বরকাতময় ২৭শে রজবঃ রাসুলুল্লাহ صلى الله عليه و آله وسلم এর পবিত্র মেরাজ
আখেরী নবী, নবীয়্যিল উম্মীয়্যি তথা সকল নবীর মূল নবী হযরত মুহাম্মদ صلى الله عليه و آله وسلمকে আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য নবীদের তুলনায় অনেকগুলো বিষয়ে অতিরিক্ত মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসরা ও মি’রাজ। তিনি মক্কা থেকে হিজরতের পূর্বেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়।
মি’রাজের দিন তারিখ সম্পর্কে সীরাত গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা মশহুর মত হচ্ছে- নবুয়্যতের দশম বর্ষের ২৭শে রজব।
মি’রাজ শরীফ রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার শরীফ রাতে হয়েছে এটাই মশহূর, গ্রহণযোগ্য ও দলীলভিত্তিক মত।
এ প্রসঙ্গে তাফসীরে রুহুল বয়ান ৫ম জিলদ ১০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
وهى ليلة سبع وعشرين من رجب ليلة الاثنين وعليه عمل الناس قالوا انه عليه السلام ولد يوم الاثنين بعث يوم الاثنين واسرى به ليلة الاثنين وخرج من مكة يوم الاثنين ودخل الـمدينة يوم الاثنين ومات يوم الاثنين
অর্থাৎ: “রাতটি ছিলো রজব মাসের ২৭ তারিখ, সোমবার শরীফ।” এর উপরই বিশ্বের সকল ইমাম, মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের আমল। তাঁরা বলেন, “নিশ্চয়ই সাইয়্যিদুনা হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাদত শরীফ লাভ করেছেন সোমবার-এ, আনুষ্ঠানিকভাবে নুবুওওয়াত প্রকাশ পেয়েছে সোমবার-এ, ইসরা ও মিরাজ শরীফ হয়েছে সোমবার-এ, হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ থেকে বের হয়েছেন সোমবার-এ, মদীনা শরীফ-এ প্রবেশ করেছেন সোমবার-এ এবং বিছাল শরীফও লাভ করেছেন সোমবার-এ।”
[সূত্রঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান ৫ম জিলদ ১০৩ পৃষ্ঠা]।
পাক ভারত উপমহাদেশে হাদীছ শরীফ-এর প্রচার-প্রসারকারী হযরত শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তাঁর বিশ্বখ্যাত ‘মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’ কিতাবের ৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেন-
اعلم انه قد اشتهر فيما بين الناس بديار العرب ان معراجه صلى الله عليه وسلم كان لسبع وعشرين من رجب
অর্থাৎ: “জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই আরব জাহানের দেশগুলোর লোকদের মধ্যে মাশহূর বা প্রসিদ্ধ ছিলো যে, নিশ্চয়ই সাইয়্যিদুনা হযরত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মি’রাজ শরীফ সংঘটিত হয়েছিলো রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতেই।” সুবহানাল্লাহ!
[সূত্রঃ ‘মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’ কিতাবের ৭৩ পৃষ্ঠা]।
অনুরূপভাবে ফাতওয়ায়ে শামী খ্যাত হানাফী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ফতওয়ার কিতাব ‘রদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার’ কিতাবুছ ছলাত অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে-
وجزم الحافظ عبد الغنى الـمقدسى فى سيرته بانه ليلة السابع والعشرين من رجب وعليه عمل اهل الامصار.
অর্থাৎ: হযরত ইমাম হাফিয আব্দুল গণী মাক্বদিসী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তাঁর সীরাতগ্রন্থে চূড়ান্ত মতামত প্রকাশ করেন যে, মি’রাজ শরীফ হয়েছে রজব মাসের ২৭ তারিখ এবং এর উপরই সমগ্র দেশবাসী উনাদের আমল।
এছাড়াও আরো নির্ভরযোগ্য অনেক কিতাবেই উল্লেখ আছে যে, মি’রাজ শরীফ রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে হয়েছে।
[সূত্রঃ ফতোয়ায়ে শামী খ্যাত হানাফী মাযহাবের ফতোয়ার জগতে এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে প্রসিদ্ধ ‘রদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার’ কিতাবুছ ছলাত অধ্যায়]।
কাজেই, যারা টিভিসহ নানা চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকায় ও বই-পুস্তকের মাধ্যমে মি’রাজ শরীফ-এর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় তারা উলামায়ে ‘সূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী, তারা পথভ্রষ্ট বাতীল ফির্কা ওহাবী।
এদের সম্পর্কেই হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত হয়েছে-
عن حضرت انس رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ويل لامتى من علماء السوء يتخذون هذا العلم تجارة يبيعونـها من امراء زمانـهم ربحا لانفسهم لا اربح الله تجارتـهم
অর্থাৎ: হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের উলামায়ে ‘সূ’দের জন্যে জাহান্নাম; যারা ইলমকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের যামানার আমীর-উমরা বা রাজা-বাদশাহদের কাছে অর্থ ও পদ লাভের জন্য তা বিক্রি করে থাকে। তাদের এ ধর্মব্যবসায় আল্লাহ পাক কখনো বরকত দিবেন না।”
[সূত্রঃ মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল]।
হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে-
عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى اخر الزمان دجالون كذابون يأتونكم من الاحاديث بـما لـم تسمعوا انتم ولا اباؤكم فاياكم واياهم لا يضلونكم ولا يفتنونكم.
