সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দনি আল আযহারী
সহকারী অধ্যাপক , ইসলামকি স্টাডজি বভিাগ, সার্দান বশ্বিবদ্যিালয়, বাংলাদশে. খতবি, মুসাফরি খানা জামে মসজদি, নন্দনকানন, চট্রগ্রাম।
চন্দ, সুর্য, গ্রহ তারা, নীল আসমান, গাছপালা, তরুলতা, ফুল-ফল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়, ঝর্ণা আর হাজরো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী যাঁর উসিলায় সৃজিত, যিনি সৃষ্টি না হলে আসমান যমীনের কিছুই সৃষ্টি হতো না, তিনিই আমাদের প্রিয়নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহাকালের মানব ইতিহাসে তিনিই সর্বশ্রেষ্ট, সবচেয়ে মহান, সবচেয়ে পবিত্র।
বেলাদত ও জন্মগ্রহণ প্রত্যেক মানুষের জন্যই খুশি ও আনন্দের পরিচায়ক হয়ে থাকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জন্মদিনের একটি নির্দিষ্ট গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। আর এই গুরুত্ব সে সময় আরও বেড়ে যায় যখন সেদিনগুলোর সম্পর্ক আম্বিয়া (আলাইহিমুস্সালাম)-এর সাথে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের জন্ম আসলেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালার শ্রেষ্ঠ ও বৃহত্তম নেয়ামত। প্রত্যেক নবীর জন্ম নেয়ামতের ওসীলায় সংশ্লিষ্ট উম্মতগণ অন্য সকল নেয়ামত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে। হুযুর নবীয়ে আকরাম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদকায় উম্মতে মুহাম্মদীর আবির্ভাব ও নব্যুয়তে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানী হেদায়েতের নিয়ামত, ওহীয়ে রাব্বানীর নেয়ামত নুযুলে কোরআন ও মাহে রমযানের নেয়ামত, জুমা ও ঈদাইনের (দুই ঈদ) নেয়ামত, শরফ ও ফযিলত মূলত: সুন্নাত ও সীরাতে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই নেয়ামত।
মোটকথা, যতসব নেয়ামত ক্রমাগতভাবে দান করা হয়েছে ওই সকল নেয়ামতের মূল প্রতিপাদক এবং রবিউল আউয়ালের মূলকেন্দ্র হচ্ছে আনন্দপূর্ণ ও প্রাণস্পর্শী বসন্তের সমুজ্জ্বল সুবহে সাদেক, যখন হুযুর নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌভাগ্যময় বেলাদত হয়েছে এবং সেই বরকতপূর্ণ দিন যখন পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পৃথিবীর পানি ও ফুলের পরিবেশে আগমন করেছিলেন। সুতরাং হুযুর নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌভাগ্যপূর্ণ বেলাদতের উপর খুশি হওয়া ও আনন্দ প্রকাশ করা ঈমানের আলামত এবং স্বীয় পথপ্রদর্শক নবীয়ে মুকাররাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের আয়না বিশেষ।
ঈদ: ‘ঈদ’ মানে খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা। আর ‘মীলাদ’ অর্থ জন্মের সময় বা দিন। ‘নবী’ শব্দ দ্বারা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়। “ঈদে মীলাদুন্নবী’” বলতে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিলাদত শরীফ-এর দিন উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা, ছানা-ছিফত, ফাযায়িল-ফযীলত, শান-মান বর্ণনা করা, তাঁর প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা, তাঁর পূত-পবিত্রতম জীবনী মুবারকের সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনাকেই বুঝায়।
আল ক্বোরআনে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
=====================================
আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইতে রাসূল ও আউলিয়ায়ে কেরামের শুভ জন্ম দিন এবং ওফাত দিনকে কেন্দ্র করে মাহফিল করা, নানা পুণ্য ও কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে তাঁদের অবদানকে স্মরণ করা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও শরীয়ত সম্মত কাজ। কেননা এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তাঁদের জীবন, কর্ম ও অনুপম আদর্শ সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং নিজের জীবনেও তাঁদের আদর্শ বাস্তবায়নে আগ্রহী ও উৎসাহিত হয়ে উঠে।
আল্লাহতায়ালা স্বীয় হাবীবে মুকাররাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলাদতের যিকির মোবারক শপথসহকারে বর্ণনা করেছেন, ইরশাদ হয়েছে:
لا أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ { ১ } وَأَنْتَ حِلٌّ بِهَذَا الْبَلَدِ { ২ } وَوَالِدٍ وَمَا وَلَدَ { ৩ {
