‘কুসংস্কার’? মূল্যটা স্রেফ সম্পর্কের: দিন, পাথর, স্থান ও মাটির নয়
-----
সাহাবী রা. দের আচরণের আলোকে নবীজী দ.’র আচরণ, এবং নবীগণের আচরণের আলোকে কুরআনের আচরণ বিশ্লেষণ করি আমরা?
সাহাবীদের আকিদা ছিল, রাসূল দ.’র পবিত্র ঘাম পানির সাথে মিশিয়ে যে পাত্রে আম্মাজানরা সংরক্ষণ করতেন, সেই পাত্র থেকে একটা ফোঁটা হলেও নিজের পাত্রে নিয়ে যাওয়া। সারিবদ্ধভাবে তাঁরা নিয়ে যেতেন।
সাধারণ দৃষ্টিতে ঘামতো ঘামই, আর তারা হলেন মহা আলোকিত, পানি মিশ্রিত ঘাম তাদের কী উপকার করবে?
কেন সাহাবীরা রাসূল দ.’র দাঁড়ি বা চুল মুবারক যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতেন? পরস্পরকে দেখাতেন? যুদ্ধে নিয়ে যেতেন? কবরেও দিয়ে দিতে বলতেন? তাঁরা কি যথাযথ শিক্ষা রাসূল দ. থেকে পাননি? তাঁরা কি অন্ধ আবেগে এসব করেছেন নাকি কুরআন থেকে এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছেন? রাসূল দ.’র সুন্নাহ্ থেকে প্রমাণ পেয়েছেন?
জন্মদিন পালনের বিপক্ষে কোন আয়াত কুরআনে আমি পাইনি কিন্তু পক্ষে পেয়েছি যে। সূরা মারইয়ামের দুটা আয়াত: সালাম হোক তার জন্মদিনে, তার প্রত্যাগমনদিনে এবং তার পুনরুত্থান দিনে। দুটা ভিন্ন আয়াত দুজন ভিন্ন নবী আ.’র বিষয়ে। যে কোন গুণগত কথা, যা দুজন নবীর উপরে প্রযোজ্য হয়, তা আর সব নবীর উপর প্রযোজ্য না হলেও শ্রেষ্ঠ নবী হিসাবে রাহমাতাল্লিল আ’লামীনের উপর অবশ্যই প্রযোজ্য হয়।
আর দ্বিতীয়ত জন্মদিন তা বার্ষিক ভিত্তিতে হোক, বা মাসিক বা সাপ্তাহিক- তা তো হাদীস শরীফেই আছে। সোমবার রোজা রাখার বিষয়ে। কুরআনের এক আয়াতে নবীজী দ. ‘রাহমাতান্ লিল আ’লামীন’ যত জগত আছে সব জগতের প্রতি রহমত। আরেক আয়াতে আল্লাহ্’র মহাদানের প্রতি খুশি প্রকাশ করা আমাদের সমস্ত সম্পদের চেয়েও উত্তম তা বলা হয়েছে।
সকল জগতের প্রতি রহমতই তো আল্লাহ্’র মহাদান। আর আল্লাহ্’র মহাদানের বিষয়ে খুশি প্রকাশ করাকেই তো সব সম্পদের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে কুরআনে।
কুরআন আল্লাহ্’র রহমত, এজন্য আমরা এক মাস রোজা রাখি, কুরআন নাযিলের রাত্রিটা বোজেড় রাতে খুঁজি।
কারণ এ রাত হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। কেন উত্তম?
কুরআনের জন্য উত্তম।
এ রাত নুবুয়্যতেরও রাত, তাই রাসূল দ.’র কারণে উত্তমে পরিণত হয়েছে।
এ রাত ইসলাম আসারও রাত, তাই ইসলামের রাত হিসাবে উত্তমে পরিণত হয়েছে।
দেখুন সামান্য তুওয়া উপত্যকা, আল্লাহ্ তুওয়াকে বললেন, মুকাদ্দাস! হায় সুবহানআল্লাহ্! আল্লাহ্ কেন তুওয়া উপত্যকাকে মুকাদ্দাস বলবেন?
এ তো সেই মাটি, পাথর, ঘাস আর পাহাড়। আর কিছু তো নয়।
কিন্তু মুকাদ্দাস হয়ে গেল তুওয়া, যখন মূসা আ. সেই পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়ালেন। মূসা আ. যদি কেওকারাডংয়ে দাঁড়াতেন, তবে হয়তো কুরআনে কেওকারাডংকে মুকাদ্দাস বলা হতো।
ওই মাটি, ওই পাথর, ওই ঘাসে ছাওয়া পাহাড় কিছুই নয়, স্রেফ ব্যক্তি যখন মূসা আ. হন, ঘটনার স্থান তখন মুকাদ্দাস হয়ে যায়!
মক্কা তো বালাদই (শহর/অঞ্চল/দেশ) ছিল। বালাদিল আমীন হয়ে গেল যখন ওয়া আনতা হিল্লুম বিহাযাল বালাদ হল, তখনি।
মুহররমের ১০ তারিখে ইহুদিরা (মূসায়ি মুসলিম মূলত) মুক্তি পাওয়ায় ইহুদিরা যদি রোযা রাখতে পারে, রাসূল দ.’র কাছে মূসা আ. বেশি হকদার বলেই তো রাসূল দ. সেই রোযা ২/৩ দিন রাখতে বললেন।
মুহররমের ১০ তারিখ কী?
একটা দিনই তো!