অর্থাৎ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমন সব (মিথ্যা-মনগড়া) কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। সাবধান! তোমরা তাদের থেকে দূরে থাকবে এবং তোমাদেরকে তাদের থেকে দূরে রাখবে। তবে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ করতে পারবে না এবং ফিতনায় ফেলতে পারবে না।
[সূত্রঃ মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ]।
শরীয়তের ফায়ছালা হলো উলামায়ে ‘সূ’ বা ধর্মব্যবসায়ীদের ওয়াজ শোনা, তাদের ফতওয়া মানা, তাদেরকে অনুসরণ করা হারাম, আর তাদের ছোহবত থেকে দূরে থাকা ফরয-ওয়াজিব।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ‘সূরা কাহাফ’-এ ইরশাদ করেন-
ولا تطع من اغفلنا قلبه عن ذكرنا واتبع هواه وكان امره فرطا
অর্থাৎ: “তোমরা ঐ ব্যক্তিকে অনুসরণ করোনা যার ক্বল্ব্ আমার যিকির থেকে গাফিল। সে নফসের পায়রবী করে আর তার কাজগুলো শরীয়তের খিলাফ।” অর্থাৎ যারা শরীয়তের খিলাফ কাজ করে তথা টিভি চ্যানেলে ক্বুরআন ও সুন্নাহর অপব্যাখ্যার প্রোগ্রাম করে তাদেরকে মহান আল্লাহ পাক তিনি অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।
আর হাদীছ শরীফ-এ নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
ان هذا العلم دين فانطروا عمن تأخذون دينكم
অর্থাৎ: “নিশ্চয়ই (কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এর) ইলমই হচ্ছে দ্বীন। সুতরাং, তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছো অর্থাৎ ইলম হাছিল করছো তা লক্ষ্য করো।”
[সূত্রঃ মিশকাত শরীফ]।
অতএব, যারা টিভি চ্যানেলসহ নানা চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকায় ও বই-পুস্তকের মাধ্যমে মি’রাজ শরীফ-এর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় তারা উলামায়ে ‘সূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী। এদের কোনো কথাই শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়।
আর ২৭শে রজব তারিখ মি’রাজ শরীফ নয় বলে তারা যে বক্তব্য প্রচার করছে তাদের সে প্রচারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও দলীলবিহীন। ইসলামে দলীলবিহীন কোন বিষয় আদৌ গ্রহনযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
هاتوا برهانكم ان كنتم صادقين
অর্থাৎ: যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দলীল পেশ করো।
কাজেই, যেসব উলামায়ে ‘সূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী মি’রাজ শরীফ রজব মাসের ২৭ তারিখ সংঘটিত হওয়ার বিশুদ্ধ ও মশহূর বর্ণনাকে সঠিক নয় বলে প্রচার করছে; তাদেরকে প্রমান দিতে হবে যে, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের কোথায় বা কোন দলীলে উল্লেখ আছে যে, মি’রাজ শরীফ রজব মাসের ২৭ তারিখ সঠিক নয়। এরূপ প্রমাণ তারা কখনই দিতে পারবে না, যদি দিতে পারতো তাহলে তাদেরকে হাদীছ শরীফ-এ দাজ্জালে কাযযাব অর্থাৎ চরম মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বলে কখনই উল্লেখ করা হতো না।
ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা কুরআনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও আংশিকভাবে এসেছে। বিস্তারিত ঘটনা বেশ কিছু হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণকে কুরআন শরীফে ইসরা (রাত্রিবেলার ভ্রমণ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, মহাপবিত্র সে সত্ত্বা, যিনি রাতের বেলায় তাঁর বান্দাকে ভ্রমণ করিয়েছেন, মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত- যার চতুর্পার্শ্বে আমি বরকত দিয়ে ভরে দিয়েছি, যাতে করে তাঁকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শনাদি দেখবার সুযোগ দেই। নিশ্চয়ই তিনি প্রবল শ্রবণকারী ও দর্শনকারী-
[সূত্রঃ বনী ইসরাইল-১]।
আর মসজিদুল আক্বসা থেকে ঊর্ধ্বগমনের অংশটুকু মি’রাজ নামে অভিহিত হয়েছে হাদীস শরীফে।
মি’রাজের বিস্তারিত ঘটনাকে সংক্ষেপে নিম্নরূপে পেশ করা যায় :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই সশরীরের মি’রাজ গমনের কথা স্বীকার করেছেন।
মি’রাজের ঘটনাটির সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে।
সূর্য্যের আলোর গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার (১৮৬০০০) মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব- নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ (৯৩০০০০০০) মাইল। অথচ নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلمমুহূর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদ্রাতুল মোন্তাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার (৯০০০০) কালাম করে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা তখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-এর নূরের গতি কত ছিল- এ থেকেই অনুমান করা যায়। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল-কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিল না।
[সূত্রঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান, সূরা বনী ইসরাঈল এর তাফসীর]।
মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মো’জেযা নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল।
যেমনঃ হযরত মুসা (আ.) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈছা (আ.) সশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (আ.) সশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-কে নিয়ে সবার উপরে তাঁকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। হযরত মুসা (আ.) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী صلى الله عليه و آله وسلم-কে আল্লাহ্তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিল সহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়ে ছিলেন। সেখানে সব নবীগণকে সশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করিমصلى الله عليه و آله وسلم--এর মোক্তাদী বানিয়ে ছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগণের ইমাম হয়ে নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-‘নবীগণেরও নবী রূপে বাস্তবে প্রমাণিত হয়ে ছিলেন। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাঁটু, নাক ও কপাল) দিয়ে সশরীরে নামায আদায় করে ছিলেন সেদিন। সমস্ত নবীগণ যে সশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রওযায় জীবিত আছেন (হাদীস শরীফ)।
মি’রাজের রাত্রে নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়ে ছিল জিব্রাইল, মিকাইল ও ইসরাফিল ফেরেস্তাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দ্বারা।
দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দছে নবীগণের (আ.) দ্বারা।
তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেস্তা, হুর ও নবীগণের দ্বারা।
চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা।
