১ম পরিচ্ছেদ
‘গায়ব’ এর সংজ্ঞা ও এর প্রকারভেদের বর্ণনা।
‘গায়ব’ হচ্ছে এমন এক অদৃশ্য বস্তু বা বিষয়, যা’ মানুষ চোখ, নাক, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয় সমূহের সাহায্যে উপলব্ধি করতে পারে না এবং যা’ কোন প্রমাণ ব্যতিরেকে সুস্পষ্টভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিধিতেও আসে না। সুতরাং, পাঞ্জাবীদের জন্য বোম্বাই গায়ব বা অদৃশ্য নয়। কেননা হয়তো কেউ নিজ চোখে দেখে বা কারো কাছ থেকে শুনে বলছে যে বোম্বাই একটি শহর। ইহা হচ্ছে ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান। অনুরূপ খাদ্যসামগ্রীর স্বাদ, সুঘ্রাণ ইত্যাদি অদৃশ্য নয়, কেননা এগুলো যদিও বা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। পক্ষান্তরে জ্বিন, ফেরেশতা, বেহেশত-দোযখ এখন আমাদের জন্য গায়ব বা অদৃশ্য। কেননা এগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কিংবা বিনা দলিলে বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা অনুভব করা যায় না।
গায়ব দুই প্রকারঃ
(১) এক ধরনের গায়ব আছে, যা যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক অর্থাৎ প্রমাণাদি দ্বারা অনুভব করা যায়
(২) আর এক ধরনের গায়ব আছে, যা দলিলের সাহায্যেও অনুভব করা যায় না। প্রথম প্রকারের গায়বের উদাহরণঃ বেহেশত-দোযখ এবং আল্লাহ পাকের স্বত্ত্বা ও গুণাবলী। এগুলো সম্পর্কে জগতের সৃষ্ট বস্তু ও কুরআনের আয়াতসমূহ দেখে জ্ঞান লাভ করা যায়। দ্বিতীয় প্রকারের গায়বের উদাহরণঃ মহাপ্রলয় কখন সংঘটিত হবে, মানুষ কখন মারা যাবে, স্ত্রীর গর্ভে ছেলে না মেয়ে, ভাগ্যবান না হতভাগ্য ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান। এগুলো সম্পর্কে দলিল প্রমাণের সাহায্যেও জ্ঞান লাভ করা সম্ভবপর হবে না।
❏ এ দ্বিতীয় প্রকারের গায়বকে (مَفَاتِيْحَ الْغَيْبِ) মাফাতিহুল গায়ব বা ‘অদৃশ্য জ্ঞান ভান্ডার’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ ধরনের গায়ব সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا - إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ
-‘‘তিনি (আল্লাহ) তাঁর গায়বী বিষয়াদি সম্পর্কে কাকেও অবগত করান না, তবে তাঁর মনোনিত রাসূলকে (অদৃশ্য জ্ঞান দান করেন) যাকে তিনি রাসূল রূপে গ্রহণ করে নিয়েছেন।’’
{সূরাঃ জ্বিন, আয়াতঃ ২৬-২৭, পারাঃ ২৯}
❏ তাফসীরে বায়যাবীতে يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ আয়াতটির ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
وَالْمُرَادْ بِهِ الْخَفِىُّ الَّذِى لاَ يُدْرِكُهُ الْحِشًُّ وَلاَ تَقْتَضِيْهِ بِدَايهَةُ الْعَقْلِ
-‘‘গায়ব শব্দ দ্বারা অদৃশ্য বিষয়কে বুঝানো হয়েছে, যা’ ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না ও সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানানুভূতির আওতায়ও আসে না।’’
{ইমাম-বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ১/২৮ পৃ.}
❏ তাফসীরে কবীরে ‘সূরা বাকারা’র শুরুতে ওই একই আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
وَهُوَ قَوْلُ جُمْهُورِ الْمُفَسِّرِينَ أَنَّ الْغَيْبَ هُوَ الَّذِي يَكُونُ غَائِبًا عَنِ الْحَاسَّةِ ثُمَّ هَذَا الْغَيْبُ يَنْقَسِمُ إِلَى مَا عَلَيْهِ دَلِيلٌ، وَإِلَى مَا لَيْسَ عَلَيْهِ دَلِيلٌ
-‘‘সাধারণতঃ তাফসীরকারকদের মতে গায়ব হলো এমন বিষয় যা’ ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে গোপন থেকে যায়। অতঃপর গায়বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ এক প্রকারের গায়ব হচ্ছে- সে সমস্ত অদৃশ্য বিষয়াদি যেগুলোর জন্য দলীলের প্রয়োজন, যেগুলোর অবগতির জন্য কোনরূপ দলীল প্রমাণ নেই।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ২/২৭ পৃ.}
❏ ‘তফসীরে রুহুল বয়ানে’ সূরা বাকারার শুরুতে সেই আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে,
