তিতাল্লিশতম অধ্যায়ঃ মক্কা বিজয়ঃ
প্রসঙ্গঃ [কোরআন ঘোষিত “মহাবিজয়” বাস্তবায়িত, নবী করীম [ﷺ]- এঁর অতুলনীয় ক্ষমা প্রদর্শন। কা’বার মূর্তিসমূহের পতন, বায়তুল্লাহর ছাদে হযরত বিলালের আযানের কেবলা কোন দিকে ছিল!]
===========
পবিত্র মক্কা বিজয় ৮ম হিজরীর রমযান মাসে সংগঠিত হয়। এই চূড়ান্ত বিজয়ের পটভূমিকা ধাপেধাপে সূচিত হয়েছিল। নবী করীম [ﷺ]-এঁর হিজরত ছিল প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ ছিল বদরের যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধে প্রথম সংঘর্ষেই কুরাইশদের পরাজয় ও মুসলমানদের বিজয়ে একটি বিশাল শক্তি হিসাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ওহোদ, খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধের ফলাফল কোরাইশদের বিরুদ্ধেই গিয়েছিল। সর্বশেষ হোদায়বিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষর করে কুরাইশরা দশ বৎসরের জন্য পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে থাকার দস্তখৎ লিখে দিয়ে আসলো। যদি সেসময় তারা বাধা না দিয়ে নবী করীম [ﷺ] ও মুসলমানদেরকে ওমরাহ পালন করার সুযোগ দিত, তা হলে পরাজয়মূলক সন্ধি করার দরকার হতো না।
সন্ধি করার কূটনৈতিক পরাজয় বুঝতে পেরে তারা তা ভঙ্গ করার চেষ্টা করলো। সন্ধিশর্ত ভঙ্গ করার ফলেই নবী করীম [ﷺ] মক্কা আক্রমণে করার সুযোগ পান এবং পরিকল্পনা তৈরী করেন। সুতরাং হিজরত থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ধাপেই কোরাইশরা নিজেদের পটভূমিকা নিজেরাই তৈরী করেছিল। অপরদিকে ধাপে ধাপে নবীজী বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা ছিল খোদায়ী গায়েবী মদদ।
যুদ্ধের কারণঃ
৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কোরা গামীমে নাযিলকৃত “মহান বিজয়ের” সুসংবাদবাহী আল্লাহর ভবিষ্যৎবানী (সূরা ফাত্হ-২) ৮ম হিজরীতে মক্কাবিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করলো। হোদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা ছিল এই যে, মক্কা সংলগ্ন বনু বকর গোত্র কোরাইশদের আশ্রয়ে থাকবে এবং মদিনা সংলগ্ন বনু খোজাআ গোত্র মুসলমানদের আশ্রয়ে থাকবে। এদের যে কোন গোত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকে মূল আশ্রয়দাতার বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে গন্য করা হবে। সন্ধির কিছুদিন পরেই কোরাইশরা মক্কা সংলগ্ন বনু বকরকে উস্কিয়ে দিয়ে মদিনা সংলগ্ন খোজাআর উপর আক্রমণ চালায়। বনু খোজাআ নবী করীম [ﷺ]- এঁর দরবারে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানায়। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে। কোরাইশ অধিপতি আবু সুফিয়ান পরিস্থিতির অবনতি উপলব্ধি করতে পেরে মদিনায় গমন করে। সে নতুন করে চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব করলে নবী করীম [ﷺ] তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।
[ঐ উদ্দেশ্যে মদিনায় এসে আবু সুফিয়ান নিজ কন্যা উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে হাবীবার (رضي الله عنه) ঘরে গিয়ে নবী করীম [ﷺ]- এঁর বিছানায় বসতেই হযরত উম্মে হাবীবা (رضي الله عنه) বলে উঠেন- “আল্লাহর দোস্ত যে বিছানায় আরাম করেন - সেখানে আল্লাহর দুশমন বসতে পারে না।” পিতাকে নবীর দুশমন বলা নবী প্রেমেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।]
