যুগে যুগে মতবাদের উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অবদান
-----

আমাদের রুগ্ন অবস্থার পেছনে আমাদের দোষ তো অবশ্যই আছে। এবং এটাই মূল বিষয়, আমরা আমাদের যত্ন নিতে পারিনি। কিন্তু প্রতিটা যুগে মতাদর্শ ছড়ানোর পেছনে সামরিক ও বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সূফি ও হানাফিদের উত্থান
-----
যেমন, হানাফি মাযহাবের ছড়িয়ে যাবার পেছনে আব্বাসিয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরাট অবদান তো আছেই। আব্বাসিরা একটা পর্যায়ে ফিকহে হানাফীকেই প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রব্যবস্থায়।

আবার সবগুলো মাযহাব ও তাসাউউফ ছড়ানো ও টিঁকে যাবার পেছনে উসমানিয়া খিলাফাতের অবদান সবচে বেশি। উসমানিয়া খলিফারা মূলত ছিলেন সূফি তরিক্বার অনুসারী, সেইসাথে ফিক্বহে হানাফীর অনুগামী। তথাপি, তাঁরা অপর তিন ফিক্বাহ্’র স্কুলকেও সমান মর্যাদায় পেট্রোনাইজ করেছেন যার ফলে খোদ কাবাতেও প্রতি ওয়াক্তে চার মাযহাবের চার জামাত হতো।

আরব জাতীয়তাবাদ ও শোধনবাদের নামে সালাফিজমের উত্থান
-----

অপরদিকে উসমানিয়া খিলাফাত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আঘাতে দুর্বল হয়ে ধ্বসে পড়ছিল বলেই আরবে আরব জাতীয়তাবাদ ও শোধনবাদের নামে সালাফি মতাদর্শ মাথাচাড়া দেয়। সালাফি মতাদর্শ যত না একটা মতবাদ, তারচে বেশি এই মতাদর্শটার পেছনে কাজ করেছে অ্যান্টি সূফি এবং অ্যান্টি হানাফি চিন্তা চেতনা। সালাফিজমের প্রতিটা পরত গড়ে উঠেছে অ্যান্টি অটোম্যান ভাবধারা থেকে, তাই সালাফিজমের প্রতিটা কাজ শেষ পর্যন্ত তাসাউউফের প্রতিটা বিশ্বাস, প্রতিটা আচরণ, প্রতিটা সংস্কৃতি এবং প্রতিটা হাদীসকে আক্রমণ করে সেটাকে ডিনাই করার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।

অর্থাৎ সালাফিজমকে আমরা চিত্রিত করতে পারি স্রেফ অ্যান্টি-অটোম্যান পুনর্গঠন হিসাবে।

পেট্রোডলার যুগের সালাফিজম ও সেইসাথে উগ্রবাদের যাত্রা
-----

পরবর্তীতে আরবে তেল আবিষ্কারের সাথে সারা পৃথিবীতে সালাফি মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ার সরাসরি আর্থিক ও কূটনৈতিক সংযোগ ছিল। ভারতের দেওবন্দ ভাবধারার পাকিস্তানি সবচে বড় মাদ্রাসাটাকে জংগীকরণ ও পেট্রোনাইজ করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

এটার পেছনে মূল কারণ ছিল একটাই- আমেরিকা, ব্রিটেন ও সৌদ গোত্রবাদীরা অঢেল টাকা দিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে। সেই আফগানিস্তানের কথিত আন্তর্জাতিক মুজাহিদরা দুটা মূল ধারায় বিভক্ত হয়, সেমি-সালাফিস্ট তালেবান এবং পূর্ণ সালাফিস্ট আল কায়েদা। আল কায়েদা থেকেই বোকো হারাম এবং আইসিসের জন্ম। আল কায়েদা যেমন সারা পৃথিবীতে জিহাদিজমের একপেশে ইন্টারপ্রিটেশন ছড়িয়েছে- তার পেছনে সব সময় কাজ করেছে আরব ধনকুবেরদের আপ্রাণ ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় আর্থিক ও কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।

আইসিসও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও ধনকুবেরদের পৃষ্ঠপোষকতা
-----

এরপর যখন আইসিস আল কায়েদার অফশূট হিসাবে জন্ম নিল, এটাকে প্রাণপণে পেট্রোনাইজ করেছে মূলত ইজরায়েল। এমনকি ইজরায়েলের হাসপাতালে আহত আইসিসের যোদ্ধাদের চিকিৎসা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। অস্ত্র ও ট্রেনিঙে পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা।

 ইজরায়েলকে এই মিশনে সহায়তা করতেই আমেরিকা নামেমাত্র আইসিসের বিরোধিতা করেছে, কার্যত কিছুই করেনি। অপরদিকে জিও পলিটিক্সের কারণে তুরষ্কও অবারিত সহায়তা করেছে আইসিসকে। এমনকি তুরষ্ক আইসিসে যোগ দেয়ার জন্য মানুষজনকে তুরস্কের সীমানা নিরাপদে পার করার পূর্ণ‍ ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।

একই সময়ে আরব ধনকুবেররা এবং কিছু আরব রাষ্ট্র আইসিসকে সহায়তা করে গেছে যদিও সৌদ গোত্রবাদীরা আইসিসের বিরোধি ছিল।

মতবাদগুলোর উত্থান-পতনে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় টাকা
-----

তালেবানের উত্থান যেমন স্রেফ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে, তালেবানের পতনও তেমনি কূটনৈতিক-সামরিক-অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে এবং আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা তুলে নেয়ার মাধ্যমে হয়েছে।

