কপিরাইট ছেড়ে দেয়া ও ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে লেখার কিছু কৌশল বিষয়ক
-----
জ্ঞানী কীভাবে তৈরি হন? জ্ঞান নিতে নিতে।
কিন্তু প্রজ্ঞাবান কীভাবে তৈরি হন? জ্ঞানের নির্যাস উপলব্ধি ও অণ্বয়ের মাধ্যমে নিজের কর্মনীতির ভিতরে নিতে নিতে।
তেমনি গবেষক ও চিন্তক কীভাবে তৈরি হন? প্রজ্ঞার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে।
সবকিছুর জন্যই তৈরি হওয়ার পদ্ধতি আছে। বডিবিল্ডার? হাতটাকে বিভিন্নভাবে নাড়ায় ও স্ট্রেস দেয় বলেই না হাতের পেশী ফোলে। কার রক্ত তৈরির কোষগুলো সবচে তরতাজা এবং সবচে অ্যাক্টিভ? যে নিয়মিত রক্ত দেয়। আমার ইমাম আ’লা হযরত মাঝ বয়সে এসেই দিনে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমাতেন। কেন? তিঁনি ২২ ঘন্টা কাজ করেও কুলাতে পারেন না। তিনি তো শারীরিক ও ইন্টেলেক্টের দিক দিয়ে সুস্থই ছিলেন। বরং তাঁর পারফরম্যান্স বেশি কেউ আজো স্পর্শ করতে পারে না। এক ঠেলায় কিন্তু তিনি ২ ঘন্টা ঘুমানো শুরু করেননি বলে জানি। আমার শিক্ষক ড. ম্যাক ইউরীর পায়ের হাড় সাধারণ মানুষের পায়ের হাড় থেকে অনেক মোটা। এমনকি তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের যে রগগুলো আছে, আমি কাছ থেকে বহুবার লক্ষ্য করেছি, সেই রগগুলোও অনেক বেশি ফোলা। কারণ কী? তিঁনি মস্তিষ্কে বেশি স্ট্রেস ফেলেন বলেই তো। বেশি ব্যবহার করেন বলেই তো মস্তিষ্কের বেশি রক্তের প্রয়োজন হয়। তাঁর পায়ের ওই হাড় কেন অনেক বেশি পুরু হয়েছে? কারণ ওই হাড়ে হাজার হাজার মাইক্রোফ্রাকচার হয়েছে। এখন তাঁর পা এত শক্তিশালী যে, দশটা পা যে আঘাতে ভেঙে যাবে, সেই আঘাতেও তাঁর পা কিছু হয় না। একের পর এক ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। আমার আরেক শিক্ষক শহীদ আল বোখারীও মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমান। কেন? কাজ করেই কূল পান না। দিন তো মাত্র ২৪ ঘন্টায়। এর মধ্যে যদি ২২ ঘন্টা কাজ করা যায়, তাহলেই না সৌভাগ্য। এক ধাক্কায় না। বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে লেভেল তৈরি হয়।
কপিরাইট ছেড়ে দেয়ার পেছনে কিছু কারণ তো আছেই। প্রথম কারণ, আমরা কোন কিছুরই মালিক নই। আমরা বড়জোর কেয়ারটেকার, বড়জোর ইউজার। বিশেষ করে যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ.’র বিষয়ে কিছু লিখি, সেটার মালিক অবশ্যই নই।
কপিরাইট ছাড়ার আরেকটা কারণ, কপিরাইট ছেড়ে দেয়া মানে ইন্টেলেক্টের বন্যা হওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়া। আমি যদি কপিরাইট ধরে রাখি, আপনি বাধ্য হুবহু পোস্টটা কপি করতে এবং আমার নাম মেনশন করতে। এখানে ক্রিয়েশনটা কোথায় হল? অগ্রগতিটা কোথায় হল? যদি কপিরাইট ছেড়ে দিই, তবে এইযে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির মালিক আপনিও হয়ে গেলেন, এইবার খেলা হবে। কাচ্চা অক্ষরগুলো শুধু কপি করুন, এবার খেলুন।
লেখালেখি তো এভাবেই হয়। শুধু লেখালেখি নয়, যে কোন ইন্টেলেকচুয়াল অগ্রগতি কীভাবে হয়? এক্সিস্টিং বিষয়ের উপর সওয়ার হওয়ার মাধ্যমে। চাকা পুনরাবিষ্কার করার কিছু নেই। চাকা হাজার বছর আগে আবিষ্কার হয়ে বসে আছে। এখন আমাদের আবিষ্কার করতে হবে টায়ার কম ক্ষয় হওয়া ও কম পাংচার হওয়ার বিষয়ে। ইন্টেলেক্ট প্রসারিত হয় ব্যাখ্যা করাতে। বিশ্লেষণ করাতে। টীকা তৈরি করাতে। পুরনোকে নতুন আলোকে দেখাতে। একটা অলরেডি এক্সিস্টিং বিষয়কে পুরো ভিন্ন ক্ষেত্রে অ্যাপ্লাই করাতে। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কখনো থামার বিষয় নয়।
