এই মানুষগুলো যাবে কোথায়?
-----

নারকেল পিস করে বিক্রি করে না? ওগুলো খেতে ভাল লাগে। চলতি পথে কিনতে গিয়েছি একটু দূরের এক দোকানে। দেখে চিনিনি, তিনি কে। সেই ছেলেবেলায় তাঁর দোকান থেকে নারকেলের টুকরা কিনে খেতাম। সম্পর্কে‍ আমার বাবার কাজিন হন। বাড়ি বিক্রি করে একটু দূরের চরাঞ্চলে বাড়ি করেছেন। সেই একই রকম দোকান, টঙ ধরনের। টুকটাক টঙ দোকানের মুদি আইটেম বিক্রি। বহু বছর দেখিনি, গ্রামের বাড়ি থাকা হয়নি বহু বছর।

নারকেলের শক্ত খোলসটা বাইরে থেকে ঠুকরে ঠুকরে তিনি সরিয়ে ফেলেন। তারপর আস্ত নারকেলটাকে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা। পানি তো আর বিক্রি হয় না। নারকেলটা ৪০ টাকাই পড়ে সব মিলিয়ে। জিনিসটা তিনি কতদূর থেকে কত টাকায় কিনে কীভাবে বয়ে এনেছেন? ঠুকরে ঠুকরে জিনিসটা টুকরা করতে তার কতটা সময় লেগেছে? বিক্রি করতে কয় ঘন্টা যায়? তারপর এই ৪০ টাকার মধ্যে তাঁর থাকে কত? ২৫ টাকার নিচে তো আর কেনেননি। সম্ভব না। ১০-১৫ টাকার গ্যাপের জন্য কয় কিলোমিটার দূর থেকে ভারি জিনিসগুলো বয়ে এনে কতক্ষণ ঠুকরে টুকরা বের করে বিক্রি করেন?
এই মানুষটা আগে আর্থিকভাবে কেমন ছিলেন, এখন কেমন আছেন? কী খান? পরিবারের সদস্যদের কী খাওয়ান? আগে চেহারা সুরত পোশাক আশাকে একটা যেল্লা ছিল। নাহ, যৌবনের কথা বলছি না। একটা সুখের পরিচয় সবকিছুতে ছিল। বিক্রি সেই একই জিনিস করতেন। এখন কেমন যেন বিদ্ধস্ত। কেমন যেন ক্ষতবিক্ষত একটা শরীর টেনে চলেন। অসুস্থ না। কিন্তু ভিতরে বাইরে ক্ষতবিক্ষত।
বিষয়টা ভাবালো খুব।

বাড়ির কাছে বলাই ‘ডাক্তার’ এর অষুধের দোকান আজো আছে। সেই আমাদের ছেলেবেলায় তিনি যে অষুধ বিক্রি করতেন, আজো তা-ই করেন। বিক্রি হয়তো কিছুটা কমেছে। খুব একটা তফাত নয়। কেমন যেন কুকড়ে মুকড়ে চলেন। আগের সেই টানটান ভাবটা নেই।

বলাই ‘ডাক্তার’ কি আজো নিজের বাসায় দেশি ফল কিনে নিয়ে যান? অসম্ভব। ফার্মেসিতে আজো পত্রিকা একটা রাখেন অবশ্য। সম্ভ্রান্ত, পরিপাটি ভাবটা আজো আছে অবশ্য। কিন্তু বলাই ডাক্তারের যে কিছুই নাই, তার প্রমাণ তার প্রায় খালি ফার্মেসি। বেশি করে অষুধই তুলতে পারেন না, গলির বাইরে একটা দোকানই নিতে পারেন না, আর সেই আগের মত বাসায় ফল ফলাদি কিনে নিয়ে যাওয়া?

