Latest News

 


ওলামায়ে হক্বের সম্মানের কারণ কি?

    -মুফতি কাসিম আত্তারী حفظه الله 


জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী প্রত্যেকের নিকট এই সত্যটি স্পষ্ট যে, জ্ঞান ও জ্ঞানীর সম্মান ও মর্যাদা কুরআন ও হাদীসে খুবই শান সহকারে বর্ণিত হয়েছে। আদম عليه السلام এর জ্ঞানের ফযিলত প্রকাশ হলে ফেরেশতারা তাঁকে সেজদা করা, মূসা عليه السلام এর জ্ঞানার্জনের জন্য খিজির এর দিকে সফর, কারুনের পার্থিব শান শওকত ও সম্পদের প্রাচুর্যতা দেখে বিস্ময় প্রকাশকারীদেরকে জ্ঞানীদের উপদেশ, হযরত লুকমান رضي الله عنه এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বর্ণনা, আসিফ বিন বরখিয়া رضي الله عنه এর কিতাবি জ্ঞানের সাহায্যে মহান কারামত প্রদর্শন আর সবচেয়ে বড়, জগতের সর্বশ্রেষ্ট জ্ঞানী মনিষী, মুহাম্মদে মুস্তফা ﷺ এর জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া করাতে থাকার মৌখিক আদেশ, জ্ঞান ও জ্ঞানীর শান বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ঠ।


এ সকল উদাহরণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ পাকের দরবারে ওলামাদের শান কিরূপ উঁচু এবং এই বিষয়টিও গোপন নয় যে, প্রত্যেক শান ও মর্যাদার কোনো না কোনো কারণ থাকে। যেমন: মুজাহিদদের মর্যাদা এ জন্যই যে, তারা আল্লাহর জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে। আবিদদের মহতু এজন্যই যে, তাঁরা তাঁদের ঘুম, আরাম এবং সুখ- শান্তি বিসর্জন দিয়ে থাকে। 


অনুরূপভাবে জ্ঞানীদের ফযিলত ও শানেরও কারণ রয়েছে, যার মধ্যে একটি কারণ তো স্বয়ং জ্ঞানের সত্তাগত মর্যাদা যে, জ্ঞান সত্তাগতভাবেই স্বয়ং ফযিলতের মাধ্যম আর ওলামাদের মর্যাদার দ্বিতীয় কারণ হলো যে, তাঁরা আল্লাহ পাকের দ্বীনের প্রচার ও প্রসার, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং স্থায়িত্ব ও আধিপত্যের জন্য নিজের জীবনকে ব্যয় করেন আর যারাই আল্লাহর দ্বীনের জন্য পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা করবে, তারাই আল্লাহ পাকের দরবারে পছন্দনীয় হবেন। যেমনটি,


যদি একজন শিক্ষক লেখাপড়ার ব্যাপারে ছাত্রদেরকে কোন কাজ করার আদেশ দেন কিন্তু ছাত্ররা উদাসীন হয়ে বসে থাকে, নিজেদের অলসতায় মত্ত থাকে। এবার যদি সেই ক্লাসের কোনো ছেলে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের উৎসাহিত করে যে, দেখো আমাদের শিক্ষকের কথা মেনে চলা উচিৎ, আমাদের পরিশ্রমের সহিত পড়া উচিৎ, আমাদেরকে আমাদের প্রতিটি লেখাপড়ার কাজ সম্পূর্ণ করা উচিৎ ইত্যাদি, তখন স্বভাবতই ছাত্রের এরূপ আচরণে শিক্ষকের খুবই আনন্দ হবে যে, আমার আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এই ছেলেটি কিরূপ চেষ্টা করছে। 


এরই দ্বিতীয় উদাহরণ হলো: কোনো দেশের ঐ সকল ব্যক্তি, যারা দেশে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখে, বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ দমন করে বা ভাল কাজে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে, তাদেরকে দেশের শ্রেষ্ট সন্তান অভিহিত করা হয় এবং স্বদেশ তাদেরকে সম্মান করে। 


