দ্বিতীয় অধ্যায়

আহাদ নামা লিখা প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ


এ বিষয়ে নিম্নলিখিত আপত্তিসমূহ উত্থাপন করা হয়।


১ নং আপত্তি- সেই পুরনো বুলি অর্থাৎ আহাদ নামা লিখা বিদআত। সুতরাং হারাম।


উত্তর- ইতিপূর্বে উলে­খিত আমার বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, এটা বিদআত নয়, এর উৎস প্রমাণিত আছে। আর যদি বিদআতই হয়ে থাকে, সব বিদআত হারাম নয়। ‘বিদআত’ শীর্ষক আলোচনা দেখুন।


২ নং আপত্তি- আহাদ নামাকে তলকীন মনে করাটা ভুল। কেননা মৃত ব্যক্তি যদি নিরক্ষর হয়, প্রশ্ন করার সময় লিখিত বিষয় কিভাবে বুঝবে?


উত্তর- মৃত্যুর পর প্রত্যেকেই লিখা পড়তে পারবে। এ জগতেই অজ্ঞ থাকতে পারে, ওখানে কোন অজ্ঞতা নাই। হাদীছ শরীফে আছে যে বেহেশতবাসীর ভাষা হবে আরবী। (ফাতওয়ায়ে শামীর কিতাবুল কারাহাত দেখুন) অথচ পৃথিবীতে অনেক বেহেশতবাসী আরবী সম্পর্কে অজ্ঞ। অনুরূপ প্রত্যেক মইয়েতের কাছে ফিরিশতাদ্বয় আরবীতে প্রশ্ন করেন এবং প্রত্যেকে আরবী বুঝতে পারে। আল্লাহ তাআলা মীছাকের দিন সবার থেকে আরবীতে শপথ নিয়ে ছিলেন। তাহলে কি মৃত্যুর পর মইয়তকে কোন মাদ্রাসায় আরবী শিক্ষা দেয়া হয়? কখনই না, বরং এমনিতে জেনে যাবে। কিয়ামতের দিন সকলের হাতে লিখিত আমলনামা দেয়া হবে এবং অজ্ঞ জ্ঞানী সবাই পড়বে। এর থেকে বোঝা গেল মৃত্যুর পর প্রত্যেকেরই আরবী বুঝে এবং আরবী লিখাও পড়তে পারে। সুতরাং এ লিখাটা অর্থাৎ আহাদ নামাটা ওর জন্য উপকারী হবে।


৩নং আপত্তি- আল্লামা শামী (رحمة الله) ফাতওয়ায়ে শামী প্রথম খণ্ড الشهيد অধ্যায়ের একটু আগে কাফনের উপর লিখাকে নিষেধ করেছেন। অনুরূপ শাহ আবদুল আযীয ছাহেব ফাত্ওয়ায়ে আযীযিতে তা নিষেধ করেছেন। কেননা লাশ যখন ফোলে ফেটে যাবে, তখন এর গলিত পুঁজ ও রক্তে এ লিখাগুলো কলুষিত হবে, যা অবমাননাকর। সুতরাং এটা নাজায়েয। (বিরোধিতাকারীগণ সাধারণতঃ এ আপত্তিটা বেশী করে থাকে।)


উত্তর- এর কয়েকটি জবাব আছে।

প্রথমতঃ দলীলটা তাদের দাবী অনুযায়ী হয়নি। তাদের দাবী হচ্ছে কবরে লিখিত কোন কিছু রাখা নাজায়েয। কিন্তু এ দলীল থেকে বোঝা যায় যে, কালি বা মাটি দ্বারা লিখে কাফনের উপর রাখা নিষেধ কিন্তু যদি আঙ্গুল দ্বারা মইয়তের কপালে বা বুকের উপর কিছু লিখে দেয়া হয় বা কবরের মধ্যে একটি তাকে আহাদনামা রাখা হয়, তাহলে জায়েয আছে; এতে লিখার অবমাননার কোন সম্ভাবনা নাই। সুতরাং এ আপত্তি তাদের সহায়ক নয়.

দ্বিতীয়তঃ আল্লামা শামী (رحمة الله) সকল প্রকার লিখা নিষেধ করেন নি। একই জায়গায় তিনি বলেছেন-


نَعَمْ نَقَلَ بَعْضُ الْمُحَشِّينَ عَنْ فَوَائِدِ الشَّرْجِيِّ أَنَّ مِمَّا يُكْتَبُ عَلَى جَبْهَةِ الْمَيِّتِ بِغَيْرِ مِدَادٍ بِالْأُصْبُعِ الْمُسَبِّحَةِ - بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَن الرَّحِيم - وَعَلَى الصَّدْرِ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ، وَذَلِكَ بَعْدَ الْغُسْلِ قَبْلَ التَّكْفِينِ.