সিদ্রাতুল মোন্তাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য ‘হে প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকেট আসুন’- একথা বলে নবী صلى الله عليه و آله وسلم-কে সম্মানীত করেছিলেন। কোরআন মজিদের দানা আয়াতটি এদিকেই ইঙ্গিতবহ-বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাতশ বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত।
[সূত্রঃ ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’]।
মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়্যত প্রকাশের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ প্রকাশ্য নবুয়্যতের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর صلى الله عليه و آله وسلم-এর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়্যতের দ্বাদশ সাল।
তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে।
মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ।
বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মোন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ।
সিদ্রাতুল মোন্তাহা থেকে আরশ ও লা-মকান লা- যামান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
কোরআন, হাদীসে মোতাওয়াতির এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত।
মি’রাজের প্রথম পর্যায় :
রজব চাঁদের ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-বায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (রা.) ছিলেন হযরত আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-এর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরীফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (আ.) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়াত মোতাবেক-গণ্ড-দেশ দিয়ে নবী করিম صلى الله عليه و آله وسلم-এর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুঁটে যায়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবীজীকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। সিনা মোবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করে নূর এবং হেকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করলেন। এভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করলেন।
নিকটেই বোরাক দণ্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরনের। গাধার চেয়ে উঁচু, খচ্চরের চেয়ে নীচু, মুখমণ্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত।
[সূত্রঃ রুহুল বয়ান-সূরা বনী ইসরাঈল]।
মূলত বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন-যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (আ.) বললেন- “তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন- সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও”। বোরাক ভালোবাসার আতিশয্যে আবদার স্বরুপ বললো, কাল হাশরের দিনে নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-আমার জন্য আল্লাহর দরবারে সাক্ষাৎ করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো। নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-স্নেহের সাথে ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (আ.) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (আ.) রিকাব ধরে এবং ইসরাফিল (আ.) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেস্তার মিছিল। এ যেন দুল্হার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ছিলেন আরশের দুলহা।
[সূত্রঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান, সূরা বনী ইসরাঈল তাফসীর]।
মক্কা শরীফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদীনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা ছুন্নত! এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে।
নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম-হযরত মুসা (আ.) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন।
অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছের ছাখ্রা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (আ.) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) নবী করিমصلى الله عليه و آله وسلم-কে মোসল্লাতে দাঁড় করিয়ে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলেন! হুযুর صلى الله عليه و آله وسلم-সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেস্তাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন।
তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি।
প্রশ্ন জাগে-নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلم) কিভাবে ইমামতি করলেন?
বুঝা গেল- তিনি নামাযের নিয়মকানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন-তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে।
আজকে প্রমাণিত হলো- নবী করিম (صلى الله عليه و آله وسلم) হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (আ.)। নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিস) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবী করিম (صلى الله عليه و آله وسلم)। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন- “আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন”।
এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে।
তা হলো-আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে চারজন ব্যতীত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইন্তিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন- হযরত ইদ্রিছ (আ.) বেহেশতে, হযরত ঈছা (আ.) আকাশে, হযরত খিযির (আ.) জলভাগের দায়িত্বে এবং হযরত ইলিয়াছ (আ.) স্থলভাগের দায়িত্বে। জীবিত ও ইন্তিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) বিভিন্ন স্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে সশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত হলেন?
তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে- “জীবিত চারজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা সশরীরে এবং ইন্তিকালপ্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত করেছিলেন।”
[সূত্রঃ তাফসীরে রুহুল বয়ান]।
কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে সশরীরের উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মুহূর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সব কিছু শুনতে ও দেখতে পারেন।
[সূত্রঃ মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ]।
আধুনিক থিউসোফীতেও (আধ্যত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এস্ট্রাল বডি-ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফীর বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন।
আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে জিবরীল (আ.) এর সাহচর্য সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। সেখানে অবতরণ করে নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) অন্যান্য নবীদের ইমাম হয়ে নামায আদায় করেন। অত:পর সে রাতেই তাঁকে মসজিদুল আক্বসা থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। হযরত জিবরীল (আ.) দরজা খোলার জন্য আওয়াজ দিলে দরজা খোলা হয়। নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) হযরত আদম (আ.) কে দেখতে পেয়ে তাঁকে সালাম করলেন। হযরত আদম (আ.) প্রিয়নবীকে স্বাগত জানিয়ে সালামের জবাব দিলেন। তাঁর নবুয়্যতের স্বীকৃতি দিলেন। আল্লাহ তা’আলা তখন আদম (আ:)-এর ডান দিকে সমগ্র নেক্কারদের এবং বাম দিকে সমগ্র পাপীদের রূহসমূহ একত্রিত করে নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم-)কে দেখালেন।
অত:পর দ্বিতীয় আসমানে গেলে দেখা হল ইয়াহিয়া (আ.) এবং ঈসা (আ.)-এর সাথে।
তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ৬ষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এবং সর্বশেষ আসমানে ইবরাহীম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত হয়। এরপর নবী করীম (স.)কে আরও ঊর্ধ্বে নেয়া হয়, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার আওয়াজ কানে আসছিলো। অত:পর আরও ঊর্ধ্বে সিদরাতুল মুনতাহাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি আল্লাহর অতি কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। সে সময় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যা যা দেবার তা দান করেন এবং পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দেন। ফেরার পথে হযরত মুসা (আ.) এর সাথে পুনরায় সাক্ষাত হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা আপনাকে কি নির্দেশ প্রদান করেছেন? তিনি বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ দিয়েছেন। মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মতের জন্য এটি কঠিন হয়ে যাবে। আপনি আল্লাহর কাছে আবার গিয়ে নামাযের পরিমাণ কমিয়ে দেয়ার দরখাস্ত করুন। রাসুলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) হযরত জিবরীল (আ.) এর প্রতি তাকিয়ে তাঁর মতামত চাইলেন। জিবরীল (আ.) ইতিবাচক সাড়া দিলে আল্লাহর কাছে ফেরত গিয়ে নামাযের সংখ্যা কমানোর আবেদন জানালেন। কমানো হলো। পুনরায় মুসা (আ.) আরও কমানোর জন্য পাঠালেন। এভাবে বারবার যাওয়া আসা করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ালো ফরয নামাযের সংখ্যা। হযরত মুসা (আ.) আরও কমানোর জন্য যেতে বললে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) বললেন, আর যেতে আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। যতটুকু হয়েছে, তা আমি সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি। কিছুদূর চলে আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, ‘‘আমার পক্ষ থেকে ফরয নামায চূড়ান্ত করে দিলাম, আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিলাম, ওয়াক্তের সংখ্যা পাঁচে নামিয়ে দিলাম; কিন্তু সওয়াব ৫০ ওয়াক্তেরই দেবো’’।
[বিস্তারিত বর্ণনার জন্য দেখুন : ফতহুল বারী ও তাফসীর ইব্ন কাছীর]।
মি’রাজের অন্যতম প্রধান অর্জন হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায।
সুতরাং স্মরণ রাখতে হবে যে, ৫ বেলার নামাজ দ্বারা যেখানে ৫০ বেলার সওয়াব পাওয়া যাবে, তেমনি ৫ বেলার নামাজের ১ বেলা ছাড় গেলে কিংবা কেউ খামখেয়ালী করে তা মানোন্নীতভাবে না আদায় করলে এতে তার ১০ বেলার সুবিধাই বরবাদ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সকলের সাবধান থাকা কর্তব্য।
এছাড়াও নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم)কে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত, জাহান্নামের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী এবং আল্লাহর কুদরতের অনেক কিছু দেখান।
জাহান্নামের প্রধান নিয়ন্ত্রক ফিরিশতাকে তিনি দেখলেন যে, তাঁর চেহারায় হাসি-খুশীর লেশমাত্র নেই। জাহান্নামে অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের ধন সম্পদ আত্মসাতকারীদেরকে দেখলেন, তাদের ঠোঁটগুলো উটের ঠোঁটের মত মোটা। তারা পাথরের ন্যায় জ্বলন্ত অঙ্গার মুখে প্রবেশ করাচ্ছে, আর তা তাদের নাড়িভুঁড়ি সব জ্বালিয়ে গুহ্যদ্বার দিয়ে বের হয়ে আসছে।
জাহান্নামে তিনি ব্যভিচারীদেরকে দেখলেন যে, তাদের সামনে তাজা সুস্বাদু গোশত রয়েছে, তার পাশে রয়েছে পচা দুর্গন্ধময় গোশত। তারা তাজা ভাল গোশত রেখে পচাটাই খাচ্ছিল। যেহেতু দুনিয়াতে বৈধ স্বামী/স্ত্রী রেখে তারা পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত ছিল।
সুদখোরদের দেখলেন, তাদের পেট ইয়া বড় সাইজের। জাহান্নামে তারা এমনভাবে পড়ে আছে যে, একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না। ফেরাউন এবং তার অনুসারীরা জাহান্নামে চলাচলের সময় তাদেরকে পদদলিত করছিলো।
যেসব বিবাহিত মহিলা তাদের স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরপুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে তাদের শাস্তি দেখতে পেলেন, তাদের স্তনে কড়া লাগিয়ে তাদেরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে বহুবিধ গুনাহ’র শাস্তি প্রদানের দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা কুরআনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও আংশিকভাবে এসেছে। বিস্তারিত ঘটনা বেশ কিছু হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণকে কুরআন শরীফে ইসরা (রাত্রিবেলার ভ্রমণ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরা : আসরা শব্দটি আরবি। এর উৎপত্তি ইসরা থেকে। অভিধানে অর্থ হল, রাতে নিয়ে যাওয়া, রাতে ভ্রমণ করা, রাতে চলা ইত্যাদি। সারিয়াহ হল, রাতের বৃষ্টি এরপর লাইলান নাকেরাহ যোগ করে স্পষ্ট বুঝানো হয়েছে। সম্পূর্ণ রাতে নয়, বরং রাতের কিছু অংশে।
আসরা এর ব্যবহার পবিত্র কোরআনের সূরা বনী-ইসরাঈলসহ আরও বহু জায়গায় পাওয়া যায়।
পরিভাষায়, মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত সফরকে (ভ্রমণকে) ইসরা বলা হয়। একরাতের কিছু অংশে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলে।
মিরাজ : মিরাজ শব্দটিও আরবি। এটি করণ কারক। যার দ্বারা আরোহণ করা হয়। এটা উরজুন হতে এসেছে। অভিধানে অর্থ হল, সিঁড়ি, সোপান, ধাপ, ঊর্ধ্বগমন ইত্যাদি। কামুসুল ফিক্হ প্রণেতাও এ অর্থ করেছেন। মিরাজ শব্দটি ‘ইসমে আলার’ সীগাহ। অর্থ, উপরের দিকে উঠার যন্ত্র (মাধ্যম)। সিঁড়ি যেহেতু উপরের দিকে উঠার মাধ্যম তাই সিঁড়িকে মিরাজ বলে।
শারঈ অর্থে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে যে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم)-কে সাত আকাশ অতিক্রম করে লা মাকানে আরশে মুয়াল্লায় আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যবস্থাপনাকে মিরাজ বলা হয়। পরিভাষায়, মসজিদে আক্বসা থেকে সাত আকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা অতঃপর আরশে মুয়াল্লা ইত্যাদি ভ্রমণকে মিরাজ বলা হয়।
মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (صلى الله عليه و آله وسلم) মানব জ্ঞানের সীমা পেরিয়ে ঊর্ধ্বজগতে আরোহণ করে, আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যলাভ ও বাক্যালাপ করেন, তাই মিরাজ।
একরাতের কিছু অংশে রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে সাত আকাশ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন- এটিই মিরাজ।
‘মক্কা থেকে জেরুসালেম পর্যন্ত দ্রুতগামী উটে করে যাওয়ার সময় ছিলো ১ মাস এবং ফেরার সময়ও ছিলো ১ মাস।’
হিজরতের আগে একটি বিশেষ রাতের শেষপ্রহরে বায়তুল্লাহ হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বোরাকে ভ্রমণ, সেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাত আকাশ পেরিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে প্রভাতের আগেই স্বগৃহে ফিরে আসেন।
স্বশরীরে মিরাজঃ
বিশ্বনবী (صلى الله عليه و آله وسلم)-এর মিরাজ দৈহিক ও শারিরীক ছিল।
মহান আল্লাহ বলেন, ছুবহানাল্লাযী আছরা .............. ইন্নাহু হুয়াচ্ছামিউল বাসির। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত- ০১) অর্থাৎ “মহান সেই সত্ত্বা যিনি তার বান্দাকে রাতের একাংশে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন, যার চতুর্দিকে আমি বরকতময় করে দিয়েছি, যাতে আমি তাঁকে আমার অসিম কুদরতের নিদর্শনাবলী দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”।
অত্র আয়াতের বিশ্লেষণ করলে বিস্ময়কর সত্যতার প্রমাণ ঘটে।
‘ছুবহানা’ শব্দের ব্যবহারে বলা যায় যে, এ ঘটনা অবিস্মরনীয় বা আশ্চার্যের বিষয়। কেননা তা স্বাপ্নিক বা আত্মিক হলে এই শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। (ছুবহানাল্লাহ্)
আয়াতের মধ্যে ‘আবদুন’ শব্দটিও এসেছে, আবদুন শব্দের পূর্ণঙ্গতা আসে রুহ ও বদন তথা শরীরের সমষ্টিকে বুঝায়। তাই এই আয়াতে মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে তাই প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআলা রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) জন্য সূরা বানী ইসরাঈল ছাড়াও অন্য জায়গাতে আবদুন ও আব্দুল্লাহ ব্যবহার করেছেন। যেমন, আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে নিষেধ করে এক বান্দাহকে হযরত মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم) কে, যখন সে নামায পড়ে।
[সূরা-আলাক : ৯-১০]।
আল্লাহর বান্দাহ মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم) যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ায় তখন তাঁর কাছে লোকেরা জড়ো হয়ে যায়।
[সূরা-জ্বীন : ১৯]।
ওই দুটি আয়াতে আবদুন ও আব্দুল্লাহ্ শব্দ রয়েছে। যার অর্থ রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) আত্মা ও দেহ। এর অর্থ শুধু আত্মা নয়। তাই বানী ইসরাঈলের বিআবদিহি দ্বারা রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকে বুঝায়। এজন্যে মেরাজ স্বশরীরে হবারই প্রমাণ মিলে।
ওই আয়াতে আসরা শব্দও আছে। আসরা শব্দটি ইসরা হতে এসেছে। অর্থ রাতে ভ্রমণ।
পবিত্র কোরআনের (সূরা বানী ইসরাঈল ব্যতীত) অন্যান্য জায়গাতে রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) ছাড়া অন্যান্য নবীদের ক্ষেত্রেও ইসরা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেসব জায়গাতে ইসরাকে সেসব নবীদের আত্মা ও দেহের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। তাই বানীইসরাঈলের ‘আসরা’ বারাকে রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) আত্মা ও দেহ উভয়টির উপর প্রয়োগ করা বুঝায়।
মিরাজের রাতে রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) সাত আকাশ পেরিয়ে আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাঁর দৃষ্টি (আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখতে) একটু টলেওনি এবং এদিক-ওদিকেও ধাবিত হয়নি। সে নিজ রবের বিরাট বিরাট নিদর্শন দেখেছে।’
[সূরা-নাজম : ১৭-১৮]।
মানুষের চোখ দেহেরই অঙ্গ। তাই মিরাজের রাতে রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) আল্লাহর নিদর্শন দেখাটা স্বশরীরে হয়েছিল, স্বপ্নে নয়।
রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করলে, কাফিরেরা মিথ্যারোপ ও ঠাট্টা করলো। এমনকি কতক নও মুসলিম ধর্ম ত্যাগ করলো। মিরাজ স্বপ্নে হলে এ সবের কি সম্ভাবনা ছিলো?
আয়াতে ‘লিনুরিয়াহু’ শব্দের অর্থে আসছে চুক্ষুসভাবে অবলোকনের মাধ্যমে যে জ্ঞান পরিপূর্ণ হয়। আর এ বিষয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ হলো চক্ষু দর্শন স্বপ্ন দর্শন নয়।
রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم)-এর মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে, কাজী আয়াজ বলেন, অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম সলফে ছালেহীন, ফোকাহা, মুহাদ্দীসিন ও মুতাকাল্লোমীন এমত প্রকাশ করেছেন।
[সূত্রঃ মিরকাত ১১/১৩৮ পৃষ্ঠা]।
আকায়েদে নাছাফীর ইবারাতের অনুবাদ আনুযায়ী হযরত রাসুল (صلى الله عليه و آله وسلم)-এর মিরাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় সপ্ত আকাশ পেরিয়ে আল্লাহ পাকের ইচ্ছানুযায়ী আরশ্ মুয়াল্লায় সংঘটিত হয়েছে। একথা বাস্তব সত্য যা খবরে মাশহুর দ্বারা সাব্যস্ত। যারা এ মতের বিরোধী তারা বিদ্আতী।
[সূত্রঃ শরহে আকায়েদে নাছাফী- ১৩৫ পৃষ্ঠা]।
সীরাতে হালবীয়া ১ম খণ্ড ৪০৫ পৃষ্ঠার বর্ণনা মতে, রাসুল (صلى الله عليه و آله وسلم) হযরত উম্মে হানীর ঘরে ঘুমান্ত ছিলেন, উম্মে হানী বলেন, আমি রাতে তাঁকে দেখতে না পেয়ে আমার নিদ্রা চলে যায়; এই আশংকায় যে, হয়ত কোন কোরাইশী শত্রু তাকে পাকড়াও করেছে। ইবনে সা’দ বলেন, ঐ রাতে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।
[সূত্রঃ সীরাতে হালবীয়া ১ম খণ্ড ৪০৫ পৃষ্ঠা]।
মিরাজ স্বপ্নে হলে ঘর হতে অন্তর্হিত (Absent) হওয়ার প্রশ্ন উঠেই না।
তাফসীর ইবন্ কাছীরে আছে, ইবন্ আউস (রা.) বর্ণনা করেন, মিরাজ রাত্রির ভোরে হযরত আবু বকর (রা.) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি রাতের বেলায় কোথায় গিয়েছিলেন? আমি আপনাকে সম্ভাব্য সব স্থানেই খুঁজেছি। তখন মহানবী (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজের বর্ণনা দেন।
মিরাজ নিছক স্বপ্নে হলে, হযরত আবু বকর (রা.)-এর তালাশ করে না পাওয়ার প্রশ্ন উঠে না।
পবিত্র কোরআন দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত সুলাইমান (আ.) একটি যানে চড়ে সকালে এক মাসের পথ এবং সন্ধ্যা বেলায় এক মাসের পথ ভ্রমণ করতেন।
[সূরা-সাবা : ১২]।
হযরত সুলাইমান (আ.)-এর এ ভ্রমণ সম্ভব হলে আমাদের নবীর (صلى الله عليه و آله وسلم) পক্ষে বোরাক ও রফরফের মাধ্যমে এ ভ্রমণ সম্ভব নয় কি?
রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে পত্র লিখে দেহইয়া ইবন্ খলীফাকে প্রেরণ করেন। এরপর দেহইয়ার পত্র পৌঁছান, রোম সম্রাট পর্যন্ত পৌঁছা এবং তিনি যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সম্রাট ছিলেন এসব কথা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে, যা বুখারী ও হাদীসের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে।
এ বর্ণনার উপসংহারে বলা হয়েছে যে, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস পত্র পাঠ করার পর রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) অবস্থা জানার জন্য আরবের কিছু সংখ্যক লোককে তার দরবারে সমবেত করতে চাইলেন।
আবু সুফিয়ান ইবন্ হরব ও তার সঙ্গীরা সে সময় বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে সে দেশে গমন করেছিল। নির্দেশ অনুযায়ী তাদের দরবারে উপস্থিত করা হলো। আবু সুফিয়ানের আন্তরিক বাসনা ছিলো যে, সে এ সুযোগে রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) সম্পর্কে এমন কিছু কথাবার্তা বলবে যাতে, সম্রাটের সামনে তার ভাবমূর্তি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু আবু সুফিয়ান নিজেই বলে যে, আমার এ ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করার পথে একটি মাত্র অন্তরায় ছিলো। তা এই যে, আমার মুখ দিয়ে কোনো সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা বের হয়ে পড়লে সম্রাটের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন হবো এবং আমার সঙ্গীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে ভর্ৎসনা করবে। তখন আমার মনে মিরাজের ঘটনাটি বর্ণনা করার ইচ্ছা জাগে। এটা যে মিথ্যা ঘটনা তা সম্রাট নিজেই বুঝে নিবেন।
আমি বললাম : আমি তার ব্যাপারটি আপনার কাছে বর্ণনা করছি। আপনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন যে, ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনাটি কি?
আবু সুফিয়ান বললো : নবুওয়াতের এ দাবীদারের উক্তি এই যে, সে এক রাতে মক্কা থেকে বের হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং প্রত্যুষের পূর্বেই মক্কায় আমাদের কাছে ফিরে এসেছে।
ইলিয়ার (মসজিদে আকসার) সর্বপ্রধান যাজক ও পাদরী তখন রোম সম্রাটের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, আমি সে রাত সম্পর্কে জানি। রোম সম্রাট বললেন, আপনি এ সম্পর্কে কিরূপে জানেন?
তিনি বললেন : আমি বায়তুল মুকাদ্দাসের সব দরজা বন্ধ না করে শয্যা গ্রহণ করতাম না। সে রাতে আমি সব দরজা বন্ধ করেছিলাম, কিন্তু একটি দরজা আমার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হলো না (দরজার কপাট স্বস্থান থেকে মোটেই নড়ছিলো না)। মনে হচ্ছিলো যেন আমরা কোনো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লাগাচ্ছি। আমি অপারগ হয়ে কর্মকার ও মিস্ত্রীদের ডাকলাম। তারা পরীক্ষা করে বললো, কপাটের উপর প্রাচীরের বোঝা চেপে বসেছে। এখন ভোর না হওয়া পর্যন্ত দরজা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। সকালে আমরা চেষ্টা করে দেখবো, কি করা যায়। আমি বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম এবং দরজার কপাট খোলাই থেকে গেলো। সকাল হওয়া মাত্র আমি সে দরজার নিকট উপস্থিত হয়ে দেখি যে, মসজিদের দরজার কাছে ছিদ্র করা এক প্রস্তর খন্ড পড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছিল যে, ওখানে কোনো জন্তু বাঁধা হয়েছিল।
তখন আমি সঙ্গীদেরকে বলেছিলাম : আল্লাহ তাআলা এ দরজাটি সম্ভবত, এ কারণে বন্ধ হতে দেননি যে, হয়তো বা আল্লাহর কোনো প্রিয় বান্দাহ আগমন করেছিলেন। তিনি বর্ণনা দেন যে, ঐ রাতে তিনি আমাদের মসজিদে নামায পড়েন। তিনি আরও বিশদ বর্ণনা দিলেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, সে দর্শনটাকে যেটা আমি তোমাকে (মিরাজের রাতে) দেখিয়েছিলাম, সেটাকে আমি মানুষের জন্য পরীক্ষায় পরিণত করেছিলাম।
[সূরা-ইসরা : ৬০]।
এ দর্শনের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবন্ আব্বাস (রা.) বলেন, ঐ দর্শনটা ছিলো চোখের দেখা। যা রাসূলকে (صلى الله عليه و آله وسلم) সে রাতে দেখানো হয়েছিলো যে রাতে তাঁকে ভ্রমণ করানো হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে।
[সূত্রঃ বুখারী : ৩/১০৮]।
হযরত ইবন্ আব্বাস (রা.)-এর অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘ঐ দেখাটা স্বপ্নে দেখা নয়।’
[সূত্রঃ সুনান সাঈদ ইবন মানসুর]।