কাল ও আজ সন্ধ্যায় ভাপা পিঠা খেলাম। ‘ঘেঁগি’ ছিলেন জবরদস্ত পিঠা বিক্রেতা। তারই বোনঝির পিঠা দোকান। খুব খুব খাতির করলেন দুদিন-ই। জোর করে গুড় বাড়িয়ে, গুঁড়ি বাড়িয়ে ভাপা পিঠা আলাদা করে বানিয়ে দিলেন। আগে বানানোগুলো দেবেন না।

বুঝলাম না, তার এই গুড়, এই চালের গুঁড়ি, এই লাকড়ি খড়ির খরচ- এগুলো দূর থেকে কিনে আনা, বয়ে আনা, পরিশ্রম করে প্রসেস করা, চুলা জ্বালিয়ে আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা, তারপর বিক্রি করা! বললাম, এই ভাপা পিঠা ৫ টাকায় বিক্রি করেন কীভাবে!

তিনি বললেন, সামান্য লাভ হয়। দাম বাড়ালে মানুষ খাবে না।
পাশে থাকা আমার কাজিন বলল, এটা তাঁর বাড়ির ঠিক বাইরে। পিঠা বানান, না বানালে আর কী করবেন, তাই আজো বানান।

খাস্তা সিঙাড়া বানান একজন। ছেলেবেলায়ও খেতাম। খাস্তা সিঙাড়া সবাই বানাতে পারে না। সিঙাড়ার খোলসটা পরতে পরত সাজানো, কামড় দিলে মুখের ভিতর অদ্ভুত আরাম বোধ হয়। ৩ টাকা পিস বিক্রি করেন, তাও আবার দুটা নিলে ৫ টাকাই রাখেন! লজ্জা লাগে ১ টাকা কম দিতে, কিন্তু কিছু বলতেও পারি না। মনে হয়, এই ১ টাকা বাড়িয়ে দিতে গেলে তাকে অপমান করা হবে।

তিনি যে বড় মানুষ, ১ টাকা কম রাখছেন, এটা ফিরিয়ে দিলে তার আভিজাত্যে লাগবে। সেই বড়মানুষিটা এখনো আছে তার, কিন্তু তার পোশাক আশাক নড়াচড়া আগের মতন নাই। কেমন যেন দিনদিন পোশাকগুলো নিম্ন থেকে নিম্নতর মানের হয়ে পড়ছে।

আরো এক ভাজাপোড়া রেস্তোরার মালিক কথায় কথায় বললেন, ৩ টাকায় যে পুরিগুলো বিক্রি করি, দুজন কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া, কারেন্ট বিল আর জিনিসপত্রের দাম- আমার ব্যবসায়ী হিসাবে লাভ তো দূরের কথা, আমার বেতনও ওঠে না প্রতি মাসে। কী করব, যা করতে পারি, যা করছি, তাই তো করতে হবে।

আচ্ছা, এই মানুষগুলোর পাপটা কোথায়?
তারা তো চোর না। তারা যে কম পরিশ্রমী তাও তো না। সেই ভোর থেকে দোকানের কাজকর্ম যোগান শুরু করেন, দোকান বন্ধ করেন সেই মাঝরাতে। এরা দিনে দিনে শরীরের সবদিকে শুকিয়ে যাচ্ছেন কেন! এদেরকেই তো আগে গ্রামের বাজারে, ভ্যানে করে বিক্রি করতে আসা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ইলিশ কিনতে দেখতাম, দেখতাম সস্তার দেশি ফল কিনতে, দেখতাম পরিষ্কার ও চকচকে পরিপাটি জামাকাপড় পরতে। মুখে পান পুরে গল্প করতে করতে হাসতে দেখাতম যাদের, এরা সেই লোকগুলো না? এদের প্রত্যেকের পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলগুলো কোথায় গেল? দেশে কি মানুষ আর চামড়ার স্যান্ডেল পরে না? পরেই যদি, এদের দোষটা কোথায়? এদের পাপটা কোথায়?

তার পায়ের চামড়ার স্যান্ডেল কোন্ শুওরের বাচ্চা কেড়ে নিল? তার সন্তানের মুখ থেকে ডেউয়া, কাঁঠাল, আতা, বরই কে কেড়ে নিল? তাদের অনেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে, শহরে যায় না। কারণ, হেঁটে গেলে তাদের কারো কারো সম্মান থাকে না, যেমন বলাই ‘ডাক্তার’। রিকশা তো দূরের কথা, অটোতে যে ১০ টা টাকা বাড়তি দিয়ে যাবে, সেই বাড়তি ১০ টাকা তো তার স্ত্রীর মুখের খাবার।

আসলে এসব কথার পয়েন্টটা কোথায় জানেন?
এই মানুষগুলো কিন্তু প্রকৃত মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ছিল। তারা সেদিন যা বিক্রি করতো আজো তা করে। যে পরিমাণে করতো, সেই পরিমাণেই করে। তাহলে সেদিন তাদের মুখে যে সুখের হাসি লেপ্টে থাকতো, সেটা কেন থাকবে না?‍

তারা দাম বাড়াতে পারে না কেন? কারণ তাদের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতায় কুলাবে না। তাদের এবং তাদের সকল ক্রেতার এই অবস্থা কে করল? কেউ তো করেছে? টান দিয়ে শুষে কেউ তো নিয়েছে?

হায়রে, রিকশা নিয়ে নেমেও যেতে পারে না। এরা স্থানীয়। সমাজে একটা মুখ আছে, সেটা লুকাবে কোথায়? হঠাত করে তো মাছ বিক্রেতাও হয়ে যেতে পারে না, মাংস বিক্রেতাও হয়ে যেতে পারে না।

যে দেশে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পর্যন্ত ধীরে ধীরে চরম হতদরিদ্র না খাওয়া প্রায় ভুখা নাঙা মানুষে পরিণত হয়- হাজারো চেষ্টা করার পরও, প্রতিদিন ভোর থেকে মাঝরাত খেটেও, সেই দেশে কি আল্লাহ্’র গজব পড়া দেখতে আর বাকী থাকবে?

এরাতো চোর না।
গ্যাপটা কই? এরাতো ডাকাত না। এরাতো ভালমানুষ। জন্ম থেকে মানুষের সেবা করে গেছেন। আমি নিশ্চিত, এরা না নিজে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে পায়, না পরিবারকে খাওয়াতে পারে, কালকে অসুস্থ হলে কী করবে? এদের পাপটা কোথায়?

সমাজে অতিধনী এবং অতিদরিদ্রর গ্যাপ এইভাবে ভয়ংকর হারে বাড়াই যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে স্বাভাবিকে কোন ভয়ানক অস্বাভাবিকতা আছে।

অনেক আগে, ছেলেবেলায় ঘুঘনি খেতাম যে লোকটার কাছে, পরশু সন্ধ্যায় আবার তাকে থামালাম। অবাক হয়ে চেয়ে দেখি তার সেই বিখ্যাত বুটের ডালের স্ন্যাকসের উপর থরে বিথরে সাজানো পেঁয়াজকুচি। বললাম, এগুলা পিঁয়াজ?
বললেন, হু, দেশি পিঁয়াজ। এক কেজি।
বললাম, এক কেজি? কত করে কিনেছেন?
২২০ থেকে ১৮০ করে কেনেন।
বললাম, এক কেজি কুচি করে বিক্রি করছেন বুট?
বললেন, হু। আগেও এক কেজি, এখনো এক কেজি। যাই হোক, স্বাদে হেরফের করব না। যত দাম হোক।

আলুর দম খেতে গেলাম কাল সন্ধ্যায়। সেখানেও পেঁয়াজ দেখে থমকে গেলাম। বললাম, পেঁয়াজ কেন? ভয় লাগে তো। ছেলেটা বেশ হাসি দিল। ১০ টাকায় দুটা ইয়া বড় বড় আলু দেয়। কী স্বাদ! বললাম, আলু কেজি কত? এত্ত এত্ত মসলা দিতে দিতে বলল, ৩০ টাকা কেজি। খাবার ইচ্ছা চলে যাচ্ছিল। কী সুন্দর করে পাকিয়েছে আলুর দম। কী সুন্দর মসলা দেয়া, পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা। তার উপর কাঁচা পেঁয়াজও রেখেছে।