-কতেক মুহাককিক আলিম প্রসিদ্ধ ‘ফতয়ায়েদুশ শরজী’ গ্রন্থ থেকে বর্ণনা করেছেন যে মইয়তের কপালে কালিবিহীন আঙ্গুল দ্বারা بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَن الرَّحِيم লিখা যাবে এবং বুকের উপর لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ লিখা যাবে এবং এ লিখাটা যেন গোসলের পর কাফনের আগে হয়।’’  এর থেকে বোঝা গেল যে, লিখাটা সাধারণভাবে নিষেধ করেন নি।

তৃতীয়তঃ আল্লামা শামী (رحمة الله) ফাতওয়ায়ে বযাযিয়ার ফাতওয়ার বরাত দিয়ে জায়েয বলেছেন। এর থেকে বোঝা গেল-হানাফী মাযহাবের প্রধান আলিমগণ জায়েযের সমর্থক। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজর হারাম হওয়ার ফাতওয়া দিয়েছেন আর তিনি হলেন শাফেঈ মযহাবের অনুসারী। তাহলে কি হানাফীদের নির্দেশের পরিপন্থী শাফেঈদের ফাতওয়ার অনুসরণ করা ঠিক হবে? কখনই না। অধিকন্তু হারামের ফাতওয়াটা হচ্ছে কেবল শেখ ইবনে হাজরের নিজস্ব উক্তি, কারো থেকে সংকলন করেন নি।

চতুর্থতঃ লাশ ফোলে ফেটে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী নয়। কারণ অনেক লাশ ফোলেও না, ফাটেও না। তাই কেবল অবমাননার ধারণার বশবর্তী হয়ে মৃত ব্যক্তিকে উপকার থেকে বঞ্চিত করার কি যুক্তি থাকতে পারে?

পঞ্চমতঃ আমি আগের অধ্যায়ে সাহাবায়ে কিরামের আমলের কথা উলে­খ করেছি যে, তাঁরা নিজেদের কাফনসমূহে হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র বস্তু রাখার জন্য ওসীয়ত করেছেন। স্বয়ং হুযুর ﷺ স্বীয় তাহবন্দ শরীফ তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত যয়নব (رضي الله عنه) এর কাফনের মধ্যে রাখিয়েছেন। হযরত তাউস নিজের কাফনের উপর দুআর বাক্যসমূহ লিখার জন্য ওসীয়ত করেছেন। বলুন ওগুলোতে কি পুঁজ রক্ত লেগে যাবার কোন সম্ভাবনা ছিল না? বা ওগুলো কি পবিত্র ছিল না?

ষষ্ঠতঃ শরীয়তের বিধান হচ্ছে পবিত্র বস্তুসমূহ নাপাক জায়গায় ফেলা হারাম। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি সদুদ্দেশ্যে প্রয়োজনবোধে পাক জায়গায় রাখে তাহলে কেবল সম্ভাবনা জনিত কারণে ওটা নাজায়েয হবে না। এর অনেক দলীল রয়েছে।

যমযম কুপের পানি খুবই পবিত্র। এর দ্বারা প্রসাব ধৌত করা হারাম। কিন্তু পান করা জায়েয। কুরআন শরীফের আয়াত লিখে ধুয়ে পানি পান করা মুবাহ। হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করা জায়েয ও হালাল। অথচ এগুলো পেটে পৌছে মূত্রস্থলীতে যায় এবং ওখান থেকে প্রসাব হয়ে বের হয়। প্রথম অধ্যায়ে আমি উদ্ধৃত করেছি যে হযরত ফারুকে আযম (عليه السلام) এর ঘোড়াশালার ঘোড়ার উরুতে লিখা ছিল حَبِيسٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ অথচ ওই লেখায় প্রস্রাবের ছিটকা পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী আর ঘোড়া নাপাক জায়গায় লুটে পড়ে। কিন্তু এর প্রতি কোন ভ্র“ক্ষেপ করা হয়নি। এ দলীল থেকে ইমাম নাসীর (رحمة الله) ও ইমাম সফ্ফার (رحمة الله) (উভয়ই হানাফী মযহাবের বিশিষ্ট ইমাম) এ লিখাকে জায়েয বলেন। শেখ ইবনে হাজর (رحمة الله) যে বলেন ফারুকে আযমের ঘোড়াগুলোতে এ লিখাটা জায়েয বলেন। শেখ ইবনে হাজর (رحمة الله) যে বলেন ফারুকে আযমের ঘোড়াগুলোতে এ লিখাটা চিহ্নিত করার জন্যই ছিল, সুতরাং এর হুকুমও ভিন্ন হয়ে যাবে। তা হতে পারে না। কেননা, উদ্দেশ্যে যেটাই হোক না কেন, অক্ষর গুলোতো ঠিকই রয়েছে। আর নিয়তের পার্থক্যের ফলে অক্ষরগুলোর হুকুমের কোন পরিবর্তন হয় না। মোট কথা হলো, এ আপত্তিটা নিছক ভিত্তিহীন। হাদীছ শরীফ, সাহাবা কিরামের আমল, ইমামগণের উক্তিসমূহের মুকাবিলায় কোন গাইর-মুজতাহিদ শাফেঈ মযহাবের ইমামের কেবল কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কোন হানাফী ইমামের উক্তি বা সুস্পষ্ট হাদীছ এর নিষেধাজ্ঞায় পেশ করলে গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু তা কখনও পারবে না।