অাম্মা আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, মিরাজের রাতে রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم-) দেহ উধাও হয়নি। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র তাঁর আত্মাটাকে ঐ রাতে চড়ানো হয়েছিল। হযরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজটা ছিলো সত্য স্বপ্ন।
[সূত্রঃ সুনান সাঈদ ইবন মানসুর]।
উক্ত দুটি বর্ণনা প্রমাণ করে মিরাজ হয়েছিল স্বপ্নে। স্বশরীরে নয়।
কিন্তু কিছু কারণে ওই দুটি বর্ণনা দলিলযোগ্য নয়।
যেমন : আম্মা আয়িশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বর্ণনায় একজন বর্ণনাকারী অপরিচিত। হযরত মুয়াবিয়ার (রা.) বর্ণনাটি মুনকাতি বা সূত্র ছিন্ন।
হাদীস নীতিশাস্ত্রবিদদের মতে, অজ্ঞাত পরিচয়ের বর্ণনা এবং সূত্র ছিন্ন বর্ণনা দুর্বল বর্ণনা, যা দলিলযোগ্য হয় না।
আল্লামা কার্যইয়াস বলেন, ঐ হাদীসটি প্রামাণ্য নয়। ইবন্ দিহায়াহা ঐ হাদীসটিকে জাল বলেছেন।
রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজের সময় আম্মা আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) তাঁর স্ত্রী ছিলেন না। এর ফলে আয়িশা (রা.) মিরাজ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি। এছাড়া এ বর্ণনা উম্মে হানীর (রা.) বর্ণনার বিপরীত। যার ঘর হতে মিরাজের সূত্রপাত হয়েছিল।
রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজ সংঘটিত হওয়ার সময় মুয়াবিয়া (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই তাঁর বর্ণনা মিরাজের সাক্ষ্য নয়। এছাড়া এটা তাঁর ব্যক্তিগত বর্ণনা। যা রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে নয়।
আল্লামা নাসাফী বলেন, মুয়াবিয়া (রা.) ও আয়িশার (রা.) মতে, মিরাজ স্বপ্নে ছিলো তা নয়। বরং মুয়াবিয়ার মতে, রূইয়া অর্থ স্বপ্ন নয় বরং এর অর্থ রূইয়া বিল আইন বা চোখে দেখা। তাঁর আত্মা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং মিরাজটা তাঁর দেহ ও আত্মা উভয় সহকারেই হয়েছিল।
মিরাজ স্বশরীরে হয়েছিল। স্বপ্নে নয়। তাই লা মাযহাবী রাফাদানীদের শায়খ, নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালীও স্বীকার করে বলেন, সালাফ ও খালাফ তথা পূর্ববর্তী বিদ্বানদের অধিকাংশের মতে, রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) মিরাজ স্বশরীরে ও আত্মাসহকারে জাগ্রত অবস্থায় মক্কা হতে বায়তুল মুকাদ্দাসে এবং তারপর তা সাত আকাশ পর্যন্ত হয়েছিল। এর প্রমাণে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে। তাই কোরআনের আয়াত এবং সহীহ হাদীসগুলোর বাহ্যিকভাবে বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন নেই।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে মিরাজের বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
তিরমিযী ও নাসায়ী শরীফেও এর কিছু বর্ণনা বিভিন্ন পরিচ্ছেদে রয়েছে।
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (র.) ৭ জন সাহাবী থেকে তা বর্ণনা করেছেন।
তাঁরা হলেন -
১) আবু যর (রা.), ২) মালিক ইবন্ সা‘সাআহ (রা.), ৩) আনাস ইবন্ মালিক (রা.), ৪) আব্দুল্লাহ ইবন্ আব্বাস (রা.), ৫) আবু হুরায়রা (রা.), ৬) জাবির ইবন্ আব্দুল্লাহ (রা.) এবং ৭) আব্দুল্লাহইবন্ মাসউদ (রা.)।
তাফসীরে কুরতুবীতে রয়েছে, ‘ইসরার’ হাদীসসমূহ সব মুতাওয়াতির। আবু বকর নাক্কাশ এ সম্পর্কে ২০ জন সাহাবীর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন এবং কাযী আয়ায ‘শেফা’ গ্রন্থে আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
কেউ বলেন, ওর বর্ণনাকারী ৩০ জন সাহাবী ও সাহাবীয়াত্।
উপমহাদেশের অপর এক পরিচিত আলেম মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান নদভী বলেন, হাদীস ও রাসূলের (صلى الله عليه و آله وسلم) জীবনী শাস্ত্রের গ্রন্থাবলীতে মিরাজ বর্ণনাকারী ৪৫ জন সাহাবীর নাম আল্লামা যুরকানী রহমাতুল্লাহি 'আলাইহি লিখেছেন।
ইমাম ইবন্ কাছীর (র.) স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে এসব বর্ণনা পূর্ণরূপে যাচাই-বাছাই করেছেন। তিনি ২৫ জন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের কাছ থেকে এসব রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।
তাঁদের নাম গুলো এই :