একথা বলেই তিনি পিতাকে বিছানা থেকে তুলে দিলেন। এ ছিল সে যুগের নবীপ্রেমের নিদর্শন। বর্তমানে নবীজীর দুশমনদের সাথে বসতে সুন্নি মুসলমানরা লজ্জাবোধ করে না। এক শ্রেণীর মুসলমান নামদারীরা নবী করীম [ﷺ]-কে বড় ভাই বলে এবং আল্লাহর সম্মুখে তাঁর সম্মান মুচি চামারের মত বলে মন্তব্য করে। অথচ এদের নামের পিছনে “রহমাতুল্লাহি আলাইহে” শব্দ ব্যবহার করতেও একশ্রেণীর পীর মাশায়েখরা কুন্ঠিত হয়না। এসব পীরেরা ওহাবীদের সাথে আপোষ করে চলে। শেষ পর্যন্ত তারা বাতিল দলে মিশে যায়। নবীজীর দুশমনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা ঈমানেরই অংশ। (সূরা মুজাদালা-২৮ পারা)
অভিযানের প্রস্তুতিঃ
আবু সুফিয়ান উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মক্কায় ফিরে আসে। এদিকে নবী করীম [ﷺ] অতি গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। একজন বদরী সাহাবী হযরত হাতেব ইবনে আবু বোলতাআ (رضي الله عنه) মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি আঁচ করতে পেরে ‘মক্কায় অবস্থিত তাঁর সন্তানাদির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য মক্কায় অবস্থিত তাঁর এক বন্ধুর কাছে গোপনে একটি পত্র লেখেন এবং একজন গায়িকা মহিলার মাধ্যমে তা মক্কায় প্রেরণ করেন। গোপন ওহীর মাধ্যমে নবী করীম [ﷺ] এই সংবাদ পেয়ে হযরত আলী (رضي الله عنه), হযরত যোবাইর (رضي الله عنه) ও হযরত মিকদাদ (رضي الله عنه)- এই তিনজনকে উক্ত পত্র ছিনিয়ে আনতে পাঠালেন। হুযুর [ﷺ] ইলমে গায়েবের মাধ্যমে একথাও বলে দিলেন যে, উক্ত মহিলাকে তোমরা “রওযাখাক” নামক স্থানে গিয়ে পাবে।
তাঁরা ঘোড়া ছুটিয়ে উক্ত স্থানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন এবং ধমক দেয়ার পর সে চুলের খোপা থেকে উক্ত গোপন চিঠিটি বের করে দিল। সাহাবীত্রয় হুযুর [ﷺ]- এর গায়েবী ইলমের পরিচয় পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। হযরত হাতেব (رضي الله عنه) তাঁর এই অসর্তকতার জন্য নবী করীম [ﷺ]-এঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে দয়াল নবী তাঁকে ক্ষমা করে দেন। এ উপলক্ষে নবী করীম [ﷺ] বদরী সাহাবীগণ সর্ম্পকে আল্লাহ্ তায়ালার রেজামন্দিও সংবাদ দেন। একারণেই সকল বদরী সাহাবী (৩১৩ জন) জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত।
এছাড়াও হোদায়বিয়ার চৌদ্দশত সাহাবীও জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত। মূলতঃ সকল সাহাবীই জান্নাতি। হুযুর [ﷺ] এরশাদ করেছেন- “আমাকে দর্শনকারী কোন মুসলমাকেই জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না” (হাদীস)। তন্মধ্যে ১০ জন আশারা মোবাশশারা হিসাবে সবিশেষ পরিচিত। ঈমানের চোখে নবী দর্শনই জান্নাতের গ্যারান্টি। একজন সাহাবীর বিরুদ্ধে কটুক্তি মানে নবীজীকে কটুক্তি করা। আহলে সুন্নাতের মতে সাহাবীগণের সমালোচনা করা হারাম।
নবী করীম [ﷺ] ৮ম হিজরীতে গোপনে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে রমযানের ২ তারিখে মক্কার দিকে রওনা হন। আসলাম, গিফার, মোযায়না, জুহাইনা, আশজা, সোলায়ম সহ বিভিন্ন গোত্র ও আনসার মোহাজেরীন মিলিয়ে দশটি গোত্র নিয়ে মক্কার দিকে চললেন। পথিমধ্যে জোহফা নামক স্থানে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) ও তাঁর পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাত হলো। তাঁরা হিযরত করে মদিনা শরীফ আসছিলেন। তাঁরাও সাথে ফিরে চললেন। পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে- যেখানে হযরত আমেনা (رضي الله عنها)- এর মাযার শরীফ অবস্থিত- সেখানে হুযুর [ﷺ]- এর আর এক চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেছ এবং তাঁর পুত্র জাফর নবী করীম [ﷺ]- এর হাতে মুসলমান হয়ে সৈন্যদলে যোগ দিলেন।