প্রিয় ভাইবোনরা মাঝে মাঝে লেখা কপি করে পোস্ট করেন, আমার প্রচন্ড আনন্দ হয়, প্রচন্ড কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। যদি হুবহু পোস্টটাকে কপি না করে বরং পোস্টের ভাষ্যের উপর আরো ভাষ্য এবং ক্ল্যারিফিকেশন নিয়ে নতুন নতুন লেখা দেন, সেটা হতে পারে তৎক্ষণাৎ- তখন ইন্টেলেকচুয়ালি তা নতুন দিগন্ত নিয়ে আসবে। অনেকে আমাদের লেখা বোঝেন বহু কষ্টে, আপনি যদি সেই লেখাকেই ২০% এক্সপান্ড করলেন বা ২০০% এক্সপান্ড করলেন... সেটা একটা নতুন ডাইমেনশন আনবে। নতুন একটা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ক্রিয়েট হবে।
ধরুন, শাহবাজি হজরতের একটা লেখা আছে ৫ লাইনের। আপনি ৫ লাইন কপি করলেন, এরপর এই ৫ লাইনের ভিতরে আরো ১-২-৩-৪-৫-৬-৭ লাইন যুক্ত করলেন অরিজিনাল ৫ লাইনের আলোকেই। এখন যে লেখাটা তৈরি হল, সে লেখাতে আপনি শাহবাজি হজরতকে ট্যাগ করলেন এবং বললেন, ‘সাইয়্যেদ শাহবাজি হজরতের লেখার আলোকে’... ব্যস, নতুন একটা ক্রিয়েশন হল। এক্সপানশন হল।
(আমার বেলায় ট্যাগ বা নাম মেনশন করা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়)।
আমি তো এই উসুলেই কাজ করি। ধরুন আমি ২ টা সূফি বইয়ের কথা লিখেছি। আপনি আরেকটা পোস্ট দিয়ে লিখেছেন চমৎকার আরো ১২ টা সূফি বইয়ের নাম। এখন আপনি চাইলে মূল পোস্টের অংশটাকেও এভাবে রিকন্সট্রাক্ট করতে পারেন।
কপিরাইট নেই। কেন নেই? মূল কারণ মাত্র একটা। এই লেখাকে মানুষ রিকন্সট্রাক্ট করুক, অ্যাব্রিজ করুক, এক্সপান্ড করুক, মাল্টিডাইমেনশনাল করুক, নিজের নামে, কোন প্রতিষ্ঠানের নামে বা লেখকের নামে দিক বা কারো নামেই না দিক। কপিরাইট উন্মুক্ত করা মানে ইন্টেলেক্টের স্রোতকে নিজের মত চলতে দেয়া।
আমি অনুবাদের বেলায় কী করি? যদি সেটা কোনও দায়িত্বশীল অনুবাদ হয়, তবু আমি ভাষা নিজের মত লিখি। বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন, প্যারাগ্রাফ কন্সট্রাকশন এমনকি মাঝে মাঝে তথ্যের বিন্যাসও বদলে দিই। আর যদি দায়িত্বশীল অনুবাদ না হয়, তবে তো কথাই নাই। কী রাখব, কতটুকু রাখব, কোথায় রাখব, কোথায় নতুন তথ্য যুক্ত করব- কোন গ্যারান্টি নাই। এর কারণ মাত্র একটা। অসংখ্য মানুষ আছে, যারা হয়তো জীবনের কোন না কোন সময় একই জিনিস বাংলা এবং ইংরেজিতে পড়বে। আমার কথা হল, সে যেন ইংরেজিটা পড়ার পর বাংলা পড়লে কখনো এ অনুসিদ্ধান্তে না আসে, যে, কিছু পেলাম না। আগেই ছিল এটা। নতুন কিছু থাকবে। এটাই সম্পদ সৃষ্টি করা। অনুবাদটা তো শুধু সম্পদ নয়, অনুবাদের সাথে ওইযে আরো কিছু যুক্ত হওয়া, সেটা সম্পদ।
আবার দেখুন, কারো পোস্ট কপি করার বেলায় কী করি, সাধারণত ফানি কিছু হলে হুবহু তুলে দেই। নাহলে পোস্টটাকে কপি করি, কপি করার পর সেটার ভিতর ভিতর এডিট করতে থাকি। সবশেষে লিখে দিই ওই ভাইয়ের পোস্ট অবলম্বনে। কী হল, নতুন ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ক্রিয়েট হল। স্থবিরতার বদলে প্রবাহ তৈরি হল।
একটা লাইন হলেও বদলে দিন। একটা কথা হলেও বদলে দিন। কারণ সবাই ভ্যালু অ্যাড করার মতন দক্ষ নন, আপনি ভ্যালু অ্যাড করার মতন দক্ষ হলে এখনি করুন। যদি দক্ষতাটা না থাকে, খেলতে খেলতেই হবে। একটা অক্ষর হলেও ভ্যালু অ্যাড করুন। রিকন্সট্রাক্ট করুন, ডিকন্সট্রাক্ট করুন।
স্রোত তৈরি হোক।
ভেসে যাক মনের বদ্ধতা। এরচে বড় কষ্টের আর কী থাকতে পারে! মানুষের মন যদি বদ্ধ হয়, মানুষের ইন্টেলেকচুয়াল ডাইমেনশন, মানুষের বুঝতে পারার জায়গা যদি সীমিত হয়! চর্চা চাই।
চর্চায় স্রোত তৈরি হবে।
ভেসে যাক কুসংস্কার।