‘আমি এই শহরের (মক্কা) শপথ করছি, (হে হাবীব!) এ জন্য যে এই শহরে আপনি তশরীফ আনয়ন করেছেন। (হে হাবীব!) আপনার পিতার [আদম আলাইহিস সালাম অথবা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের] শপথ এবং (তাদের) শপথ, যারা জন্মগ্রহণ করেছে।’ (সূরা বালাদ: আয়াত ১-৩)।
মহান আল্লাহ পাক আলমে আরওয়াহতে সমস্ত নবী-রসূল (আলাইহিমুস সালাম)কে নিয়ে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করেছেন, তথা আগমন শরীফের মহান খুশির খোশ খবরী জানিয়ে দেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন ও খিদমত ফরয করে তার ওয়াদা নেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন-
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ ۚ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَىٰ ذَٰلِكُمْ إِصْرِي ۖ قَالُوا أَقْرَرْنَا ۚ قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ (آل عمران ৮১-৮২)
“(হে আমার হাবীব আপনি স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা) যখন আল্লাহ (আলমে আরওয়াহতে) নবীগনের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহন করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের নিকট কোন রসূল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্য প্রতিপাদনের জন্য, তখন সে রসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমারা কি অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তাঁরা বললেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি’। তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। অতঃপর যে লোক এই ওয়াদা থেকে ফিরে দাঁড়াবে, সেই হবে নাফরমান। (সূরা আলে ইমরান- ৮১, ৮২)
পবিত্র ক্বোরআনে প্রায় অর্ধশতাধিক বার নির্দেশ এসেছে আল্লাহর প্রিয় জনদের স্মরণ করার বিষয়ে, যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন- وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَّبِيًّا (مريم-৪১ (হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত ইবরাহীমকে)। [মারয়াম: ৪১]
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مُوسَى إِنَّهُ كَانَ مُخْلَصًا وَكَانَ رَسُولا نَّبِيًّا (مريم-৫১) (হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত মুসাকে)। [মারয়াম-৫১]
এ নির্দেশটি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার নবী-রাসূলদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং আউলিয়ায়ে কেরামের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন-وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا (مريم-১৬) (হে হাবীব আপনি কিতাবে হযরত মারয়ামকে স্মরণ করুন)। [মারয়াম:১৬]
এ আয়াতে হযরত মরিয়াম আলায়হিস্ সালামকে স্মরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একথা কারও অজানা নেই যে, হযরত মরিয়াম আলায়হিস্ সালাম নবী ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর একজন ওলী ছিলেন।
অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা ক্বোরআন করিমে তার প্রিয় নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন তাঁর উম্মতদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নেয়ামত অবতরণের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُم بِأَيَّامِ اللَّهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ(ابراهيم-০৫)
(হে হাবীব! আপনি আপনার উম্মতদেরকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে উপদেশ দিন। [ইবরাহীম-০৫]
এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলার দিনগুলোকে মানে ওই সব দিনকে বুঝায় যে দিনগুলোতে আল্লাহ্ তা’আলা তার বিশেষ কোন বান্দা বা বিশেষ কোন যাতকে কোন খাস বা বিশেষ নেয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন। আর এ দিনগুলো হলো শুভ জন্ম দিন, বিজয়ের দিন ইত্যাদি।
জন্মদিবস ও ওফাত দিবসকে আল্ ক্বোরআনের বিশেষ সম্মান:
———————————————————————
