সুখ কোথায় পাব 





ঈমান যেমন পার্থিব সুখ লাভের অন্যতম কারণ, তেমনি আখিরাতে নাজাতপ্রাপ্তিরও এটিই পথ। আল্লাহর ইবাদাত আর ঈমানের মাধ্যমেই সুখ হাসিল হয়। আল্লাহর আনুগত্য এবং ধর্মীয় বিধানগুলো পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার মাঝেই সুখ নিহিত। নিজে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা লাভ না করলে এটি বোঝা অসম্ভব।

১.ফরজ ও নফল ইবাদাতগুলোর মাধ্যমে সুখ লাভ


আল্লাহ বলেন, “যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করবো এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেবো যা তারা করতো।” [সূরা আন-নাহল(১৬):৯৭]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের জানাচ্ছেন যে আল্লাহ বলেন, “আমার বান্দা যেসবের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিল করতে চায়, তার মাঝে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো ফরজ ইবাদাতগুলো। তারপর আমার বান্দা নফল ইবাদাতগুলোর মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে থাকে। এমনকি এর ফলে আমি তাকে আমার প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই।” (বুখারি)

ইবাদাতের মাধ্যমে এভাবে আমরা আল্লাহর ভালেবাসা অর্জন করে নিতে পারি। আল্লাহ যদি আপনাকে ভালেবাসেন, আপনার ভয়ের কিছুই নেই।

 ২.আল্লাহর স্মরণ (যিকির) এর মাধ্যমে সুখ লাভ

আল্লাহ বলেন, “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।” [সূরা আর-রাদ(১৩):২৮]

ইবনুল কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন, “আমি একদিন ফজরের পর ইবনে তাইমিয়্যা (রহিমাহুল্লাহ) এর কাছে গেলাম। তিনি তখন থেকে নিয়ে সূর্য ওঠার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত যিকিরে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এ হলো আমার সকালের খাবার। আমি এটি গ্রহণ না করলে সারাদিন শক্তি পাবো না।’

এ সময়টাতে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রবের নিকট সমর্পণ করতেন। তিনি খালেসভাবে আল্লাহকে চাইতেন, তাঁর কাছে দুআ করতেন, ইস্তিগফার করতেন, অনুনয় করে তাঁকে ডাকতেন, অনুশোচনার অশ্রুতে তাঁর চোখ ভরে যেতো। তারপর তাঁর ইবাদাতের ফলে তাঁর অন্তর পরিষ্কার হয়ে যেতো, আত্মা সজীব হয়ে উঠতো, তাঁর সত্ত্বার প্রতিটি রজ্জু শক্তিশালী হয়ে উঠতো। তাঁর মন-দিল সতেজ হয়ে যেতো।”

৩.কোরআনের মাধ্যমে সুখ লাভ

আল্লাহ বলেন, “আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।” [সূরা বনী ইসরাইল(১৭):৮২]

আসলেই কোরআন আত্মা ও হৃদয়ের দুর্দশার চিকিৎসা। এমনকি এটি দৈহিক আরোগ্যের উৎসও বটে।

৪.সব রকমের ভালো কাজের মাঝে সুখ লাভ

আলাহ বলেন, “সৎকর্মশীলগণ থাকবেন নিআমাতের মাঝে। আর দুষ্কর্মকারীরা থাকবে জাহান্নামে।” [সূরা আল-ইনফিতার(৮২):১৩-১৪]

কিছু মুফাসসির বলেন যে সৎকর্মশীলদের প্রতি আনন্দের এই ওয়াদা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। দুষ্কর্মাদের যন্ত্রণার ক্ষেত্রেও একই। দুনিয়ায় জান্নাতি সুখ লাভের কিছু লক্ষণ হলো ভালোত্ব, আত্মিক প্রশান্তি, আলো ও সুখ। তেমনি দুষ্টলোকদের যন্ত্রণার কিছু লক্ষণ হলো জীবন আঁধারে ভরে যাওয়া যার ফলে তারা তাদের সম্পদ, পরিবার, বিশ্রাম, যৌবন ও স্বাস্থ্য থেকে কোনো সুখ পায় না।

৫.সালাতের মাধ্যমে সুখ লাভ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার বিলাল (রাঃ)-কে আযান দিতে বলল বললেন, “আমাদেরকে এর মাধ্যমে প্রশান্তি দাও, বিলাল।” (আবু দাউদ ও মুসনাদ আহমাদ)

আরেক হাদীসে আছে, “সালাত হলো আমার চোখের প্রশান্তি।” (সুনানে নাসাঈ ও মুসনাদ আহমাদ)

প্রিয় মানুষটির সাথে সামান্য বিষয়ে কথা বলাটাও কত শান্তির! তাহলে যখন আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলতে দাঁড়াই তখন আমাদের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত?

৬.আল্লাহকে জানার মাধ্যমে সুখ লাভ

বান্দা যখন রবকে চিনতে পারে, তখন সে শান্তি পায়। চারিদিকে আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সেগুলো কত অসাধারণ। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে লুকিয়ে আছে কত জ্ঞান। আমরা আল্লাহকে দেখতে না পেলেও তাঁর সৃষ্টিসমূহ দেখতে পাই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী ঘোষণা করতে পারি।

ইবাদাতের পূর্ণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন, “ইহসান হলো এমনভাবে ইবাদাত করা যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো। তুমি যদি তাঁকে না-ও দেখতে পাও, তিনি তো তোমাকে দেখছেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

বান্দা যখন রবের সৃষ্টিশীলতা আর জ্ঞানের অসীমতা উপলব্ধি করে, তখন সে অন্তরে শান্তি পায়। রাসূল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদকে (সাঃ) রাসূল হিসেবে মেনে নিয়ে যে সন্তুষ্ট, সে ঈমানের মিষ্টতার স্বাদ পাবে।” (সহীহ মুসলিম)

একটি বড় আমেরিকান কর্পোরেশনের সিইও’র ঘটনা। তাঁর ধনসম্পদের কোনো অভাব না থাকলেও তিনি ছিলেন অসুখী। রাতে তিনি বিছানায় এপাশ ওপাশ করতেন, ঘুম হতো না। কোম্পানিতে চাকুরিরত এক মুসলিম লোককে দেখে তিনি অবাক হতেন। লোকটি তেমন উচ্চপদস্থ নয়, বেতনও কম। কিন্তু সে শান্তি মতো খেতো, ঘুমাতো। হাসি মুখে অফিসে আসতো, হাসিমুখেই যেতো। কখনো তার চেহারায় দুচিন্তার ছাপ দেখা যায়নি।

তিনি লোকটিকে ডাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন সে কারণ যার ফলে সর্বদা তুমি হাসিখুশি থাকো?”

লোকটি বললো, “আমি আমার রবকে চিনেছি এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জানি। আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি, তাই আমি সুখী।”

সিইও বললেন, “তুমি কি এমন কিছু জানো যা আমাকে পথ দেখাতে পারে?”

লোকটি সিইও’র হাত ধরে তাঁকে সেই ইসলামিক সেন্টারে নিয়ে গেলো যেখানে সে দ্বীন সম্পর্কে শিখেছে। অবশেষে সেই সিইও ঘোষণা দিলেন, “আশহাদু আল্লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”

বলা মাত্রই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “আজকের মত শান্তি আমি জীবনে কোনো দিন পাইনি।”

৭.ঈমানের মাঝে সুখ

আল্লাহ বলেন যে ঈমানের সদা সঙ্গী হলো সুখ, “যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে শির্কের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী।” [সূরা আল-আনআম(৬):৮২]

দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিন যে নিরাপত্তা বোধ করে, তার শিকড় হলো ঈমান। ঈমান যত মজবুত হবে, তার অন্তর তত প্রশান্ত হবে। আর যার ঈমান দুর্বল, তারা বিপদ আপদে পড়বে। “তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক পাপ ক্ষমা করে দেন।” [সূরা আশ-শুরা(৪২):৩০]

এক পশ্চিমা লেখক আরবের মরুবাসীদের মাঝে বাস করতে গেলেন। তাদের মত পোশাক পরলেন, তাদের মত খাবার খেলেন এবং এক পাল মেষ পালন করতে লাগলেন। তিনি মুহাম্মাদকে (সাঃ) নিয়ে “The Messenger” শিরোনামে একটি বই লিখেন। পশ্চিমা জীবনের অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি সরলতম মুসলিমদের জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি কোনো আলেম বা ইসলামী চিন্তাবিদদের মাঝে ছিলেন না। তারা ছিলো মরুবাসী পশুপালক।

তিনি কী বললেন শেষে? বললেন, “আমি মরুবাসী আরবদের কাছে শিখেছি কী করে দুশ্চিন্তা দূর করতে হয়।”

তারা আল্লাহর দেওয়া তাকদিরে বিশ্বাস করে। নিরাপত্তাবোধ নিয়ে তারা জীবনযাপন করে। বিপদ আসলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে তা-ও না।

সেই লেখক লিখেন:

“একবার এক বিশাল মরুঝড়ে অনেক পশু মারা গেলো। অনেকগুলো জীবিত বালুচাপা পড়লো। আমি অত্যন্ত হতাশ হয়ে গেলাম। কিন্তু আরবদের দেখলাম তারা একে অপরের কাছে ছুটোছুটি করছে, গান গাইছে আর বলছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের চল্লিশ শতাংশ ভেড়ার কোনো ক্ষতিই হয়নি।’

যখন তারা দেখলো আমি চিন্তিত, তারা এসে বললো, ‘রাগ আর দুশ্চিন্তায় কোনো লাভ নেই। এ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ঘটনা।’ তা সত্ত্বেও তারা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় কোনো ত্রুটি করেনি।”

তাকদিরে বিশ্বাস করা বলতে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকাকে বোঝে না। তিনি আরও লিখেন:

“একবার গাড়িতে করে তাদের সাথে মরুভূমিতে যাত্রা করলাম। একটা টায়ার ফেটে গেলো। আমি রেগে গেলাম। তারা বললো, ‘রাগ করে লাভ নেই।’ গাড়িটা তিন চাকায় কিছুক্ষণ চললো। তারপর তেল শেষ হয়ে একেবারে থেমে গেলো।

তারপর তারা নেমে পায়ে হেঁটেই হরিণের বেগে চলতে লাগলো। তারা ছিলো সুখী-সন্তুষ্ট, পরস্পরকে কবিতা আওড়ে শোনাচ্ছিলো, আমার সাথে কথা বলছিলো।

তাদের সাথে সাত বছর থেকে আমি একটা জিনিস বুঝলাম। ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসরত যেসব মানুষ একাকিত্ব, মানসিক রোগ আর মাদকাসক্তিতে ভোগে, তারা আসলে পশ্চিমা শহুরে জীবনের দ্বারা আক্রান্ত। সেই জীবন যা তাড়াহুড়াকে জীবনের মূলনীতি বানিয়ে নিয়েছে।

Top