মক্কার নিকটবর্তী এলাকা কোদায়দ নামক স্থানে পৌঁছে নবী করীম [ﷺ] সৈন্যদলকে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত করলেন এবং প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক পতাকা প্রদান করলেন। এটা ছিল নবী করীম [ﷺ]-এঁর যুদ্ধ পরিচালনার আসল কৌশল। স্মরণযোগ্য, এই কেদায়েদ নামক স্থানেই উম্মে মা’বাদের গৃহ। নবী করীম [ﷺ] হিজরতের সময় এখানে এসে প্রথম বিশ্রাম নেন এবং ছাগীর শুকনা বাঁটে দুধের নহর প্রবাহিত করেন।
ওদিকে আবু সুফিয়ানের মদিনা মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই মক্কার কোরাইশরা উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছিল। কিন্তু নবী করীম [ﷺ]- এঁর অভিযানের বিষয়ে তারা - বিন্দু বিসর্গও জানতে পারেনি। তাই তারা খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তাদের সর্দার আবু সুফিয়ান ইবনে হরবকে মদিনার দিকে এই বলে পাঠালো - যদি মুহাম্মদ [ﷺ] অভিযানে এসেই পড়েন - তবে সে যেন মক্কাবাসীদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আসে।
আবু সুফিয়ান হাকিম ও বোদাইল নামক দুজন সঙ্গী নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলো। “মাররুয যাহরান” নামক স্থানে এসে আবু সুফিয়ান ইসলামী লস্কর দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। পাহারাদার সাহাবীদের হাতে আবু সুফিয়ান ও সঙ্গীরা বন্দী হয়ে রাসূলের দরবারে নীত হয়। এ অবস্থায় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর পূর্বকৃত সব গুনাহ ও অপরাধ মাফ হয়ে যায়। শিয়ারা সাহাবী বিদ্বেষী। তাই তারা গোমরাহ ও বাতিল। বর্তমানে জামাআতে ইসলামীরাও সাহাবী বিদ্বেষী দল। শিয়ারা আবু সুফিয়ানের গোটা পরিবারকে গালাগাল করে থাকে- অথচ নবীজী তাঁকে সাহাবীর সম্মান দিয়েছেন। তাঁরা নবীজীরও দুশমন।
ইসলামী কাফেলা কোদায়দ থেকে পুনঃ রওনা দেয়ার সময় নবী করীম [ﷺ] তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-কে বললেন, “আপনি আবু সুফিয়ানকে পাহাড়ের টিলার উপরে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর শৌর্যবীর্য দেখিয়ে দিন।” নবী করীম [ﷺ] ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে দশ হাজার মশাল জ্বালিয়ে রওনা দিলেন। আবু সুফিয়ান সুসজ্জিত পৃথক পৃথক মুসলিম বাহিনী দেখছিল - আর শিউরে উঠছিল। নবী করীম [ﷺ] অতীতের সব ব্যথা ভুলে গিয়ে ঘোষনা করলেন - “যারা আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নেবে - তারা নিরাপদ, যারা আপন আপন ঘরে বিনা অস্ত্রে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করবে - তারাও নিরাপদ এবং যারা আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে - তারাও নিরাপদ।” এভাবে আবু সুফিয়ানকে সম্মানিত করা হলো।
মক্কার ছয়জন পুরুষ ও চারজন মহিলাকে এই ঘোষণার আওতা বহির্ভূত রাখা হলো। এই বলে নবী করীম [ﷺ] সৈন্য বাহিনীকে বিভিন্ন পথে মক্কায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিলেন। আক্রান্ত না হলে যেন আক্রমণ না করা - সে নির্দেশও দিলেন। আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মক্কাবাসীকে নিরাপত্তার ঘোষনা শুনিয়ে দিলেন। হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (رضي الله عنه)- এর বাহিনীকে বাধা দেয়ার ফলে সামান্য কিছু সংঘর্ষ হয়। এতে বনু বকর ও বনু হোযায়ল গোত্রের ২৩/২৪ জন লোক নিহত হয়। প্রায় বিনা বাধায় নবী করীম [ﷺ] মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কাবাসীগণ এখন হুযুরের হাতে বন্দী। মক্কা বিজয় সমাপ্ত হলো - তাদের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে।