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয়জনদের শুভজন্ম এবং তাঁদের বেচাল বা ওফাত দিবসকে ক্বোরআনুল করিমে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন এবং এ দিনগুলোকে বিশেষ শান্তি ও সালামের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বরং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এ দিনগুলোতে বিশেষ সালাম প্রেরণ করা হয়েছে। হযরত ইয়াহ্য়া আলায়হিস্ সালাম এর শুভজন্ম ও বেচাল শরীফ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন: وَسَلامٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا (مريم-১৫) ‘‘এবং তাঁর প্রতি সালাম বা শান্তি যেদিন তিনি (হযরত ইয়াহ্য়া আলাহিস্ সালাম) জন্ম গ্রহণ করেছেন। যেদিন তিনি ওফাত পাবেন এবং যেদিন তিনি পুনর্জীবিত হবেন।[সূরা মারয়াম:১৫]
হযরত ইসা আলায়হিস্ সালামের ভাষায় আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হযরত ইসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর মাতৃক্রোড়ে এ ঘোষণা দিলেন যে, وَالسَّلامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا (مريم-৩৩)‘‘এবং আমার প্রতি সালাম ও শান্তি যেদিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, যেদিন আমি ওফাত পাবো এবং যেদিন আমি পুনর্জীবিত হবো। [মারয়াম:৩৩]
এ আয়াতদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হলো জন্ম ও ওফাতের দিনকে উপলক্ষ করে দুরূদ, সালাম, দোয়া, মুনাজাত ও নেয়ায-তাবাররুকাতের ব্যবস্থা করা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত বরকত ও ফযিলত মন্ডিত কাজ। যদি এতে শরিয়ত বিবর্জিত কোন কাজ সংঘটিত না হয়।
আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয়জনদের স্মরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা আরও এরশাদ করেন-
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ(يوسف-১১১)
(নিশ্চয় তাদের ঘটনাসমূহে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ)। [ইউসুফ:১১১]
وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنفَعُ الْمُؤْمِنِينَ (الذاريات-৫৫) (আপনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন, কেননা স্মরণের মধ্যে রয়েছে মুমিনগণের জন্য অনেক উপকার। [যারিয়াত:৫৫]
মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেন- وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ ۚ وَجَاءَكَ فِي هَٰذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ (هود-১২০) (আমি আপনার নিকট পূর্ববর্তী রাসূলগণের যা ঘটনা বর্ণনা করেছি তা আমি আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য। [হুদ: ১২০]
হাদীস শরীফে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
======================================
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালন করেন নিজের জন্ম দিন: যেহেতু শুভজন্ম দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নেয়ামত তাই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁর নিজ জন্মদিন বা মিলাদ উদযাপন করেছেন নফল রোযা পালনের মাধ্যমে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সোমবার রোযা রাখতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এরশাদ করেছিলেন:
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الأَنْصَارِيِّ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاثْنَيْنِ، فَقَالَ : ذَلِكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ، وَيَوْمٌ بُعِثْتُ، أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ “.
এটা ওইদিন যেদিন আমার শুভজন্ম হয়েছে বা মিলাদ হয়েছে, যে দিন আমার বে’সত হয়েছে অথবা যে দিন আমার প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয়েছে। [মুসলিম শরীফ] অর্থাৎ তিনি তাঁর শুভজন্মদিন উপলক্ষে আল্লাহ্ তা’আলার শুকরিয়া স্বরূপ এ নফল রোজা রাখতেন।
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামস্বয়ং নিজেই নিজের বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে ইরশাদ করেন-
عن أبي أمامة رضي الله عنه قال: قلت يا رسول الله! ما كان أول بدء أمرك؟ قال: دعوة أبي إبراهيم، وبشرى عيسى، ورأت أمي أنه يخرج منها نور أضاءت منه قصور الشام. (رواه أحمد (৫/২৬২) والطيالسي (১১৪০) والطبراني في الكبير(৮/১৭৫/৭৭২৯)، وذكره الهيثمي في المجمع (৮/২২২) وقال: رواه أحمد بإسناد حسن وله شواهد تقويه ورواه الطبراني.)