وَهُوَماَ غَابَ عَنِ الْحِسِّ وَالْعَقْلِ غَيْبَةً كَامِلَةً بِحَيْثِ لاَيُدْرَكُ بِوَاحِدٍ مِّنْهَا إِبْتَدَاءً بِطَرِيْقِ الْبَدَاهَةِ وَهُوَ قِسْمَانِ قِسْمٌُ لاَ دَلِيْلَ عَلَيْهِ وَهُوَ الَّذِىْ اُرِيْدَ بِقَوْلِهِ عِنْدَهُ مَفَاتِيْحُ الْغَيْبُ وَقِسْمُ نَّصِبَ عَلَيْهِ دَلِيْلٌُ كَالصَّانِعِ وَصِفَاتِهِ وَهُوَ الْمُرَادُ
-‘‘গায়ব হচ্ছে উহাই, যা’ ইন্দ্রিয় ও জ্ঞানানুভূতি থেকে সম্পূর্ণরূপে এমনভাবে গোপন থাকে যে, কোন উপায়ে প্রথমদিকে স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করা যায় না। গায়ব দুই প্রকারঃ এক প্রকারের গায়ব হলো যা’র সম্পর্কে কোন প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত عِنْدَ مَفَاتِبْحُ الْغَيْبِ এ (আল্লাহর কাছেই রয়েছে গায়বের চাবি সমূহ) এ ধরনের গায়বের কথাই বলা হয়েছে। অন্য প্রকারের গায়ব হলো, যার অবগতির জন্য দলীল প্রমাণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ও তাঁর গুণাবলী।
يُؤْ مِنُوْنَ بِالْغَيْبِ এগুলোর কথাই বলা হয়েছে।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/৩২ পৃ.}
পাঠকবর্গের উপকারার্থে নিম্নের বিষয়টি উপস্থাপন করা গেলঃ
রং চোখ দ্বারা দেখা যায়, নাক দ্বারা ঘ্রাণ নেয়া হয়, মুখ দ্বারা স্বাদ ও কান দ্বারা স্বর অনুভব করা হয়। সুতরাং মুখ ও কানের জন্য রং হচ্ছে গায়ব। অনুরূপ চোখের জন্য ঘ্রাণ হলো গায়ব। যদি কোন আল্লাহর প্রিয়বান্দা ঘ্রাণ ও স্বাদকে বিশেষ আকৃতিতে স্বচক্ষে অবলোকন করেন, তবে এও আপেক্ষিক ইলমে গায়ব علم غائب اضافى হিসেবে গণ্য হবে। যেমন কিয়ামতের দিন কৃতকর্ম সমূহ বিভিন্ন আকৃতিতে দৃষ্টিগোচর হবে। যদি কেউ সেগুলোকে ওই আকৃতিতে এখানেই (এ জগতে) দেখে ফেলেন, তবে এও ইলমে গায়ব বা অদৃশ্য জ্ঞানের আওতায় পড়বে।
❏হযরত গাউছে পাক (رضى الله تعالي عنه) ফরমাচ্ছেন,
وَمَا مِنْهَا شُهُوْرٌُ اَوْدُهُوْرً – تُمُرُّوَتَنْقَضِىْ اِلاَّاَتَالِىْ
অর্থাৎ- এ জগতে কোন মাস বা কাল আমার কাছে এসে আমার অনুমতি গ্রহণ না করে অতিবাহিত হয় না।
এ রকম যা’ কিছু বর্তমানে মওজুদ বা অস্তিত্ববান না হওয়ায় বা অনেক দূরে কিংবা অন্ধকারে থাকার কারণে দৃষ্টিগোচর না হয়, তা’ও গায়ব হিসেবে গণ্য। এ সম্পর্কে জানাটাও অদৃশ্য জ্ঞান।
❏যেমন- হুজুর (ﷺ) ভবিষ্যতে উদ্ভাবিত কিংবা আবিষ্কৃত হবে, এমন সব বস্তু পর্যবেক্ষণ করেছেন বা হযরত উমর (رضى الله تعالي عنه) মদীনা শরীফ থেকে নেহাওয়ান্দে অবস্থানরত হযরত সারিয়া (رضى الله تعالي عنه) কে দেখেছিলেন এবং স্বীয় আওয়াজ তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। অনুরূপ কেউ যদি পাঞ্জাবে বসে মক্কা মুয়াজ্জামা বা অন্যান্য দূরবর্তী দেশসমূহকে হাতের তালু দর্শনের মত স্পষ্ট দেখতে পান, তবে তা’ও গায়বের অন্তভুর্ক্ত হবে।
উপকরণ বা যন্ত্রপাতির সাহায্যে যেই সমস্ত অদৃশ্য বস্তুকে অবলোকন করা হয়, উহা ‘ইলমে গায়বের পর্যায় পড়ে না। যেমন যন্ত্রের সাহায্যে কোন মহিলার গর্ভস্থিত সন্তান বা সন্ততি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় বা টেলিফোন ও রেডিও দ্বারা দূরের আওয়াজ শুনা যায়। এগুলোকে ইলমে গায়বের আওতাভুক্ত করা যায় না। কেননা গায়বের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, যা’ কিছু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় না, তা’ই গায়ব। আর টেলিফোন ও রেডিও মারফৎ শ্রুত আওয়াজ ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে অনুধাবন করা যায়। যন্ত্রের সাহার্য্যে গর্ভস্থিত শিশুর অবস্থা জানাটাও ইলমে গায়ব নয়। যন্ত্রই যখন শিশুর অবস্থা প্রকাশ করে দিল, তখন গায়ব রইলো কোথায়?
মোট কথা, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে যদি কোন অদৃশ্য বা লুকায়িত বস্তু প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমরা উহার সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম হই, তাহলে উহা ইলমে গায়বের পর্যায় পড়বে না।
━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।