এই সেই মক্কাভূমি - যেখানকার লোকেরা ষড়যন্ত্র করে ১৩টি বছর নবী করিম [ﷺ] ও মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন পরিচালনা করেছিল। শেষ পর্যন্ত নবী করিম [ﷺ] জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ। রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন [ﷺ] অতি বিনয় ও শুকরিয়ার সাথে মক্কায় প্রবেশ করেছেন আর জবানে পাকে উচ্চারণ করছেন, “জা- আল হক্ব ওয়া যাহাক্বাল বাতিল; ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুকা।” - সত্য আগত, অসত্য দূরীভূত; নিঃসন্দেহে অসত্য দূরীভূত হওয়ারই যোগ্য” (আল কোরআন)। এ ঘটনা ১৭ই রমযানের। আজ চিরদিনের জন্য মক্কাভূমি মূর্তি উপাসনা থেকে মুক্ত হলো। নবীজীর ইলমে গায়েবের ঘোষণা “কিয়ামত পর্যন্ত মক্কায় আর মূর্তিপূজা হবে না।”
পরদিন সকালে নবী করিম [ﷺ] মক্কাবাসীকে একত্রিত করে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন - “তোমরা আজ আমার নিকট কি ধরণের আচরণ আশা করো?” সকলে একবাক্যে বললো, “দয়ার আচরণ - নিকটাত্মীয়ের আচরণ।” রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন [ﷺ] ঘোষণা করলেন - “যাও, তোমরা সব মুক্ত। তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অভিযোগ নেই।”
ক্ষমার এই ঘোষণা শুনে উপস্থিত লোকেরা চিৎকার করে বলে উঠলো - লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহু- আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতুলনীয় ক্ষমার এই দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন বিজয়ী শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি। এভাবে মক্কার অধিকাংশ লোকই মুসলমান হয়ে গেলো। কিছু লোক তখনও মুশরিক থেকে গেলো। নবীজী জবরদস্তি কাউকে মুসলমান বানাননি - তারই প্রমাণ হলো এটি।
এদিকে নবী করিম [ﷺ]-এঁর এই অভূতপূর্ব ক্ষমা ঘোষণায় মদিনায় আনসার বাহিনী আশংকা করতে লাগলেন - হয়তো নবী করিম [ﷺ] আর মদিনায় ফেরত যাবেন না। জন্মভূমিতেই তিনি স্থায়ীভাবে থেকে যাবেন। তাঁদের মনের ভাব বুঝতে পেরে নবী করিম [ﷺ] ঘোষণা করলেন, “হে আনসারগণ! আমি জীবনেও তোমাদের সাথে - মরণেও তোমাদের সাথে থাকবো।” (বেদায়া)
কতিপয় ঘটনাঃ
(ক) মূর্তি নিধনঃ নবী করিম [ﷺ] খানায়ে কা’বার ভিতরে প্রবেশ করে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপিত দেখতে পেলেন। তিনি হাতের লাঠি দ্বারা একটি একটি করে মূর্তিকে টোকা দিতেই নিচের মূর্তিগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলো- অথচ এগুলো পেরাগ দিয়ে শক্ত করে দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছিল। এতদিন আল্লাহর ঘর মূর্তিভর্তি ছিল। আজ আল্লাহ তাঁর হাবীবকে দিয়ে তাঁর ঘর মূর্তিমুক্ত করে পবিত্র করলেন। এটাই ছিল আল্লাহর ইচ্ছা। প্রতিমা নিধন ছিল নবী করিম [ﷺ]-এঁর মিশন। কিন্তু আমরা তাঁর উম্মত হয়েও আজ শুরু করেছি স্থানে স্থানে প্রতিমা স্থাপন। আফসোস! উপরের মূর্তিগুলো ভাঙ্গারা জন্য হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে তাঁর কাঁধে তুলে নিলেন। এখানে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল - যাতে নবীজীর প্রকৃত ওজন হযরত আলী প্রত্যক্ষ করেছিরেন।
(খ) চাবি প্রদানঃ এতদিন পর্যন্ত খানায়ে কা’বার দরজার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল ওসমান ইবনে তালহা নামক জনৈক কোরাইশের উপর। সে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার দরজা খুলতো। নবী করিম [ﷺ] মক্কী জীবনে একদিন লোকদের সাথে খানায়ে কা’বার ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে ওসমান হুযুরকে বাধা দিয়েছিল। নবী করিম [ﷺ] ধৈর্য্য ধরে সেদিন মন্তব্য করেছিলেন- “হে ওসমান! আজ তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ, হয়তো এমন একদিন আসবে - যখন তোমার হাতের চাবিখানা আমার হাতে আসবে এবং আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দেবো।” সুবহানাল্লাহ!