এই উদাহরণগুলো দ্বারা আপনারা জ্ঞানীদের মহত্বের কারণ বুঝে নিন যে, একদিকে তো আল্লাহর আপন সৃষ্টির জন্য আকীদা, ইবাদত, কার্যাবলী ও নৈতিকতার ব্যাপারে অসংখ্য বিধি- বিধান রয়েছে, যেমন; আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য মেনে নেয়া, তাঁর সকল রাসূলগণ, কিতাব সমূহ, ফেরেশতা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস রাখা। আল্লাহর ইবাদত করা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত পালন করা, আল্লাহর কুরআন পড়া, এর অর্থ অনুধাবন করা ও তদানুযায়ী আমল করা। সৃষ্টির হক আদায় করা, বাবা-মা, সন্তান, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তান, প্রতিবেশী, অপরিচিত জন ও মানুষ ও প্রাণী সকলের সাথে যথা সম্ভব উত্তম আচরণ করা। নিজের অন্তর অহঙ্কার, হিংসা, বিদ্বেষ, লৌকিকতা, দুনিয়ার ভালবাসা থেকে পবিত্র রাখা এবং উত্তম বাতেনী নৈতিকতা দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করা।


যেমন; একনিষ্ঠতা, ভরসা, ধার্মীকতা, অল্পেতুষ্টতা, ধৈর্য্য, কৃতজ্ঞতা, আল্লাহর ভালবাসা ইত্যাদি। এটাই ভূ-পৃষ্টে সকল মানুষের জন্য আল্লাহর বিধান।


অপরদিকে সৃষ্টির যেই অবস্থা, তা সকলের সামনে যে, অসংখ্য মানুষের আকিদা খারাপ, কেউ নাস্তিক, কেউ মুশরিক, কেউ ভ্রান্ত আক্বীদার সাথে জড়িয়ে আছে, তো কেউ অন্য কোন দিকে। একই অবস্থা ইবাদতের ক্ষেত্রেও, অবিশ্বাসীদের ইবাদত থেকে দূরে থাকা তো স্বাভাবিক, কিন্তু বিশ্বাসীদের মধ্যে কতজন নামাযী, পরহেযগার তাও আমরা জানি। বান্দার হকের ব্যাপারে উদাসীনতা, হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতন, নীপিড়ন, হারাম ও ঘুষের কালো থাবায় জর্জরিত। মানুষের বড় একটি অংশের অন্তর অহঙ্কার ও হিংসার শিকার আর সম্পদ ও দুনিয়ার মোহে গ্রেফতার। 


একনিষ্ঠতা, ভরসা, ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতা খুঁজলে তবে আউলিয়ায়ে কিরামের নামই সামনে আসে, সর্বসাধরণের মাঝে লৌকিকতা, উপাদানের উপরই পূর্ণ নির্ভরশীলতা, অধৈর্য ও অকৃজ্ঞতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মোটকথা, একদিকে আল্লাহর বিধান আর অপরদিকে সৃষ্টির উদাসীনতা ও আমলহীনতা। এমন পরিস্থিতিতেও ওলামায়ে দ্বীনের সত্তাই আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ঐ মহান মনিষী, যাঁরা আল্লাহ পাকের বিধানের প্রতি আগ্রহী করার জন্য প্রচেষ্টা করে থাকেন আর জ্ঞানার্জন করে, জ্ঞান দান করে, দ্বীন শিখে, শিখায়, কুরআন তিলাওয়াত করে, করায়, মানুষকে মাসয়ালা বুঝায়, হালাল ও হারামের পার্থক্য বলে, আকিদার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে, তা বিকৃত হওয়া থেকে বাঁচায়, মৃত্যু, কবর, আখিরাতের স্মরণ করায় এবং আমল সংশোধনের প্রতি মনযোগী করে। 


মোটকথা তাঁরা হলেন ঐ লোক, যাঁরা অন্যদের মতো মানুষ, সুস্থ স্বাভাবিক হাত-পা সম্পন্ন। সুতরাং চাইলে অবশিষ্ট লোকের মতো দুনিয়া অর্জন করতে পারেন, আনন্দ উল্লাস করতে পারেন, দ্বীনের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করতে পারেন, প্রবৃত্তির পেছনে ছুটতে পারেন কিন্তু এই ওলামারা এরূপ উদাসীনতায় পতিত হওয়ার পরিবর্তে দ্বীন শিখে মানুষকে শিখানো এবং দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। সুতরাং যখন ওলামায়ে দ্বীন নিজের জীবন আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন, তখন আল্লাহ পাক তাঁদের মর্যাদাও এতো বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং কুরআনে ইরশাদ করেছেন: তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করবেন। (পারা: ২৮, মুজাদালাহ, আয়াত: ১১) 


