কুফা শহর ও হানাফী মাযহাবের সূত্রপাত
=============================
আজকাল অনেককে দেখা যায়, তারা হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের বলছে ‘তোমরা কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে ইমাম আবূ হানীফাকে মানছো। অতএব, তোমরা শিরক করছো।’
আমরা বলব, যারা হানাফী মাযহাব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ তাদের পক্ষে এমন কথা বলা সম্ভব। যারা হানাফী মাযহাবের উৎস সম্পর্কে জানে তারা কখনোই এমন কথা বলতে পারে না।
.
আমি এখানে হানাফী মাযহাব কোথা থেকে আসল, কীভাবে আসল, কীভাবে হানাফী মাযহাব সৃষ্টি হলো সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
সতের হিজরীতে হযরত উমর রাদি. কর্তৃক ইরাক বিজয় হলো। ইরাকে তিনি একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করলেন। শহরটির নাম রাখলেন ‘কূফা’। এই নতুন শরহটি মূলত মুসলমানদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং ইরাকের প্রশাসনের কাজ এখান থেকেই পরিচালিত হত। হযরত উমর রাদি. বিজিত এলাকার জনগণকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বিজ্ঞ সাহাবায়ে কেরামকে বিভিন্ন এলাকার মুআল্লিম করে পাঠাতেন।
সেই ধারাবাহিকতায় তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদি.কে ইরাকের মুআল্লিম করে পাঠালেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদি. কূফা নগরীতে অবস্থান করেছিলেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. নবীজী ﷺ এর সফর সঙ্গী ছিলেন। তিনি নবীজী ﷺ কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাই নবীজী ﷺ এর কথা-কাজ খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।
নবীজী ﷺ এর ঘরে তার এতবেশি যাতায়াত ছিল যে, আগন্তুকরা মনে করতো তিনি নবীজী ﷺ এর পরিবারেরই একজন সদস্য। নবীজী ﷺ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. এর ইলমের উপর এত আস্থাশীল ছিলেন যে, তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ আমার উম্মাতের জন্য যা পছন্দ করবে আমি তা পছন্দ করলাম, আর সে আমার উম্মাতের জন্য যা অপছন্দ করবে আমি তা অপছন্দ করলাম।’ (ফাযায়েলুস সাহাবা, আহমাদ ইবনে হাম্বল হা.নং ১৫৩৬)
নবীজী ﷺ আরো বলেনঃ ‘আমি যদি মাশওয়ারা ছাড়াই কাউকে আমার খলীফা নিযুক্ত করতাম, তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদকে আমার খলীফা বানাতাম।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা:৭/৪২৩ মাকতাবায়ে শামেলা)
নবীজী ﷺ আরো বলেন, কুরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবে তরতাজাভাবে যে কুরআন পড়তে চায়, সে যেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ এর তিলাওয়াত অনুসরণ করে।’ (মুসনাদে আহমাদ হা.নং ১৮৪৫৭)
নবীজী ﷺ আরো বলেন,‘তোমরা চারজন থেকে কুরআনের ইলম হাসিল করো; ১.আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ থেকে ২. উবাই ইবনে কাআব থেকে ৩. মুআয ইবনে জাবাল থেকে ৪. আবূ হুযাইফার আযাদকৃত গোলাম সালেম থেকে।’ (সুনানে তিরমিযী হা.নং৩৮৯৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. সম্পর্কে হযরত উমর রাযি. এর মন্তব্য হলো, ﻛﻨﻴﻒ ﻣﻠﻰﺀ ﻋﻠﻤﺎ ‘তিনি ইলমে পরিপূর্ণ একটি ঘর।’ (ফাযায়েলে সাহাবা হা.নং১৫৫০) সূরা মুহাম্মাদ এর ষোল নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘তাদের (মুনাফিকদের) মধ্য থেকে কিছু লোক আপনার কথা শ্রবণ করে, অতঃপর আপনার নিকট থেকে বের হয়ে যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত তাদেরকে বলে, এই মাত্র তিনি কী বললেন?’ এখানে জ্ঞানপ্রাপ্ত বলে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. কে বুঝানো হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা:৭/২৯০ মাকতাবায়ে শামেলা)
আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. অসংখ্য ফযীলতের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি ফযীলতের কথা এখানে উল্লেখ করলাম যা দ্বারা স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হলো যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে একজন বড় মাপের আলেম ছিলেন। তিনি কূফা নগরীতে ছাত্রদের বিশাল মজমায় কুরআন-সুন্নাহের দরস দিতেন। কুরআন-সুন্নাহের আলোকে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান দিতেন।