তখন ওসমান বলেছিল, তা হলে কেবল কোরাইশদের ধ্বংস ও অপমানের মাধ্যমেই তা হতে পারে। নবী করিম [ﷺ] উত্তরে তখন বলেছিলেন - “না, বরং কোরাইশগণ সে সময় নতুন জীবন লাভ করবে এবং সম্মানিত হবে” (বেদারা নেহায়া)।
মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম [ﷺ] সেই ওসমানকে ডেকে এনে খানায়ে কা’বার চাবি হস্তান্তর করতে বললেন। ওসমান নীরবে ঘর থেকে চাবি এনে নবী করিম [ﷺ]- এর হাতে তুলে দিলেন। দয়াল নবীজী চাবিখানা ওসমানের হাতে ফেরত দিয়ে বলরেন - “নাও ! এ চাবি তোমার ও তোমার বংশের লোকদের হাতে চিরদিন থাকবে - যদি না কোন যালেম তা ছিনিয়ে নেয়।” ওসমান নবী করিম [ﷺ]- এর পূর্বের ভবিষ্যৎবানী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হতে দেখে অবাক হয়ে যায়। এটাও ছিল নবী করিম [ﷺ]- এর নবুয়তের প্রমাণবহ ইলমে গায়েব। ওয়াহাবী সম্প্রদায় তবুও হুযুরের ইলমে গায়েব আতায়ী অস্বীকার করেই চলছে।
(গ) হযরত বেলাল(رضي الله عنه)এর আযানের কেবলাঃ
নবী করিম [ﷺ] হযরত বেলাল (رضي الله عنه) কে খানায়ে কা’বার ছাদে উঠে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। হযরত বেলাল (رضي الله عنه) ছাদে উঠে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ্! [ﷺ] মদিনায় থাকতে কেবলামূখী হয়ে আযান দিতাম। এখন তো কা’বা আমার নীচে, কোন দিকে ফিরে এখন আযান দেবো? নবী করিম [ﷺ] নিজের দিকে ইশারা করে বললেন- “আমার দিকে।” মোহাদ্দেসীনে কেরাম এই হাদীসের তাৎপর্য এভাবে বর্ণনা করেছেন: “কেবলার অবর্তমানে নবী করিম [ﷺ]-এঁর পবিত্র সত্ত্বাই কেবলা। কেননা, তিনি কা’বারও কা’বা।” (যিকরে জামীল)
উর্দূ কবি বলেন:
روۓ همارا سوۓكعبه روۓ كعبه سوۓ محمد
كعبه كا كعبه روۓمحمد صلى الله عليه وسلم
“মোদের কপাল কা’বার দিকে, কা’বা ঝুঁকে নবীর পানে,
কা’বার কা’বা প্রিয় মোহাম্মদ, শত দরূদ তাঁরই শানে।” -লেখক
বিঃদ্রঃ ইবনু আবি মোলায়কার বর্ণনায় কা’বার ছাদে শুধু আযান দেয়ার কথা উল্লেখ আছে (বেদায়া ৪র্থ, ২৯৪ পৃষ্ঠা)।
(ঘ) ফোযালার মনের গোপণ কথাঃ
একবার নবী করিম [ﷺ] কা’বা শরীফ তাওয়াফ করছিলেন। ফোযালা ইবনে ওমাইর নামীয় জনৈক কোরাইশ নবী করিম [ﷺ]-কে একা একা পেয়ে তাঁকে শহীদ করার বদনিয়তে সে ও তাওয়াফ করতে লাগলো এবং সুযোগ খুঁজতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে নবী করিম [ﷺ]-এঁর অতি নিকটে এসে পড়লো। নবী করিম [ﷺ] তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ফোযালা? সে জবাব দিল, হ্যাঁ। নবী করিম [ﷺ] পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি মনে মনে কি ভাবছ? সে থতমত খেয়ে বললো, কই না তো! কিছুই ভাবছি না, বরং আমি মনে মনে আল্লাহর যিকির করছি। তার একথা শুনে নবী করিম [ﷺ] রহস্যের হাসি হাসলেন এবং শুধু এতটুকুন বললেন “আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।” একথা বলেই নবী করিম [ﷺ] তার বুকে পবিত্র হাত স্থাপন করলেন। সাথে সাথে ফোযালার মনের কুচিন্তা দুর হয়ে গেল। ফোযালা বলেনঃ “ নবী করিম [ﷺ] আমার বুক থেকে হাত উঠিয়ে নেয়ার পর বর্তমানে আমার মনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে আমার নিকট নবী করিম [ﷺ]-এঁর চেয়ে বেশী প্রিয় আর কেহই নেই।” (মাওয়াহিব) একেই বলে ফয়যে ইনয়েকাছি।