আর এই কারণেই ওলামাগণ আল্লাহর নিকট যতটা পছন্দনীয়, ততটাই শয়তান ও তার অনুসারীদের নিকট অপছন্দনীয়। যেমনটি, নবী করীম صلى الله عليه وآله وسلم ইরশাদ করেন: ‘একজন আলিম ও ফকিহ, এক হাজার আবিদের চেয়ে বেশি শয়তানের উপর শক্তিশালী হয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৪/৩১২, হাদীস: ২৬৯০) অর্থাৎ শয়তান এক হাজার ইবাদতকারী থেকে এতটা কষ্ট পায় না, যতটুকু একজন আলিমে দ্বীন থেকে পায়, কেননা ইবাদতকারী তো ইবাদতের মাধ্যমে নিজের একার মুক্তির জন্য চেষ্টা করে থাকে, পক্ষান্তরে আলিম নিজের মুক্তির পাশাপাশি হাজারো, লাখো আর কখনো এরও বেশি মানুষের মুক্তির জন্য চেষ্টা করে থাকে।


আলিম নিজে তো শয়তানের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকে কিন্তু পাশাপাশি অপরকে বাঁচানো চেষ্টা করে থাকে এবং শয়তানের পরিকল্পনার সামনে মোকাবেলার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। এ কারণেই শয়তানের আলিমে দ্বীনের মাধ্যমে অধিকতর কষ্ট অনুভূত হয়।


এমনিতে তো হাদীসে শয়তানের ব্যাপারে জানিয়ে দেয়ার কারণে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে যে, শয়তানের হাজার গুণ বেশি কষ্ট হয়ে থাকে কিন্তু সর্বাবস্থায় শয়তান ও তার কষ্ট আসলে দেখি না। 


এজন্যই হাদীসের সত্যতা পর্যবেক্ষণের জন্য জ্বীন শয়তানের পরিবর্তে মানুষ শয়তান দেখে নিতে পারেন যে, ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা, নির্লজ্জতা ও অশ্লিলতা প্রসারকারী এবং মুক্তচিন্তা ইত্যাদি সমর্থনকারীরা যেহেতু শয়তানের উদ্দেশ্য পূরণ করছে আর ওলামায়ে দ্বীন তাদের বক্তব্য ও রচনার প্রতিটা ক্ষেত্রে মোকাবেলা করে, তখন শয়তানের ন্যায় তার মনুষ্য অনুসারীরা ও প্রতিনিধিরাও ওলামায়ে কিরামের বিরুদ্ধে লিখে থাকে, বলে থাকে ও চিৎকার চেঁচামেচি করে, বকবক করে আর মুখে ফেনা তুলে বেড়ায়। আর তা কেনইবা হবে না যে, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য থেকে কাউকে সরানোর চেষ্টা করে তখন ওলামারা তার প্রতি অগ্নিশর্মা হন। কেননা, ওলামারা হলেন রহমানের বান্দা। অপরদিকে যখন ওলামায়ে কিরাম শয়তানের আনুগত্য থেকে মানুষকে সরাতে, বাঁচাতে এবং দূরে রাখতে চেষ্টা করেন তখন শয়তানের অনুসারীদেরও রাগ আসে।


যাইহোক আমরা তো এটাই বলবো, “আমাদের জন্য আমাদের আমল, তোমাদের জন্য তোমাদের আমল।” তবে কিয়ামতের দিন জানা যাবে যে, কারা দ্বীনের মুবাল্লিগ অর্থাৎ আল্লাহর পয়গাম্বর, সত্যিকার আম্বিয়ায়ে কিরামের ‎‫عليه الشدة والسلام সহযাত্রী হয়ে সম্মানের পাত্র হবে‬‎ আর কারা দ্বীনের সাথে শত্রুতা পোষণকারী শয়তানের সহচর হয়ে লাঞ্ছিত হবে।

Top