এখন পর্যন্ত তা তাদের দখলেই রয়েছে। আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, যেন আপন ক্ষমতাবলে তিনি আবার আমাদের হাতে তা ফিরিয়ে দেন। তারপর সায়হান ও জায়হান উযনার নিকট মিলিত হয়ে একই স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। অবশেষে আরাস ও তার সূস-এর মধ্যবর্তী স্থানে তা সাগরে পতিত হয়েছে।


জায়হান (শির দরিয়া)ঃ একে জায়হুনও বলা হয়, সাধারণ্যে এর নাম হলো জাহান। এর উৎস হলো বাইজানটাইন এলাকা এবং সীস নগরীতে তা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এটি আকারেও প্রায় ফোরাতের সমান। তারপর একটি সায়হান উনার নিকট মিলিত হয়ে দুটো এক স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। আয়াস ও তারসূস-এর মধ্যবর্তী স্থানে সাগরে গিয়ে পড়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

Top