(ঙ) হযরত কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه) এর ইসলাম গ্রহণ এবং নবীজী [ﷺ]-এঁর শানে একটি প্রশংসামূলক কবিতা পাঠ, বিনিময়ে চাঁদর মোবারক দানঃ
মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম [ﷺ] ৮ম হিজরীর শাওয়াল ও যিলক্বদ মাসে হুনায়ন ও তায়েফ জয় করে ২ মাস ১৬ দিন পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ৯ম হিজরীর রজব মাসে তিনি তাবুক অভিযানে বের হন। নবীজী [ﷺ]-এঁর তাবুক অভিযানে যাওয়ার পূর্বে মক্কার কবি কা’ব ইবনে যোহাইর মদিনায় এসে মুসলমান হয়ে যান। প্রথমে তিনি নবীজী [ﷺ]-এঁর বিরুদ্ধে অনেক ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। কিভাবে তিনি মুসলমান হলেন, তার একটি চমকপ্রদ ঘটনা আছে। এখানে সংক্ষেপে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করা হলো।
কা’ব এবং বুজাইর তাঁরা ছিলেন দু’ভাই। তাদের পিতার নাম যোহাইর। মক্কার বাসিন্দা তাঁরা। পিতা যোহাইর আহলে কিতাব পন্ডিতদের মজলিশে উঠাবসা করতো। সে পন্ডিতদের মুখে শুনেছিল “শেষ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে।” ইতিমধ্যে সে স্বপ্নে দেখলো, আকাশ থেকে একটি রশি নিচের দিকে নেমে আসছে। সে ঐ রশিটি ধরতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। যোহাইর তার দুই ছেলে কা’ব ও বুজাইরকে ডেকে বললো “শেষ যামানার নবীর আবির্ভাবের সময় আমি পাব না, যা স্বপ্নে দেখেছি, কিন্তু তোমরা তাঁকে পেলে অবশ্যই ঈমান আনবে।”
ইত্যবসরে কা’ব উঁচু স্তরের কবি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মক্কার অন্যান্য কবিদের ন্যায় তিনিও প্রথম দিকে নবী করিম [ﷺ]-এঁর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। নবী করীম [ﷺ] মক্কা জয় করার সময় ঘোষণা করেছিলেন, “মক্কাবাসী সকলে মাফ পাবে কিন্তু যেসব কবি আমার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছে, তাদেরকে কতল করা হবে।”
মক্কা বিজয়ের পর ইকরামা, কা’ব প্রমুখ কবিগণ গা ঢাকা দেয়। কা’ব এর ভাই বুজাইর মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ভাই কা’বকে পত্র লিখে অভয় দেন যে, কেউ মুসলমান হয়ে গেলে সে ঘোর শত্রু হলেও নবী করিম [ﷺ] তাকে ক্ষমা করে দেন। সুতরাং তুমি এসে মুসলমান হয়ে যাও।
ভাই বুজাইর এর পত্র পেয়ে কা’ব একটি দীর্ঘ ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করে ভাইকে গালাগাল করে পত্র প্রেরণ করলো। বুজাইর (رضي الله عنه) ভাই কা’ব এর পত্র পেয়ে নবী করিম [ﷺ]-কে শুনান। নবী করিম [ﷺ] পত্র শুনে এরশাদ করেন, “যে কেউ কা’বকে পাবে, সে যেন কা’বকে কতল করে ফেলে।”