ঠিক একইভাবে আল কায়েদার উত্থান যেমন পেট্রোডলারের হাত ধরে হয়েছে, আল কায়েদার পতনও ঠিক তেমনি আর্থিক অবরোধ এবং কূটনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে হয়েছে।

সবশেষে আইসিসের উত্থান যেমন জায়নবাদীদের দ্বারা হয়েছে স্রেফ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনসংখ্যা কমানো এবং দেশগুলোকে পাথরযুগে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এবং সারা পৃথিবীতে মুসলিম কমুনিটিতে কাঁপন ধরানোর জন্য, আইসিসের পতনও তেমনি হয়েছে আর্থিক অবরোধ, ইরান-রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে।

শিয়া মিলিট্যান্সি: চির অবহেলিত বিপদবার্তা
-----
সবশেষে এখন উত্থান হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া মতাবলম্বী মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর। এই উত্থান শুধুই অ্যান্টি আইসিস শক্তি হিসাবে দেখা হলেও মূলত তা স্রেফ ইরানি আইআরজিসি এবং ইরানের বন্ধুশক্তিগুলো, যেমন রাশিয়া ও সিরিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। আবার এই শক্তির পতনও হলে হবে সেই আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং কূটনৈতিকভাবে।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কি কেবল টাকার বিষয়?
-----

যুগে যুগে প্রতিটা মতবাদ উঠে আসার পেছনে রাষ্ট্রের হোলিস্টিক অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অনেক বড় একটা বিষয় ছিল। রাষ্ট্র যখন কূটনৈতিক- ইন্টেলিজেন্স- থিংকট্যাংক- মাস্টারমাইন্ড গ্রুপ- অর্থনীতি- এই কয়েকটা ফ্যাক্টরকে সিস্টেমেটিকভাবে কাজে লাগায়, তখন যে কোন মতবাদই অস্বাভাবিক দ্রুত ছড়ায়, কারণ তখন খুব দ্রুত বোদ্ধাশ্রেণী, বুদ্ধিজীবীশ্রেণী, বিশ্লেষক, তাত্ত্বিক, মেন্টর, মোটিভেটর, ক্যারিশম্যাটিক লিডার তৈরি হয়ে যায়।

আসলে প্রতিটা মতবাদেই এই শ্রেণীর মানুষ থাকে, তফাত হল কখন এরা মাথাচাড়া দিচ্ছে, কখন তারা সোশ্যাল মিডিয়া, ম্যাস মিডিয়া এবং জনসম্মুখে ব্যাপকহারে আসছে।

কখন তাদের শ্রেণীতে অনেক বেশি ডক্টরেট, অনেক বেশি আলেম ওলামা আল্লামার শ্রেণী শুরু হয়ে যায়।

শিয়া ওলামা: রুহুল্লাহ্-আয়াতুল্লাহ্-হুজ্জাতুল ইসলামের বন্যা
-----

শিয়াদের ক্ষেত্রে বলতে গেলে রুহুল্লাহ, আয়াতুল্লাহ্, হুজ্জাতুল ইসলাম, মারজায়ে তাকলিদ- এই বিষয়গুলো ১০০ বছর আগেও ছিল না। ইরানে বিপ্লব হবার আগে আগে এই সিস্টেমগুলো গড়ে উঠলেও তখন হাতেগোণা রুহুল্লাহ, আয়াতুল্লাহ্, হুজ্জাতুল ইসলাম বা মারজায়ে তাকলিদ ছিল।

কিন্তু যখনি শিয়া মতাদর্শ‍ মতাদর্শিক একটা রাষ্ট্র পেলো, তখন থেকেই স্রোতের মত আয়াতুল্লাহ্ ও হুজ্জাতুল ইসলামদের দেখতে পাই আমরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইযে একটা শিয়ারাষ্ট্র পাবার পর আয়াতুল্লাহ্ ও হুজ্জাতুল ইসলামদের মহাস্রোত- এরা সবাই কি অযোগ্য, কাগুজে বাঘ, পাতি স্কলার? মোটেও না। বিশেষ করে ইরানের কূম এবং ইরাকের নাযাফের হাওযা (শিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) গুলো থেকে এদের যাত্রা শুরু।  এরা পড়ালেখা করেছে, করিয়েছে, সিস্টেমেটিকভাবে গড়ে উঠেছে, গবেষণা করেছে, প্রচন্ড শক্তিমত্ত একটা সত্যিকার স্কলারশ্রেণী গড়ে উঠেছে।

হাওযা কি এখানেই থেমে গেছে?
না। ভারতে হাওযা, পাকিস্তানে হাওযা, লেবাননে, এমনকি আমেরিকা ও ইউরোপে গড়ে উঠেছে শিয়াদের সর্ব্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়।

অথচ আলিমদের এই টার্মগুলো পর্যন্ত শিয়া তো দূরের কথা, সুন্নিতে পর্যন্ত কখনো আম ছিল না। একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা কীভাবে মেন্টর-মোটিভেটর-মাস্টারমাইন্ড গ্রুপ এবং সবশেষে থিংকট্যাঙ্ক পলিসিমেকার তৈরি করে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইরান।

এর আগেও কি বিষয়টা এমনি ছিল না?
উসমানিয়া খিলাফাতে একজন থাকতেন শাইখুল ইসলাম, যিঁনি ইসলামের সবগুলো ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সবচে বড় আলিম হিসাবে বরেণ্য এবং তিনিও কাগুজে বাঘ ছিলেন না। তারাও জাঁদরেল আলিমই ছিলেন।

সবকিছুর পেছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সার্বিক চেষ্টা অনেক বড় একটা প্রভাব সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়, আমরা এমনটাই দেখি।
Top