১) উমার ইবন্ খত্তাব (রা.), ২) আলি (রা.), ৩) ইবন্ মাসউদ (রা.), ৪) আবু যর (রা.), ৫) মালিক ইবন্ সা‘সাআহ (রা.), ৬) আবু হুরায়রা (রা.), ৭) আবু সায়ীদ (রা.), ৮) ইবন্ আব্বাস (রা.), ৯) শাদ্দাদ ইবন্ আউস (রা.), ১০) উবাই ইবন্ কাব (রা.), ১১) আব্দুর রহমান ইবন্ কুর্য (রা.), ১২) আবু হাইয়া (রা.), ১৩) আবু লাইলা (রা.), ১৪) আব্দুল্লাহইবন্ উমার (রা.), ১৫) জাবির ইবন্ আব্দুল্লাহ (রা.), ১৬) হুযায়ফা ইবন্ ইয়ামান (রা.), ১৭) বুরায়দাহ (রা.), ১৮) আবু আইউব আনসারী (রা.), ১৯) আবু উমামা (রা.), ২০) সামুরা ইবন্ জুনদুব (রা.), ২১) আবুল হামরা (রা.), ২২) সোহায়েব রুমী (রা.), ২৩) উম্মে হানী (রা.), ২৪) আয়িশা (রা.) এবং ২৫) আসমা বিনত্ আবি বকর (রা.)।
এরপর ইবন্ কাছীর (র.) বলেন, ইসরার হাদীস সম্পর্কে সব মুসলমানের ঐকমত্য রয়েছে। শুধু ধর্মদ্রোহী যিন্দীকরা একে মানেনি।
মিরাজ শরীফের আমলী ফযীলতঃ
গাউছুল আযম, আওলাদে রসূল, মুহিউদ্দীন হযরত সাইয়্যিদ আব্দুল ক্বাদির জিলানী হাম্বলী আশয়ারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের কাছে খবর দিয়েছেন হযরত শায়েখ আবুল বারাকাত হাক্কাতুল্লাহ সাকতী রহমতুল্লাহি আলাইহি। সনদ পরস্পরায় ছাহাবী হযরত আবূ সালামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর ছাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর ও ছাহাবী হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর থেকে বর্ণিত আছে। তাঁরা বলেন, সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রজব মাসে এমন একটি দিন ও রাত আছে, যে ব্যক্তি ওই দিনে রোযা রাখবে এবং রাতে ইবাদত-বন্দেগী করবে, তাকে শত শত বছর দিনে রোযা রাখার এবং শত শত বছর ইবাদত-বন্দেগী করার ছওয়াব দান করা হবে।” আর সেই দিন রাতটি হচ্ছে রজব মাসের তিনদিন অবশিষ্ট থাকতেই (অর্থাৎ ২৭ রজব তথা মিরাজ শরীফ-এর দিন ও রাত)। ঐ দিন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশেষ নিয়ামত হাদিয়া করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদাণ করা হয়েছিলো।
[সূত্রঃ গুনয়িতুত ত্বালিবীন, ৩য় পর্ব, ৩৩২ পৃষ্ঠা]।
শবে মে'রাজের ফজিলত
________
উম্মতের বেলায় শবে মে'রাজ অপেক্ষা শবে কদর উত্তম।
আর হুজুর কারিম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের বেলায় শবে মে'রাজ শবে কদর অপেক্ষা উত্তম।
[সূত্রঃ মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, খণ্ড ২, পৃৃষ্ঠা ৪]।
দখলদার ইহুদি ওহাবী বাতীল ফির্কা ব্রিটিশ মদদে আরব দেশ দখলের আগে আরবদেশে রজব শরীফ উদযাপন।
'রুহুল বয়ান' ও 'মা- সাবাতা বিস্ সুন্নাহ্'র ভাষ্য থেকে প্রকাশ যে, মানুষের মধ্যে শবে মি'রাজ উদযাপনের প্রচলন ছিল। বিশেষতঃ আরব দেশের অধিবাসীরা এই মুবারাক রজনীর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব স্বীকার করতেন।
দেখুন- রুহুল বয়ানে রয়েছেঃ
শবে মি'রাজ হল রজবের ২৭ তারিখ এবং তার উপর মানুষের আমল রয়েছে।
[সূত্রঃ রুহুল বয়ান, খণ্ড ৫, পৃৃষ্ঠা ১০৩]।
প্রতীয়মান হল- মানুষেরা ঐ রাতে কিছু না কিছু করতেন।
আর মা- সাবাতা বিস্ সুন্নাহয় রয়েছেঃ
জেনে রেখো, আরব দেশে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের মি'রাজ শরীফ ২৭শে রজব হয়েছে এবং রজব উদযাপনের দিন ও তারিখ আরব দেশে আরববাসীদের মধ্যে বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ।
[সূত্রঃ মা- সাবাতা বিস্ সুন্নাহ্, পৃৃষ্ঠা ১৯১]।
রজব শরীফ উদযাপনকে যারা বিদআত বলে, তাদের কথা বাতিল। তারা দ্বীন ইসলামের শত্রু।
____________
আরও পড়ুনঃ
▆ পাঁচ রাতের দুআ'র গুরুত্ববহ হাদিস
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1768544573460980
________
▆ রাতের এক তৃতীয়াংশে আল্লাহ্ সূবহানাহু ওয়াতা'আলার "অবতরণ" শব্দের হাদিস সম্পর্কে সঠিক বিশ্বাস।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1764842100497894
________
▆ মেরাজের রাতে প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله و سلم) আল্লাহকে দেখেছেন
নোট ০১.
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1778671925781578
নোট ০২.
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1778095105839260
নোট ০৩.
ahlussunnahmedia.com
পরিবেশিত 11.84MB ভিডিওতে কিতাবের স্ক্রিনশট সহ আলোচনা বাংলায় শুনতে লিংকে প্রবেশ করুন।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1163169653809463
_______
▆ মেরাজ রজনীতে মাহফিলের আয়োজন করা
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1779892632326174
___________
▆ মিরাজ সফরে আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. : স্বশরীরে না রুহানী।
আলোচনা : ভিডিও 98.35MB
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1166166236843138
_________