এই ঘোষণা শুনে কা’ব ভীতসমন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। পৃথিবী তার কাছে সঙ্কুচিত বলে মনে হলো। তিনি গোপনে মদিনায় এসে নবী করিম [ﷺ]-এঁর হাতে হাত রেখে বললেন “কা’ব ইবনে যোহাইর যদি খালেছ দিলে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে আপনি কি তাকে ক্ষমা করবেন? যদি ক্ষমা করেন তাহলে আমি তাকে আপনার খেদমতে হাযির করে দেবো।” নবী করিম [ﷺ] বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি আত্মপরিচয় দিয়ে সাথে সাথে কলেমা শরীফ পাঠ করে মুসলমান হয়ে যান।
কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه) তাৎক্ষনিকভাবে নবী করিম [ﷺ]-এঁর শানে একটি কবিতা রচনা করে তা পাঠ করে নবীজীকে শুনান। দীর্ঘ কবিতাটির শুরু ছিল “বানাত সোয়াদো।” কবিতার শেষাংশে তিনি নবীজীর শানে বললেনঃ
اِنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ- مَهَنَدُ مِّنْ سُيُوَّفِ اللهِ مَسْلُوْلَ-
অর্থ- “নিশ্চয় আল্লাহর রাসুল [ﷺ] আপনাদমস্তক এমন একটি নুর, যার মাধ্যমে সবকিছু আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহর তীক্ষ্ম তরবারী সমূহের মধ্যে বিশ্বখ্যাত একটি হিন্দুস্তানী তরবারী।”
হযরত কা’ব (رضي الله عنه) এর উক্ত পংক্তিটি শুনে নবী করিম [ﷺ] ভাবাবেগে এত আপ্লুত হয়ে উঠেন যে, তিনি তাঁর গায়ের মূল্যবান ইয়ামানী চাঁদরখানা কা’বের গায়ে জড়িয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে এই পবিত্র চাঁদরখানা কিনে নেয়ার জন্য হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) দশ হাজার মুদ্রা দিতে চাইলেন। হযরত কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه) বললেন, নবী করিম [ﷺ]-এঁর চাঁদরখানা অন্য কাউকে দেয়ার মত বদান্যতা আমি দেখাবোনা। হযরত কা’ব (رضي الله عنه) এর ইন্তিকালের পর হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) বিশ হাজার মুদ্রার বিনিময়ে ঐ চাঁদর মোবারক তাঁর উত্তরাধিকারীগণের নিকট থেকে সংগ্রহ করে নেন এবং নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখেন। ঐ পবিত্র চাঁদরখানা বংশ পরম্পরায় বাদশাহগণের হেফাযতে সংরক্ষিত হতে হতে অবশেষে তুর্কী খলিফাগণের হেফাযতে আসে এবং অদ্যাবধি উক্ত চাঁদরখানার তুরস্কে সরকারী হেফাযতে রয়েছে।
এখানে দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: (১) নবী করিম [ﷺ]-এঁর উপস্থিতিতে কা’ব তাঁকে “আপাদমস্তক নুর” বলে সম্বোধন করেছেন। এতে খুশী হয়ে নবী করিম [ﷺ] কা’বকে পুরস্কৃত করেছেন। এমনিভাবে যাঁরা নবী করিম [ﷺ]-কে “আপাদমস্তক নুর” বলে বিশ্বাস করবে, তারাও নবী করিম [ﷺ]-এঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে থাকবে। আর যারা মাটির মানুষ বলবে তারা নবীজীর অসন্তোষে পেতে থাকবে।
(২) আল্লাহর প্রিয় রাসুলে [ﷺ]-এঁর শানে উত্তম না’ত পেশ করা হলে তাঁকে সম্মানিত করা নবীজিরই সুন্নাত। এজন্যই মোশাআরা প্রতিযোগিতায় উত্তম কবিতা ‘না’তিয়া কালাম’ পাঠকারীকে উপহার দিয়ে সম্মানিত করার রেওয়ায এখনো প্রচলিত রয়েছে।