প্রিয়জনকে স্মরণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
-----
আলহামদুলিল্লাহ্, বিপদের মাঝে অভিভাবকসম প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকা যায়।
আমরা বিপদাপণ্ণ হলে প্রিয়জনের নাম স্মরণ করলে বা তাদের মুখ স্মরণ করলে বা তাদের নাম ধরে ডাকলে আমাদের নিরোকেমিক্যাল ব্যালান্স ঠিক ওই ব্যালান্সে চলে যায়, যে ব্যালান্সে থাকে তাদের সামনে পরম সুখে থাকার সময়।
যেমন, আমরা বিপদে পড়লে মা-গো বললে মায়ের সামনে সুখে থাকার যত অনুভূতি, মুহূর্তের মধ্যে আমাদের অবচেতন ও অচেতন মনের অংশটুকু ওই মুহূর্তের যে নিউরোট্রান্সমিটারের ব্যালেন্স থাকে, সেই অবস্থানে চলে যায়।
এটাকে সাইকোলজিস্টরা শর্টকাট বা হুকও বলেন- যে শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের মানসিক অবস্থান সবচে ভাল অবস্থায় চলে যাবে।
আবার নেগেটিভ সাইকোলজিক্যাল হুকও আছে।
যেমন আমাদের মনে সবচে বিশ্রি যে গালি আছে, সেটা যদি আমরা স্মরণ করি বা মুখে আনি, সাথে সাথে আমাদের মন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
এ পরিবর্তনটা যে শুধু নিউরোকেমিক্যাল এবং সারা শরীরে ছড়ানো নার্ভের মধ্যে হয় তা-ই শুধু নয়। আমাদের দেহের প্রতিটা ট্রিগার বদলে যায়। অর্থাৎ ট্রিগার হরমোনগুলো এবং বিভিন্ন লিম্বের ট্রিগারগুলো বদলে যায়। যেমন, আমরা ইয়া আল্লাহ্ বা মা-গো বলার সাথে সাথে আমাদের হার্টরেট স্বাভাবিক হয়ে যায়, পেশীর অকারণ টানটান ভাব সহজ হয়ে যায়, অত্যন্ত দ্রুত চলা শারীরবৃত্তিক কর্মকান্ড যেমন পিপাসার বোধ ক্ষুধার বোধ ব্যথার বোধ দুর্বলতার বোধ কমে যায়। ফলে চিন্তার স্বাভাবিকতা ফিরে আসে এবং সিদ্ধান্তের পরিচ্ছন্নতা চলে আসে।
এটাকে আরো সহজ করে বলতে পারি এভাবে, যখন আমরা তেঁতুল বলি বা ভাবি- সাথে সাথে সাধারণত আমাদের মুখে লালা চলে আসে। অথচ আমরা তেতুল খাইনি। লালা আসে তেঁতুলের সাইট্রিক এসিড ধুয়ে দেয়ার জন্য। যে তেঁতুল আমরা খাইনি সেটা খেলে যে মুখে সাইট্রিক এসিড আসবে, সেটা আমাদের অবচেতন মন জানে। সে বাস্তবে তেতুল খাওয়া আর তেতুলের স্মরণ এর মধ্যে তফাত করতে পারে না বলেই কল্পিত সাইট্রিক এসিড ধুয়ে দেয়ার জন্য লালা পাঠায়।
তেমনি প্রিয়জনদের মধ্যে যারা গুরুজন এবং ভরসাস্থল, তাদের প্রতি ভরসা করার যে অবচেতন অবস্থা আমাদের মধ্যে আছে, সে অবস্থায় আমরা ফেরত আসি তাদের নাম স্মরণ করার সাথে সাথে। এমনকি অভিভাবকসম প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসার বা সুখের স্মৃতি স্মরণ করলে যে মানুষের ব্যথার অনুভূতি কমে যায় এবং তা হাজারো বছর ধরেই মানুষ জানতো তা তিনটা ভিন্ন সহীহ্ হাদীস থেকে আমরা পাই-
১. আলী রা. নামাযরত থাকা অবস্থায় তাঁর বরকতপূর্ণ পা থেকে তীর খোলা হয়, কারণ তিনি তখন আল্লাহ্’র স্মরণে বিভোর আছেন এবং এই বিভোরতা তাঁর ব্যথার অনুভূতিকে অনেক কমিয়ে বা শূণ্য করে দিবে- তা সবাই জানতো।
২. হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনু উমার রা. পায়ে ব্যথা পাবার পর কেউ বলেন, ব্যথাটা ঠিক করার প্রক্রিয়ার সময় যেন তিনি কোন প্রিয়জনকে স্মরণ করেন, প্রিয়তমজনের নাম উচ্চারণ করেন; তখন আবদুল্লাহ্ ইবনু উমার রা. জোরে বলেছিলেন, ইয়া মুহাম্মাদ দ.!
৩. নবীজী দ.’র প্রিয়তমা নাতনী সাইয়্যিদা যাইনআব রা. কারবালার ময়দানে সন্ধ্যাবেলা চিৎকার করে কেঁদেছিলেন, ইয়া মুহাম্মাদা দ.! ইয়া রাসূলআল্লাহ্ দ.! আসুন, দেখে যান, আপনার পুত্রদের কীভাবে টুকরা করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রাখা হয়েছে...
তাই গুরুজনসম প্রিয়জনের স্মরণ যে আমাদের ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে দেয়, মাসল ও নার্ভের টেনশন প্রেশার কমিয়ে দেয়, অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশন কমিয়ে দেয়, মস্তিষ্কে ও সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা নার্ভের কোষগুলোতে উপকারী, শান্তির, সুখের, রিল্যাক্সের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো প্রবাহিত করে, শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের গতি কমিয়ে পিপাসা- ক্ষুধা- শারীরিক আবেগগুলোকে কমিয়ে দেয়, হৃদপিন্ডের গতি, রক্তের চাপ, দেহে রক্তের সাথে ছড়ানো ক্ষয়কারক উপাদানগুলোর হার, সমস্ত মাসলের প্রেশার ও টেনশন, ফুসফুসের গতি,যন্ত্রণা-হতাশা-কিংকর্তব্যবিমূড়তা-ক্ষোভ-অভিমান কমিয়ে দেয়; ফলে দ্রুততম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সঠিকভাবে মস্তিষ্কের কগনিটিভ, লজিক্যাল ও স্মৃতির অংশগুলোকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
এগুলো সবই খুব স্বাভবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
সামান্য তেঁতুলের স্মরণ যদি মুখের সাইট্রিক এসিড মুছতে লালা পাঠাতে পারে, আল্লাহ্’র বা আপন মাতার স্মরণও সারাদেহের সব ধরনের অস্বস্তি মুছতে প্রয়োজনীয় হরমোন, ট্রিগার সিগন্যাল ও নিউরোট্রান্সমিটার পাঠাতে পারে বরং পাঠিয়ে থাকে নিশ্চিতভাবেই।
এটা তো গেল প্রাকৃতিক নিয়ম, এর বাইরে আধ্যাত্মিকতার বিষয় আছে। ওটা তো আমাদের এ আলোচনার বিষয় নয়।