ওই কনটেক্সট এ মাহাত্ম্যটা যুক্ত হল স্রেফ মূসা আ.’র জাতির মুক্তির কারণে। এবং সেই মাহাত্ম্যকে স্বীকৃতিও দিলেন রাসূল দ.।
উমার রা. তো বলেই দিলেন হাজরে আসওয়াদকে, হে পাথর, তুমি আমার কী উপকার করতে পারবে? তোমায় চুমি, কারণ রাসূল দ. চুমেছেন।
সম্পর্কটা পাথরের সাথে নয়, রাসূল দ.’র সাথে।
ক্বাবা ঘরকে বলে দিলেন, এক মু’মিন একশো কাবার চেয়ে দামী। কিন্তু তাওয়াফ সেই ক্বাবাকেই করলেন। কেন? এই ঘরের সাথে যত না আল্লাহ্’র সম্পর্ক তারচে বেশি ইব্রাহিম, ইসমাঈল ও মুহাম্মাদ (আলাইহিমুস সালাম) এঁর সম্পর্ক। ঘরতো তাঁরা আল্লাহ্’র জন্যই গড়েছেন, না আল্লাহ্ থাকতে আসেন, না আল্লাহ্ ঘরে থাকেন।
আল্লাহ্ তাহলে কেন ক্বাবাকে মুকাদ্দাস করলেন? সূত্র ওই মুকাদ্দাস তুওয়ায় নিহিত।
কিবলাতেই আসুন না।
যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ্।
তার পরও, কুরআনে তা বলার পরও, কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস (মসজিদুল আকসা) ছিল।
সালাত পড়ছেন নবীজী দ.। একেক সময় একেক দিকে না তিনি পড়েছেন, না পড়তে দিয়েছেন।
মনে শুধু বাসনা এসেছে, আল্লাহ্ যদি ক্বাবা ঘরটাকেই কিবলা করে দিতেন!
বাসনা রাসূল দ.’র মনের, ঘর ইব্রাহিম ইসমাঈল আ.’র হাতের, আর নামাজেই কিবলায় পরিণত করলেন আল্লাহ্।
সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত কার মনের ‘সামান্য’ বাসনার সাথে যুক্ত? কার মনের ক্ষণিক চাওয়া তা কিয়ামাত ক্বাবাকে কিবলায় পরিণত করল?
মাক্বামে ইবরাহীমের গুরুত্বই বা কেন থাকবে? দুজন নবী একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কাবা তৈরি করলেন। এইতো! তাদের পায়ের সাথে পাথরের সম্পর্ক হয়ে গেল, এইতো?
বীরে শেফা হয়ে গেল, রাসূল দ. পান করালেন বলে, বীরে রোহা হয়ে গেল, রাসূল দ. পান করালেন বলেন, বীরে যমযম হয়ে গেল, শিশু ইসমাঈল আ. যন্ত্রণা পাচ্ছেন বলে, বীরে কাউসার হয়ে গেল, কেউ রাসূল দ. কে নির্বংশ বললো বলে!
কেন কুরবানির ঈদ? একজন নবী আরেকজন নবীকে আল্লাহ্’র জন্য উৎসর্গ করতে চাইলেন বলে, এটুকুই তো? আসলে এবং মূলে এবং প্রকৃতপক্ষে এটুকুই তো? আজকে আমার আপনার উপর ফরয। রোযা রাখাও হারাম।
সালিহ্ আ.’র জাতি ধ্বংস হল, স্রেফ একটা উটের পা কেটেছে বলেই তো! কোন শিরক করেনি, কোন বাহ্যিক ‘যুলম’ ও করেনি। উট খাবার জিনিসই তো। কিন্তু সম্পর্কটা নবীর সাথে। নবীর সাথে শুধু সে কারণেই আল্লাহ্’র সাথে। নইলে জগতের সব উটই তো না’কাতুল্লাহ্। কেন সালিহ্ আলাইহিস সালামেরটা বিশেষভাবে হবে?
কেন একটা উটের পা কাটার ‘অপরাধে’ একটা জাতি ধ্বংস হবে?
সম্পর্ক, সম্পর্ক, সম্পর্ক।
রাসূল দ. আলী রা. কে নিয়ে এক গাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় মাথা নিচু করেছিলেন কারণ গাছটা ছিল নিচু। সেই গাছ কালক্রমে উচু হয়ে গেছে। কিন্তু আলী রা. সেই উচু গাছের তলা দিয়ে যাবার সময় তেমনভাবেই নিচু হলেন- আলী রা. কি কম কুসংস্কারমুক্ত? আলী রা. কি কম আলোকিত? তিনি কি সত্যকে কম করে পেয়েছিলেন? কুরআন বোঝার, রাসূল দ.’র নীতি বোঝার সুযোগ কি তিনি কম পেয়েছিলেন?
পুরো বিষয়টাই যে সম্পর্কের।
মাটি গুরুত্বপূর্ণ না, পাথর গুরুত্বপূর্ণ না, উট নয়, রমজানের শেষ দশদিন নয়, সোমবার নয়, কাবার দেয়াল ও ছাদ নয়, ইব্রাহিম আ.’র পায়ের তলার পাথর নয়, তুওয়া উপত্যকা নয়, হাজরে আসওয়াদ নয়, গারে হেরাও নয়, গারে সওরও নয়, কোনদিকে ফিরে সালাত আদায় করছি সেটাও নয়, আর শহরও কখনো শান্তির নয়- সম্পর্কটা, স্রেফ সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ।