ঈমানের পাশমার্ক: দুই ছেলের সাথে আমার আলোচনা
[আশা করি পড়লেই জিতবেন]
-----
”রে বুল্লেয়া, তু হাসিল কি কীতা? যে ইয়ারনূ না রাক্খেয়া রাজী?”
-বুল্লে শাহ্, তুই অর্জনটা করলি কী বল, যদি প্রিয়বন্ধুকেই রাজি করতে না পেরে থাকিস?
[না, ফেবুতে নিয়মিত হইনি। অন্তত ছয়মাস, যদি আল্লাহ্ রাখেন।]
-----
আমার তিন ছেলেমেয়েরই আবারো ভাইরাস জ্বর হয়েছে। সবই মালিকের রহমত। খুব হয়রান লাগে বাচ্চা বাচ্চা কাচ্চাগুলো যখন অসুস্থ হয়। খুব অসহায় লাগে।

তো, আমি তো তাদের সাথে কথা কখনোই বলি না। সব সময় ধমকের উপর রাখি। ব্যাড ব্যাড ড্যাড। আমি মানুষটা আসল জায়গায় (বাচ্চাদের বেলায়) খারাপ এটা যেমন ঠিক কথা, তেমনি পরিবারের কোন একজনের নিষ্ঠুর ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে হয়, সেই পাপভার আমিই নিয়েছি আরকী।

তো জ্বরের খাতিরে দুই ছেলের সাথে একটু ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলছি। সব ঝর্ণার পানি যেমন নদীতে গিয়ে শেষ হয়, আমার কথাও সব সময় গিয়ে আল্লাহ্-রাসূল দ. তে শেষ হয়।

জান্নাতের অসাম সব ব্যাপার নিয়ে কথা হল। পোলারা বলছে, জান্নাতে জ্বর নাই। ব্যথাও কি নাই? বললাম, তুমি চাইলে নাই, তুমি চাইলে আছে।

বড় পোলা বেশ গুছিয়ে বলল, আমি যখন জান্নাতে যাব তখন আমার জায়গায় অনেক বাঘ রাখব। ওদের সাথে খেলব। আচ্ছা আব্বু, আমিতো জান্নাতে যাবই। কারণ আমি মুসলমান। মুসলমান জাহান্নামে পোড়ার পর হলেও জান্নাতে যাবেই, তাই না?

বললাম, বাবা, মু’মিন জান্নাতে যাবেই।

বলল, আমি কি মু’মিন?
-আল্লাহ্, রাসূলুল্লাহ্ দ., সব নবী-রাসূল আ., কুরআন, সব কিতাব, ফিরিশতা, আল্লাহ্’র দেয়া ভাগ্য, বিচারের দিনে আবার ওঠা, ফেরেশতা- এইসবে যদি বিশ্বাস করো, তবে তুমি কম মুমিন হলেও মুমিন। কিন্তু বাবা জানো, ঈমানের আসল কথা কী? কতটুকু থাকলে তুমি নিজেকে মু’মিন বলতে পারো?

সেটা হল, আল্লাহ্ ও আল্লাহ্’র রাসূল দ. কে সবচে বেশি ভালবাসা। আমি তোমাদের বলব সেই ভালবাসাটা কেমন। আমি তোমাদের আজকে বলব, সেই ভালবাসাটা কতদূরে ছড়ানো।

তুমি তখনি মুমিন, যখন তুমি তোমার চেয়ে, তোমার আব্বু-আম্মুর চেয়ে, দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে, পুরো পৃথিবীর সবার চেয়ে, এমনকি জান্নাতের ভালবাসার চেয়ে এবং জাহান্নামের ভয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসবে আল্লাহ্- আল্লাহ্’র রাসূল দ. কে।
তার আগে তুমি মুমিন হিসাবে পাশ করবে না। কিছু নাম্বার পাবে, কিন্তু ফেইল নাম্বার। পাশ নাম্বার না।

এখন বল তো, তুমি আল্লাহ্-রাসূল দ. কে সবচে বেশি ভালবাস তার প্রথম পরিচয় কী? তুমি যতবার হাসো, তার মধ্যে বেশিরভাগ হাসি যখন আল্লাহ্’র জন্য হবে, তখনি বুঝতে পারবে, তুমি সবচে বেশি ভালবাসো আল্লাহ্-রাসূল দ. কে। যতবার তুমি কাঁদো, তার মধ্যে সবচে বেশিবার যদি কাঁদো রাসূল দ.’র জন্য, তখনি তুমি বুঝতে পারবে, হ্যা, তোমার ঈমান আছে। তুমি যত চিন্তা করো, তার বেশিরভাগ চিন্তা যদি আল্লাহ্ ও তার রাসূল দ. কে নিয়ে কর, তখন বুঝতে পারবে, তুমি কমপক্ষে পাশমার্ক পাওয়া মু’মিন।

আসো, তোমাদের বলি, আল্লাহ্-রাসূল দ.’র ভালবাসা কী।
আল্লাহ্-রাসূল দ.’র ভালবাসা মানে হল, আল্লাহ্-রাসূল দ. যা ভালবাসেন, তা ভালবাসা। আল্লাহ্-রাসূল দ. যা যতটুকু ভালবাসেন, তা ততটুকু ভালবাসা।

বলতো বাবা, নবীজী দ. সবচে বেশি ভালবাসেন কাকে?
বড় পোলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাসান-হুসাইন রা. কে।
হেসে মাথা নাড়লাম। ভাবলাম, মাওলা, তুমি তো আমার তরী ঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছ। ইয়া আল্লাহ্! ইয়া আল্লাহ্! বললাম, আর?
বলল, হজরত ফাতিমা রা. কে।
বললাম, আর?
হজরত আলী রা. কে।

তাহলে তুমি কখন বুঝবে তুমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ. কে সবচে বেশি ভালবাস?
যখন হাসান হোসাইন আর ফাতিমা আর আলী রা. কে সবচে বেশি ভালবাসব।

আর কাকে কাকে? বাবারে, যাকে যাকে আল্লাহ্ ভালবাসেন, সবার আগে তাকে তাকে। তাদের নানা নাম আছে, সংক্ষেপে বললে ওয়ালিআল্লাহ্। সবযুগের।

আচ্ছা বাবা, বলতো, এই পৃথিবীতে যারা এখন ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে তুমি সবচে বেশি কাকে ভালবাসবে? তিনি হলেন তোমার মুরশিদ।
মুরশিদ কে?
তোমার হুযুর কিবলা। মুরশিদ হলেন তোমার গাইড। আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে যে তোমাকে আদেশ করে, রাসূল দ.’র পক্ষ থেকে যে তোমাকে আদেশ করে। আল্লাহ্-রাসূল দ. কে তুমি সবচে বেশি ভালবাস কিনা, সেটা বুঝতে পারবে তখনি যখন দেখবে আল্লাহ্-রাসূল দ.’র পক্ষ থেকে তোমার খলিফা যে, তাকে সবচে বেশি ভালবাস কিনা, সেটা দিয়ে। যদি দেখ তুমি বলছ আল্লাহ্ রাসূল দ. কে ভালবাস, কিন্তু যদি দেখ এই পৃথিবীতে জীবিত চলন্ত মানুষদের মধ্যে তোমার মুরশিদের প্রতি তোমার ভালবাসা সবচে বেশি নেই, তাহলে বুঝবে তুমি আসলে আল্লাহ্ রাসূল দ. কে সবচে বেশি ভালবাস না। তাই তোমার ঈমানের পাশমার্ক নেই। কিছু মার্কস আছে, কিন্তু তা পাশমার্ক হয়নাই।

একেকজন মানুষের একেক মুরশিদ থাকে। যার যার মুরশিদ তার তার জন্য আল্লাহ্’র খলিফা। রাসূল দ.’র খলিফা। কিন্তু মুরশিদকে অবশ্যই আল্লাহ্-রাসূল দ.’র অনুগত হতে হবে।

তোমার হুযুর কিবলা যে কথাটাই আল্লাহ্-রাসূল দ.’র পথে সঠিকভাবে বলবেন, সে কথাটাই তোমার জন্য আল্লাহ্’র হুকুম। সে কথাটাই তোমার জন্য  রাসূল দ.’র হুকুম। সে কথাটাই তোমার জন্য কুরআনের হুকুম। সে কথাটাই হাদীসের হুকুম। তুমি কুরআন না-ও বুঝতে পারো, ভুলও বুঝতে পারো হাদীস। তোমার মুরশিদ তো এসব ভুল প্রায় করবেনই না। কারণ তাঁর কাজই কুরআন বুঝতে পারা, তোমার তো আরো অনেক কাজ আছে। তাঁর কাজই হাদীস বুঝতে পারা, তোমার তো হাজার আজেবাজে কাজ আছে। তাঁর কাজই চিন্তা করা, তাঁর কাজই আল্লাহ্’র গাইডেন্স পেয়ে তোমাকে গাইড করা।

হুযুর কিবলার পর কাকে ভালবাসবে বাবা? তোমার খলিফার পরিবার প্রিয়জনকে। এরপর? তোমার আম্মুকে। এরপর? তোমার আব্বুকে। তোমাকে। তোমার ক্লোজেস্ট ব্লাডলাইনকে। এরপর তোমার প্রতিবেশীকে। এরপর তুমি ভালবাসবে সব মুসলিমকে। এরপর ভালবাসবে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সব মানুষকে। এরপর সব প্রাণীকে। এরপর সবকিছুকে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে ভালবাসবে। আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে কেয়ার করবে।

আল্লাহ্-রাসূল দ. কে সবচে বেশি ভালবাসার মানে হল, সব চিন্তার শুরুতে আল্লাহ্-রাসূল দ.’র কথা মনে পড়া। সব কথার আগে আল্লাহ্-রাসূল দ.’র কথা বলা। সব কথার চেয়ে বেশি আল্লাহ্-রাসূল দ.’র কথা বলা। সব কাজের বেলায়, যখন তুমি দেখবে যে, কাজটা করছ আল্লাহ্-রাসূল দ.’র জন্য, থামছ আল্লাহ্-রাসূল দ.’র জন্য, সবচে বড় কথা, যখন সবকিছুতে সবার আগে তোমার মনের ভিতর লিল্লাহ্ লিল্লাহ্ লি রাসূলিল্লাহ্ লি রাসূলিল্লাহ্ আসছে- তুমি ঈমানে তখন পাশমার্কে আছ। যখনি এটা কমে যাচ্ছে, মার্কস ফেইলের খাতায় চলে যাচ্ছে।

তুমি স-ব করবে, স-ব করবে। কোনকিছু বেশি না, কোনকিছু কম না। বেশি দিয়ে আল্লাহ্’র ভালবাসা বেশি হয় না। কম দিয়ে রাসূল দ.’র ভালবাসা কমে যায় না। তুমি যা ভাববে, তা যেভাবে ভাবলে আল্লাহ্ পছন্দ করবেন, সেভাবেই ভাববে। নিজের থেকে বেশি ভাবতে যাবে না, নিজের থেকে বেশি করতে যাবে না, আল্লাহ্ তোমার  কাজে উপকৃত হবেন না, আল্লাহ্ শুধু দেখবেন তোমার মন   শুধু করার সময় তোমার মাথায় তারই প্রাধান্য আছে কিনা, তারই জন্য তুমি এগিয়ে যাচ্ছ কিনা, এটা দেখো।

বাবারে, জান্নাতে তুমি যাবে।
কিন্তু জেনো, হাজারো জান্নাত এক পলকে আমার রাসূল দ.’র কদমে কুরবান। দুনিয়ায় তুমি দুদিনের জন্য এসেছ, শেষ পর্যন্ত যাবে তার কাছেই। মরণ ভয় পেয়ো না বাবা, শুধু জীবনে তার কথা মনে রেখো। দেখবে ঈমানে ঈমানে জীবন কেটে গেছে। তিনি তোমার সবচে বেশি প্রিয় হলে তোমার মারা যাবার দিন হবে তোমার সবচে বড় ঈদের দিন।

না ম্যায় রোঁউ হারদিন হারপাল, না রাহুঁ উদাস রে,
পিয়া মিলন কি আশ রে, পিয়া মিলন কি আশ।
Top