ইবনুল কাইয়্যিম জাওযিয়া রহ. বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর মধ্যে সাতজন সর্বাধিক ফাতাওয়া-ফারায়েযের কাজ করেছেন। তিনি সাতজনের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বরে যথাক্রমে হযরত আলী রাযি. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি.কে উল্লেখ করেছেন। (উসূলুল ইফতা:পৃ.৩৪)
আর আল্লাহর মেহেরবানীতে এই দু‘জনই কূফা নগরীতে নিজেদের ইলম বিতরণ করেছেন। এই দু‘জন ছাড়া আরো প্রায় পনেরশত সাহাবায়ে কেরাম রাযি. কূফা নগরীতে অবস্থান করেছিলেন। যার ফলে কূফা নগরী তখন ইলম চর্চার মারকাযে পরিণত হয়েছিল।
৩২ হিজরীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. এর ইন্তিকালের পর তাঁর সুযোগ্য শিষ্য আলকামা বিন কয়েস রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. এর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি কূফায় দরস ও তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম থেকে আহরিত কুরআন-সুন্নাহ, ও ফাতাওয়া-ফারায়েযের ইলম বিতরণ করতে থাকেন।
৬২ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সুযোগ্য শাগরিদ প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ফকীহ ইবরাহীম নাখায়ী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
৯৬ হিজরীতে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কুরআন-সুন্নাহ ও ফাতাওয়া-ফারায়েযের খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন।
তাঁর ইন্তিকালের পর ইলমের এই মীরাসের অধিকারী হন আবূ হানীফা রহ. এর উস্তাদ হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান।
হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান ইবরাহীম নাখায়ী রহ. এর ইন্তিকালের পর কূফার ইলমী খিদমাত আঞ্জাম দিতে থাকেন। ১২০ হিজরীতে হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমান রহ. এর ইন্তিকালের পর তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইমাম আবূ হানীফা কূফার ইলমী মসনদে আরোহণ করেন।
ইমাম আবূ হানীফা রহ. তাঁর চল্লিশজন ছাত্রের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর মেহনত করে কুরআন-সুন্নাহ, ফাতাওয়া-ফারায়েযের যে ইলম তাঁর কাছে পৌঁছেছে তা তিনি অধ্যায় ভিত্তিক সাজিয়ে কিতাব আকারে সংকলন করেন।
যেহেতু সংকলকদের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা রহ. সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বেই সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে, তাই সংকলিত কুরআন-সুন্নাহর ঐ ইলমকে ফিকহু আবী হানীফা ও মাযহাবু আবী হানীফা (আবূ হানীফার ফিকহ বা আবূ হানীফার মাযহাব ও হানাফী মাযহাব) বলা হয়ে থাকে।
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, হানাফী মাযহাব ইমাম আবূ হানীফার ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ নয়। হানাফী মাযহাব অনুসরণ করার দ্বারা ইমাম আবূ হানীফাকে অনুসরণ করা হয় না; বরং হানাফী মাযহাব অনুসরণ করার অর্থ হলো, কুরআন-সুন্নাহর ঐ ইলমকে অনুসরণ করা যা ইমাম আবূ হানীফা হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমান এর সূত্রে, হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমান ইবরাহীম নাখায়ী এর সূত্রে, ইবরাহীম নাখায়ী আলকামা বিন কায়েস এর সূত্রে, আলকামা বিন কায়েস আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. এর সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর সূত্রে, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ জিবারাঈল আমীন আ. এর মাধ্যমে স্বয়ং রাব্বুল আলামীন থেকে পেয়েছেন।
অতএব, যারা এ কথা বলে বেড়ায় যে, ‘হানাফীরা কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে, স্বয়ং নবীজী ﷺ কে ছেড়ে ইমাম আবূ হানীফাকে মানে, তাই তারা মুশরিক’ তারা কী পরিমাণ অজ্ঞ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।