শায়খ নজদীর রহস্যময় পরিচিতি
তিনি হাম্বলী মতাবলম্বী ছিলেন। ছিলেন বলা ভূল, দাবি করতেন। হাম্বলী আইম্মায়ে কেরাম এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার নাম মুহাম্মদ। মুহাম্মদ যার নাম, সকল যুগেই ওলামায়ে কেরাম বড় তাজিমের সাথে তার নামখানা নেন। প্রেমাস্পদের নাম। নামের কারণে ব্যক্তিটিও সম্মানিত হয়ে ওঠে। নামটিই (অর্থ) যার সম্মানিত। মালিক আয়ায এর ছেলের নাম ছিল মুহাম্মদ। সুলতান মাহমুদ গজনবী মসনদে। সুলতান বড় আদবের সাথে আদরের সাথে আয়াজের পুত্রকে মুহাম্মদ বলে ডাকতেন। একদিন সুলতান স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে 'আয়াজের পুত্র' বলে ডাক দিলেন। আজ হঠাৎ এ নামে? হুজুরের কি হলো? সুলতানের জবাব, বিনা ওজুতে আপনার ছেলের নাম নিইনা। (১) এভাবেই এ নামের ব্যক্তিগুলোও সম্মানিত।
তবে, শায়খ নজদী এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যেমনিভাবে ধর্ম পালনে, দাওয়াতি পদ্ধতিতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। উম্মতের ইজমাকে উপেক্ষা করে নতুন ধ্যান ধারনায় ইলহামের(!) মাধ্যমে ধর্মকে নতুন রুপে সাজানোর ক্ষেত্রে, মোটকথা সর্বত্রই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। যে নামে জগত পাগল সে নামটিকে তার সাথে নিসবত করাকে অনেকে রীতিমত অপছন্দই করেন। তিনি (মুহাম্মদ) ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী। নজদ তার জন্মস্থান। আরবী ব্যকরন অনুযায়ী ব্যক্তির পরিচিতি জন্মস্থানের সাথে নিসবত করা হয়। শহরের নামের সাথে (وى) যোগ করে। যেমন, খুলনার বাসিন্দা হলে খুলনবী, দিল্লির বাসিন্দা হলে দেহলবী। মুসলিম সমাজে তিনি পরিচিত শায়খ নজদী নামে।
হাম্বলী মতাবলম্বী তৎকালীন খ্যাতনামা আলেম ছিলেন সুলায়মান ইবনে আবি শরফ। তাঁর ছেলে আব্দুল ওহাব ইবনে সুলায়মান ও ছিলেন বিশিষ্ট আলেম এবং শিক্ষক। হুরাইমিলাতে তাঁর বিদ্যাপীঠ ছিল। আব্দুল ওহাবের দু'সন্তান মুহাম্মদ (শায়খ নজদী) এবং সুলায়মান ইবনে আব্দুল ওহাব। শিক্ষিত এবং আলেম পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে তারা দু'ভাই লেখাপড়া করার যথেষ্ঠ সুযোগ পেয়েছিলেন। মানবের দিশারী ﷺ যে জ্ঞানার্জনের প্রতি এতটা জোর দিলেন "তোমরা জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন যাও"।(২) সে জ্ঞান সুধা পান করার মানসে এ আদেশকে উম্মত যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী হৃদয়ে লালন করে আসছে।
১১১৫ হিজরি (১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দ) সনে নজদের (বর্তমান রিয়াদে) দক্ষিণাঞ্চলীয় হানিফা উপত্যকার উয়ায়না নামক স্থানে (৩) বনু তামিম গোত্রে তার জন্ম। শায়খ নজদীর জন্মস্থান থেকে শুরু করে গোত্র, মতবাদ, মতবাদ প্রচার প্রসার সবকিছুই রহস্যে ভরপুর। পাঠক সমাজ তার জীবনী, মতবাদের ইতিহাস পড়লে নিজেই তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ইবনে আলাভী শাফেয়ী শায়খ নজদীর গোত্রীয় পরিচয়ে বলেন, তিনি নজদ শহরের বনু তামিম গোত্রের জন্মসূত্রীয় (৪)। শায়খ নজদী প্রখ্যাত মুনাফিক যুল খুয়াইসারা আত-তামিমীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার কর্মকাণ্ড সমূহ এবং প্রিয় নবিজীর ﷺ হাদিসের দিকে লক্ষ করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়।
হুনাইনের যুদ্ধের গণিমতের মাল বন্টন করছিলেন রাসুলে আরাবী ﷺ। যুদ্ধলব্ধ সোনারুপা ইত্যাদি। এগুলো ছিল হযরত বিলালের কোলে। বাটোয়ারা একজনের পছন্দ হলো না। বলে উঠলো,
- হে মুহাম্মদ! ইনসাফ করুন। আপনি ইনসাফ করছেন না।
আমার নবির মুখ মলিন। এমন অপবাদ কালিমা পড়া মুসলিম কতৃক এই প্রথম।
- আমি যদি ইনসাফ না করি কে ইনসাফ করবে? তবে, তুমি হতভাগা।
ফারুকে আজম রাঃ দাড়িয়ে গেলেন। তরবারী বের করে ফেললেন।
- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দিই।
- আমার নবি ﷺ থামালেন। ইরশাদ করলেন, তার বংশ থেকে এমন একটি দলের উদ্ভব হবে, যারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা এমনভাবে ধর্মচ্যুত হবে, যেমন ধনুক থেকে তীর শিকারের দিকে দ্রুত ছুটে যায়। (৫)
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ বর্ণিত এ হাদিসে যে গোত্রটির কথা এসেছে, সুনিশ্চিতভাবে সে গোত্রটি বনু তামিমই। যুল খুয়াইসারা ছিল তামিম গোত্রের। শায়খ নজদী তারই যোগ্য উত্তরসূরী।
শায়খ নজদী শিক্ষাগ্রহণের নিমিত্তে হিযায তথা মক্কা, মদিনা, বসরা সহ বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করেন। হুরাইমিলা শহরে পিতার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। উয়াইনাতে কয়েকজন নেককার শিক্ষকের সহবত লাভ করেন। হিযাযে অবস্থান কালে ইবনে সাইফ ও হায়াত মুহাম্মদ সিন্ধি নামে দুজন লা-মাযহাবী (যারা কোন মাযহাব মানেনা) আলেমের সান্নিধ্য করেন। বসরার মুহাম্মদ আর মাজমুয়ীর কাছে কিছুদিন অবস্থান করে জ্ঞানার্জন করেন। এ সকল আলেমদের সোহবত তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা স্বত্বার প্রকাশকে ত্বরান্বিত করে এবং ধীরে ধীরে বিদ্রোহী করে তোলে। শান্তিপ্রিয় পিতার শিষ্যত্বেও তিনি অশান্ত হয়ে ওঠেন। বিদআত বিষয়ে পিতার সাথে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হন। পিতা পুত্রের ভাবধারা, কর্মকাণ্ড আঁচ করতে পেরে মানুষদের তার থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিতেন। মূলত শায়খ নজদী নিজ ধ্যানধারণার ব্যক্তিদের পেয়ে যান এবং তাদের থেকে ইবনে তাইমিয়ার কিছু বই শিক্ষা লাভ করে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। প্রকাশ্যে বহু ইসলামি কার্যকলাপকে শিরিক বিদআত বলা শুরু করেন। যদিও পিতার ভয়ে এবং সম্মানের দিকে তাকিয়ে তাঁর বর্তমানে নিজ মতবাদ প্রচারে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি শায়খ নজদী।
১১৪০ হিজরী। পিতা আব্দুল ওহাব মৃত্যুবরণ করেন। এবং শায়খ নজদী পরিপূর্ণ ভাবে তার মতবাদের দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। এমন মতবাদ, যা ইসলামি বিশ্বাসে নতুন। ইতিহাসে অদ্বিতীয়। যা আজ তিনশত বছর পরেও পাঠকদের চোখ কপালে তুলবে। যার শুরু মুসলিমদের মুশরিক ফতোয়ায় এবং শেষ হত্যা এবং ধন সম্পদ লুন্ঠনে। শায়খ নজদীর বিশ্বাস ছিল আরব উপদ্বীপে সবাই শিরকে লিপ্ত এবং মুশরিক হয়ে গেছে। কারণ,
- তারা আম্বিয়া আলাইহিস সালাম তথা প্রিয় নবিজীর ﷺ কাছে শাফায়াত কামনা করে।
- তারা মাযার সমূহকে যিয়ারত করে এবং সম্মান প্রদর্শন করে।
- নবী-ওলীদের ওসীলা নিয়ে দোয়া করে এবং সাহায্য প্রার্থ্যনা বৈধ মনে করে।
কুরআন-সুন্নাহ থেকে যা প্রমাণিত, সাহাবায়ে কেরামের জামানা থেকে যে আমলসমূহ চলে আসছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী। শায়খ নজদী ও তার অনুসারীরা এ সমস্ত কাজকে মুর্তিপূজার সাথে তুলনা করেন। ঘোষণা করেন, সমগ্র আরব উপদ্বীপের সকলেই গায়রুল্লাহর ইবাদত করছে, সকলেই মুশরিক। এবং এ কারণে মুসলমানদের হত্যা করা এবং তাদের ধন সম্পদ লুন্ঠন করা বৈধ মনে করতেন। শিরক অপবাদে অভিযুক্ত করে, হত্যার বৈধতা দিয়ে তরবারির জোরে স্বীয় মতবাদের প্রচার প্রসারে লিপ্ত হন।
মেধাবী ছিলেন। ১০ বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হন। স্বীয় মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে রচনা করেছেন কিছু কিতাবও। সঙ্গীদের ও আদেশ দিতেন কিতাব রচনার। তার মূলনীতি ছিল, নিজের মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবে। পূর্ববতী কিতাবের অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকবে বরং সেগুলো পুড়িয়ে দিতে হবে। শায়খ নজদী মনে করতেন এ সকল কিতাবে মনগড়া কথা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এবং শিরকের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কিতাবুত তাওহীদ এবং কাশফুশ শোবহাত তার প্রসিদ্ধ দুটি কিতাব।
কাশফুশ শোবহাতে হত্যার বৈধতায় শায়খ নজদীর ভাষ্য,
- তোমরা অবশ্যই অবগত আছো, এসমস্ত লোকের তাওহীদের ব্যাপারে স্বীকৃতি তাদেরকে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত করেনি। আর ফেরেশতাগন, আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালাম ও আউলিয়া কেরামের নিকট সুপারিশ প্রার্থ্যনা ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনোবৃত্তি পোষন করার কারণে তাদেরকে হত্যা করা ও তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা বৈধ করে দিয়েছে। (৬)
জীবনের কিছু সময় তিনি বসরায় অতিবাহিত করেন। বসরায় অবস্থানকালে মুসলিমরা তার নিকট বিভিন্ন মাসয়ালার বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। এ ব্যাপারে শায়খ নজদীর একটি বক্তব্য,
- কোন কোন 'মুশরিক' আমার নিকট এসে বিভিন্ন মাসয়ালা জিজ্ঞেস করে। আমার উত্তর শুনে তারা লজ্জিত ও তাজ্জব হয়ে পড়ে। (৭)
মুসলমানদের এভাবে ঢালাওভাবে কাফির, মুশরিক বলা তার মতবাদের রীতি হয়ে পড়ে। বিগত ৬০০ বছরের সকল মানুষকে তিনি মুশরিক বলে ঘোষনা করেন। তার দাওয়াতী কার্যক্রমের সামনে একটি মূলা ঝুলানো ছিল। 'তাওহীদের সংরক্ষণ '।
"নিশ্চয় শয়তান আরব উপদ্বীপে মুসলমান কতৃক তার ইবাদত করা থেকে তথা শিরক করা থেকে নিশ্চিতভাবে নিরাশ হয়ে পড়েছে। তবে সে মুসলমানদের পারষ্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত রাখার চেষ্টা করবে" (৮) প্রিয় নবিজীর ﷺ এ ভবিষ্যদ্বাণীর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থার ঘোষনা দেন শায়খ নজদী। হাদিসকে যিনি তোয়াক্কা করেন না, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ যিনি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন তার এমন আচরণ যদি পাঠকবৃন্দকে খুব আশ্চর্যান্বিত করে। তবে, প্রিয় নবিজীর সে বাণীটি স্বরণ করুন "তারা এমনভাবে ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর শিকারের দিকে দ্রুত ছুটে যায়।"
————————————
টীকাঃ
* প্রধান তথ্য উপাত্তঃ নজদ ও হিজাযের ইতিহাস, কৃত- মুফতি আব্দুল কাইয়ূম কাদেরী
১. শানে হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-২৪৯। তাফসীরে রুহুল বয়ানের সূত্রে ما كان محمد ابا احد এর ব্যাখ্যায়।
২. ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ইমান; খতিবে বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ; ইবনুল বার্ ত্বদীয় কিতাবে। বায়হাকি বলেন- হাদিসের সনদ দ্বয়ীফ, তবে মতন মশহুর।
৩. মাসুদ আন নদভী রচিত 'মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব' ২৪ পৃষ্ঠা। সরদার মুহাম্মদ হাসানী 'হাযাতে সুলতান আব্দুল আযীয আল সাউদ, ৪০-৪২ পৃষ্ঠা।
৪. আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে আলাভী ইবনে মুহাম্মদ আল-হাদ্দাদ আশ শাফেয়ী তাঁর خلاء الظلام فى رد على النجدى الذى اضل العوم (জালাউয জলাম ফির রদ্দে আলা নাজদিয়্যিল লাযী আদাল্লাল আউয়াম) গ্রন্থে।
৫. বুখারী ৩১৩৮, মুসলিম ১০৬৩, আহমাদ ১৪৩৯০, ১৪৪০৫, ইবনে মাজাহ ১৭২। জাবের রাঃ সহ আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকেও সহীহ সনদে অনুরূপ হাদিস এসেছে।
৬. শায়খ নজদী রচিত 'কাশফুশ শোবহাত' পৃষ্ঠা ২০-২১।
৭. শায়খ আব্দুল গফুর আক্তার রচিত 'ইবনে আব্দুল ওহাব'- পৃষ্ঠা ৩০।
৮. মুসলিম শরীফ ২৮১২, মসনাদে আহমদ ১৪৪০৬, দালায়িলুন নবুওয়ত ৬:৩৬৩, শুয়াবুল ইমান ৬৮৭৭, সুনানে তিরমিযী ১৯৩৭।