চোরের বাচ্চারা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ বাড়ায়, পেঁয়াজ ছাড়া তো মানুষ বাঁচবে না। সম্ভব না, হয় না। এটা আমাদের খাবারের মৌলিক ‍উপাদান। চাল বাড়ায়, ডাল বাড়ায়, লবণও বাড়ায়। শুওরের বড় বাচ্চারা এগুলো বাড়াতে দেয়। শুওরের ছোট বাচ্চারা সিন্ডিকেট করে চামড়া ২০ টাকা পিস নেয়, হাজার হাজার টন চামড়া পচিয়ে দেয়, তারপর আমাদের বাংলাদেশের পরিশ্রমী, সেবী, ভাল মানুষরা হাজার বছরের পুরনো টাইপ প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরে। লানত তোর সিন্ডিকেটের উপর। আল্লাহ্, ফিরিশতা ও সৃষ্টিকূলের লানত।

তোরা আমাদের সেবক-ধরনের ভাল মানুষগুলোকে ‍চামড়ার স্যান্ডেলও পরতে দিবি না, পেয়াজও খেতে দিবি না, সরষের তেলও কিনতে দিবি না, চালও খেতে দিবি না, ডালও না, লবণও খেতে দিবি না- এই টাকা দিয়ে কী করবি?

সারা দেশের সব মানুষকে একসাথে মেরে ফেলছিস। একটু একটু করে চেপে চেপে মেরে ফেলছিস। যারা চোর না, যারা নেশাসক্ত না, যারা জুয়ায় আসক্ত না, যারা রাজনীতি করে না, যারা কাউকে মারে না, ধরে না, ভ্যাগাবন্ডের মত ঘুরে না বেড়িয়ে সকাল থেকে রাত মানুসের সেবা করে, তাদের মেরে ফেলছিস? তাদের সবাইকে মেরে ফেলছিস চেপে চেপে?

খুব পদ্ধতিগতভাবে? তোরা কিছু মানুষ মিলেঝুলে সব শেষ করে দিচ্ছিস? কেউ কিছু বলতেও পারবে না। কেউ কিছু করতেও পারবে না। কেউ কিছু বলবে না। কী বলার আছে? তার আয়ে কুলায় না দেখে সে চামড়ার স্যান্ডেল পরে না, তাহলে লক্ষ টন চামড়া পঁচল কোন্ দোষে? হাজারো টন পেঁয়াজ পচল কোন্ দোষে?

জগতের সকল পাপ তোর কাঁধে রে। এই জগতে পাবি, নয়তো পরজগতে। কোনও দান, দয়া দাক্ষিণ্য তওবা এস্তেগফার নামাজ রোজা হজ যাকাত ফেতরা স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা বড় বড় স্থাপত্য বা মুখের হাসি চোখের কান্না- কোন কিছুই তোকে এই পাপ থেকে বাঁচাতে পারবে না।

তুই যে-ই হোস্, এই মানুষগুলোকে চেপে ধরে মেরে ফেলার দায় তোকে শোধ করতে হবে। তুই মজুতদার হোস, মজুতদারের পোলা হোস, আমলা হোস, শামলা হোস, আর রাজনীতিক হোস- তোকে শোধ করতে হবে দায়।

এই দেশ, এই ভালমানুষগুলো এম্নি ফুরিয়ে যাচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। বৈধভাবে। তোর অনেক আছে, বহু কোটি। তারপরও আরো চাই, যা তুই ভোগও করতে পারবি না, সেটুকুর লোভেই তো এতকিছু? দেখা যাক।
Top