সপ্তমতঃ উলামায়ে কিরামের উক্তি থেকে মুস্তাহাব বা জায়েয প্রমাণিত হতে পারে কিন্তু মকরূহ প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট দলীলের প্রয়োজন আছে। যেমন আমি প্রথমে প্রমাণ করেছি। সুতরাং উপরোক্ত উক্তিসমূহের মধ্যে মুস্তাহাব সম্পর্কিত বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য এবং মকরূহ সম্পর্কিত বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় কেননা এর কোন সুনির্দিষ্ট দলীল নাই।


৪ নং আপত্তি- আহাদনামা বা শাজরা কবরে রাখাটা অপব্যয়, কেননা ওখানে রাখার ফলে কারো কাজে আসবে না এবং অনর্থক নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এটা অপব্যয় হেতু হারাম।


উত্তর- যেহেতু এর দ্বারা মইয়তের অনেক উপকার হয় এবং কাজে আসে, সেহেতু এটা অনর্থক নয়, অপব্যয়ও নয়।


৫ নং আপত্তি- হুযুর ﷺ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মুনাফিককে তার মৃত্যুর পর স্বীয় জামা মুবারক পরায়েছেন এবং ওর মুখে নিজের পবিত্র থুথু ফেলেছেন। কিন্তু এতে কোন উপকার হলো না। বোঝা গেল আহাদনামা ইত্যাদি বৃথা মাত্র। আরও জানা গেল যে হুজুরের কাছে ইলমে গায়ব নাই। অন্যথায় তিনি স্বীয় থুথু ও জামা দিতেন না। এটাও বোঝা গেছে যে, নবীর শরীরের অংশ দোযখে যেতে পারে, কেননা, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই হলো দোযখী এবং ওর মুখে যেহেতু হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র থুথু ফেলা হয়েছে, সেহেতু থুথুও ওখানে পৌঁছেছে।


উত্তর- এ ঘটনার দ্বারা তো পবিত্র বস্তু রাখাটাই প্রমাণিত হলো। কেননা হুযুর ﷺ মুনাফিককে নিজের জামা উদ্দেশ্যে পরায়ে ছিলেন। তবে এটা জানা ছিল যে ঈমানহীনদের বেলায় পবিত্র বস্তু উপকারী নয়। আমরাও তাই বলি যে মুমিন মইয়তের জন্য পবিত্র বস্তু উপকারী কিন্তু কাফিরের জন্য নয়। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর মুনাফিক হওয়াটা হুযুর আলাইহিস সালামের জানা ছিল। তাঁর বলার ফলেই তো আমরা জানতে পেরেছি। এটাও জানা ছিল যে, ঈমানহীনদের বেলায় পবিত্র বস্তু সমূহ কোন উপকারী নয়। কেননা এটা আকায়েদের মাসআলা, যার জ্ঞান নবী করীম (ﷺ) এর নিশ্চয় আছে। যদি একজন কৃষক অনুর্বর ও উর্বর ভূমি চিনতে পারে, নবীজী কেন ঈমানের যমীন অর্থাৎ মানুষের মনের কথা জানবেন না? তিনটি কারণে তিনি ওকে পবিত্র বস্তু দিয়েছেন-

এক, ওর ছেলে একনিষ্ঠ মুমিন ছিলেন। হয়তো উনার সান্ত্বনার জন্য করা হয়েছিল।

দুই, সে একবার হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) কে তার কাপড় পরায়েছিল। তিনি (ﷺ) তাঁর চাচার প্রতি ওর ইহসানটা না থাকাটাই চেয়েছেন।

তিন, তিনি রহমতে আলম হওয়াটাই প্রকাশ করেছেন অর্থাৎ আমি তো প্রত্যেকের প্রতি করুণা করতে প্রস্তুত, গ্রহণ করুক বা না করুক।

বৃষ্টি সব যমীনের উপর বর্ষিত হয় কিন্তু নালা নর্দমা ও খিলজমি এর থেকে কোন উপকৃত হয় না। নবীর শরীরের অংশ কোন অবস্থায় দোযখে যেতে পারে না। ফিরিশতা ওই থুথু ওর মুখে প্রবিষ্ট হতে দেননি বরং বের করে ফেলেছে। কেনআন ইবনে নুহ মানুষের আকৃতিতে দোযখে যায়নি অর্থাৎ সেই বীর্য যখন অন্য আকার ধারণ করলো, তখনই দোযখে গেল। অন্যথায় হযরত তালহা যখন হুজুর আলাইহিস সালামের শিঙ্গারের রক্ত পান করেছিলেন, তখন তিনি (ﷺ) বলেছিলেন, ‘তোমার উপর দোযখের আগুন হারাম।’




Top