“আমি হলাম হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’র দোয়া, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’র সুসংবাদ এবং আমার আম্মাজান হযরত আমিনা আলাইহাস সালামের দেখা সুস্বপ্ন মুবারক ও অলৌকিক ঘটনার বাস্তব প্রতিফলন। আমার আম্মাজান আমার বিলাদত শরীফ-এর সময় দেখেছিলেন যে, এক বরকতময় ‘নূর’ যমীনে তাশরীফ নিলেন এবং সে নূর মুবারক-এর আলোর প্রভাবে শাম দেশের দালান-কোঠাগুলোকে আলোকিত করলো, তা তিনি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন।” (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত শরীফ)
এছাড়া সাইযয়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং নিজেও নিজের মীলাদ শরীফ তথা বিলাদত শরীফ সম্পর্কে খুশি প্রকাশ করে স্বীয় বংশ মযার্দার ছানা-ছিফত বর্ণনা করেন,
عن واثلة بن الاسقع رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم (ان الله اصطفى من ولد ابراهيم اسماعيل . واصطفى من ولد اسماعيل بنى كنانة . واصطفى من بنى كنانة قريشا . واصطفى من قريش بنى هاشم . واصطفانى من بنى هاشم (أخرجه مسلمٌ ( ২২৭৬ / ১) ، والبخاري في ( التاريخ الكبير ) ( ১/ ১/ ৪) ، والترمذي ( ৩৬০৫ ، ৩৬০৬) ، وأحمد (৪/ ১০৭) ، وابنُ أبي شيبة ( ১১ / ৪৭৮) ، وابن سعد في ( الطبقات ) (১/ ২০) ، والطبراني في ( الكبير ) ( ج২২/ رقم ১৬১ ) ، والبيهقي في ( السنن الكبير) (৭ / ১৩৪) ، وفي ( الدلائل) (১/ ১৬৫) ، والخطيب ( ১৩ / ৬৪) ، واللالكائي في ( شرح الأصول ) (১৪০০) ، والبغوي في ( شرح السنة ) ( ১৩ ، ১৯৪ ) من طريق الأوزاعي ، حدثني أبو عمار شداد ، عن واثلة بن الأسقع مرفوعًا به ، والله أعلم . قال الحافظ في التلخيص الحبير: مُسْلِمٌ وَالْبُخَارِيُّ فِي التَّارِيخِ وَالتِّرْمِذِيُّ مِنْ حَدِيثِ وَاثِلَةَ بْنِ الْأَسْقَعِ ، وَفِي رِوَايَةِ التِّرْمِذِيِّ وَهِيَ لِأَحْمَدَ : { إنَّ اللَّهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إبْرَاهِيمَ إسْمَاعِيلَ ، وَمِنْ وَلَدِ إسْمَاعِيلَ كِنَانَةَ } .الْحَدِيثَ – قُلْت : وَلَهُ طُرُقٌ جَمَعَهَا شَيْخُنَا الْعِرَاقِيُّ فِي كِتَابِ : ” مَحَجَّةُ الْقُرَبِ فِي مَحَبَّةِ الْعَرَبِ ” .)
“মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি আমাকে কুল-মাখলুকাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, মাখলুকাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম গোত্র কুরাঈশ খান্দানে এবং কুরাঈশ গোত্রের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হাশেমী শাখায় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ঘরে আমাকে প্রেরণ করেছেন।” (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ)
এ মুবারক ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের সুমহান সুন্নত আদায় করার যে পদ্ধতি বা নিয়ম বর্তমানে জারি রয়েছে তা পরবর্তিতে কারো মনগড়া তৈরিকৃত কোনো নিয়ম-পদ্ধতি নয়। বরং এ নিয়ম হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র যামানাতেই জারি ছিলো এবং ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে: “হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে,
عن ابى الدرداء رضى الله تعالى عنه انه مر مع النبى صلى الله عليه وسلم الى بيت عامر الانصارى وكان يعلم وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم لأبنائه وعشيرته ويقول “هذا اليوم” “هذا اليوم” فقال عليه الصلوة والسلام ان الله فتح لك ابواب الرحمة والملائكة كلهم يستغفرون لك من فعل فعلك نجى نجاتك
একদা তিনি রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে হযরত আমির আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে উনার সন্তানাদি এবং আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে নিয়ে আখিরী রসূলের বিলাদত শরীফ-এর ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছেন এবং বলছেন, এই দিবস; এই দিবস (অর্থাৎ এই দিবসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামযমীনে তাশরীফ এনেছেন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটেছে)। বিলাদত শরীফ-এর ঘটনাবলী শ্রবণ করে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তার রহমতের দরজা আপনার জন্য উন্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত ফেরেশতাগণ আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, আপনাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেলো। এবং যে কেউ আপনাদের মতো এরূপ কাজ করবে, সেও আপনাদের মতো নাজাত (ফযীলত) লাভ করবে।” (আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, -৩৫৫ পৃষ্ঠা)
নেয়ামত প্রাপ্তির দিনকে স্মরণ করা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের সুন্নাত:
—————————————————————————
রমযান মুবারকের রোযা ফরজ হবার পূর্বে আশুরা রোযা রাখা ফরজ ছিল। রমযানের রোযার হুকুম নাযিল হবার পর তা সুন্নাতে রূপান্তরিত হয়।
আশুরার রোজা কী ও কেন?
————————–
বুখারী-মুসলিমসহ অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন দেখতে পেলেন ইয়াহুদিরা মুহররম মাসের দশম তারিখে তথা আশুরার দিনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নফল রোযাসহ অনেক ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে প্রতি বৎসর উদযাপন করে আসছে। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا اَنَّ رَسُوْلُ اللهِ قَدِمَ الْمَدِيْنَةِ فَوَجَدَ الْيَهُوْدَ صِيَامًا- يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ- فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِيْنَ تَصُوْمُنَهُ- فَقَالُوْا هَذَا يَوْمُ عَظِيْمُ نَجِى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوْسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ- فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ : فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُم – فَصَامَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَمَرَ بِصِيَامِهِ- (أخرجه مسلم (১১৬২)، وأبو داود (২/৩২১) (ح২৪২৫)، والترمذي (২/১১৫) (ح৭৪৯) ، وابن ماجة (১/৫৫৩) (ح১৭৩৮) ، وأحمد (৫/৩০৮)، والبيهقي (৪/২৮৬ (
“এটি একটি মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এবং তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর ফেরআউন ও তার জাতিকে সমুদ্রে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ার্থে হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম রোজা রেখেছিলেন, তাই আমরাও এ দিনে রোজা রাখি। তখন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “আমরা তোমাদের চেয়ে হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর অধিক হকদার এবং অধিক নিকটবর্তী। (কেননা তারা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর প্রকৃত দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল), তাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ দিনে রোজা রেখেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [বুখারী ও মুসলিম]
এ হাদীসগুলো থেকে প্রমানিত হয় যে, বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্তির দিনগুলোকে স্মারণ করা সকল নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালামের সুন্নাত। আরও প্রমানিত হয় যে, বাৎসরিক একটি সুনির্দিষ্ট দিনকে উদযাপনের জন্য নির্ধারণ ও ধার্য্য করাও সুন্নাত, যা এ হাদীস দ্বারা প্রমানিত।