একজন রাবি (সাধারন) দ্বঈফ হওয়াতে হাদিস বাতিল হওয়া শর্ত নয় 

🖋গ্রন্থনায়ঃ মুফতি মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর

(প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানাের স্বরূপ উন্মােচন)


হাদিস শাস্ত্রে একজন রাবী সাধারন দ্বঈফ হলে বর্তমান আহলে হাদিসগণ ফিতনা ছড়াচ্ছে যে, সে হাদিসটির সনদ নাকি অত্যন্ত দুর্বল বলে বিবেচিত হবে, তারা কোন ক্ষেত্রে জাল বা বানােয়াট বলে বেড়িয়ে সমাজে ফিতনা ছড়াচ্ছে। তবে এটির ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিসগণ একমত রাবির দুর্বলতা যদি কঠিন পর্যায়ের হয় যেমন তার ব্যাপারে কোন মুহাদ্দিস যদি মুনকারুল হাদিস, মাতরুকুল হাদিস ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার থাকলে) তাহলে সনদটি দুর্বল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই রাবীর সামান্ন দুর্বলতায় হাদিসের সনদ জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হবে না। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু লিখার জন্য প্রয়ােজন মনে করলাম এবং কিছু মুহাদ্দিসের সনদ তাহকীক উদাহরণ স্বরূপ পেশ করলাম। আল্লামা ইবনে হাযার হাইসামী (رحمة الله) এক হাদীসের বর্ণনা করতে গিয়ে একজন রাবী দ্বঈফ হওয়ার কথা এভাবে বর্ণনা করেন, 


“ উক্ত হাদিসে ইবনে লাহিয়া বিদ্যমান। তিনি দুর্বল বর্ণনাকারী, তারপরও হাদিসটি হাসান।" তার বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল একজন রাবী দ্বঈফ হওয়ার কারণেও হাদিসটি নিঃসন্দেহে হাসান লিগাইরিহী। শুধু তাই নয় নাসিরুদ্দীন আলবানীও উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে বলেছেন, ইবনে লাহিয়াহ দূর্বল রাবী তারপরও বলেন, অত:পর হাদিসটি হাসান " বলে বিবেচিত হবে। হযরত যাবের (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসুল (ﷺ) সবাইকে একথাটি জানানাের জন্য বলেছিলেন, “ মুমিন ব্যতিত কেউ জান্নাতে যাবে না। 


তথ্যসূত্র-

●আল্লামা ইবনে হাজর হাসসামী : মাযমাউস যাওয়াইদ : ৮ / ১০২ এবং ১০ / ১৭০ পৃ। 

●নাসিরুদ্দীন আলবানী : সিলসিলাত আহাদিসুস সহীহাহ : ৩ / ১৩৬ পৃ . হাদিসঃ১১৪৪ 


এ হাদিসটি হাইসামী সংকলন করে বলেন, 

হাদিসটি ইমাম আহমাদ বর্ননা করেছেন, আর সনদে ইবনে লাহিয়াহ ' বিদ্যমান তারপরেও হাদিসটি 'হাসান' ” এ ইবনে লাহিয়াহ রাবির হাদিসকে ইবন হাযার তার এ গ্রন্থের মােট ২৪টি স্থানে অনুরুপ বলেছেন। 


শুধু তাই নয় ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (رحمة الله) এর সুনানে তিরমিযীর ৫ম খতে কিতাবুল আদাব অধ্যায়ে হযরত যাবের (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে - 

“ আগে সালাম তারপর কথাবার্তা।" 


●আল্লামা ইবনে হাজর হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ, ১৫৩, হাদিস : ১৬২, ইসলাম ও ঈমান অধ্যায়। 

●আল্লামা ইবনে হাজর হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ, ৪ / ১৯৬, হাদিস, ৭০০৯, ৫ / ১১৫ হাদিস, ৮৪৬৯, ৪ / ২০পৃ . হাদিস, ৫৯৫৪, ৫ / ২৪৩পৃ . হাদিস, ৯২৪২, ৫ / ২৫৯পৃ . হাদিস, ৯৩২৯, ৫ / ৩২৫ হাদিস, ৯৬৬৪, ৫ / ৩৪০পৃ . হাদিস, ৯৭৪৯, ৬ / ৭পৃ . হাদিস, ৯৭৭৮, ৬ / ৪২, হাদিস, ৯৮৭৬, ৬ / ৫১, হাদিস, ১৮৯৯, ৬৭১, হাদিস, ৯৯৪৭, ৬ / ৭২পৃ . হাদিস, ১৯৪৮, ৬ / ১৫৪পু, হাদিস, ১০২০৯, ৬ / ১৫৫, হাদিস, ১০২১১, ৬ / ১৯০, হাদিস, ১০৩০৩, ৬২১২পৃ . হাদিস, ১০৩৬৭, ৬ / ২৩১পৃ . হাদিস, ১০৪২১, ৭ / ৭৭পৃ . হাদিস, ১১১৯৭, ৭৮৮পৃ . হাদিস, ১১২৫১, ৭ / ১০০, হাদিস, ১১৩১৩, ৭১১৭ হাদিস, ১১৩৮৬, ৭ / ৩০০, হাদিস, ১২৩২৪, ৮ / ১০২পৃ . হাদিস, ১৩১৯২, ৪ / ১৯৬;৭০০৯।

●আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি : জামেউস সগীর : ২ / ৩৬১ হাদিস : ৪৮৪২


উক্ত হাদিসটি ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করে বলেন উক্ত হাদীসের দুজন রাবী রয়েছেন আম্বাসা ইবনে আব্দুর রহমান দুর্বল এবং মুহাম্মদ ইবনে যাযান মুনকার (পরিত্যক্ত) বর্ণনাকারী। দুইজন রাবী দোষী হওয়ার পরেও হাদীসের ইমামগণ উক্ত হাদিসটি সনদের ব্যাপারে দ্বঈফ বলেছেন।  বুঝা গেল, একজন রাবী মুনকার এবং দুর্বল রাবী হওয়ার পরও উক্ত হাদিসকে শুধু দুর্বল বলেছেন, জাল নয়। 

●আল্লামা ইবনে হাজর হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ।


আল্লামা ইবনে হাযার হাইসামী (رحمة الله) এক হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন, 

“ উক্ত হাদিসটি ইমাম তাবরানী তার মু ' জামুল কবীর ও আওসাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, উক্ত হাদীসে ইবনে লাহিআহ দুর্বল রাবী হলেও হাদিসটি হাসান অর্থাৎ গ্রহণযােগ্য। 


শুধু তাই নয়, আল্লামা ইমাম ইবনে যওজী (رحمة الله) তার গ্রন্থে একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন- 

"ইমাম ইবনে যওজী (رحمة الله) বলেন, উক্ত হাদিসটি সহিহ লিগাইরিহী ' (সহিহ লি জাতিহী নয় তার কারণ) উক্ত হাদীসে একজন দুর্বল রাবী ইবনে লাহিআহ রয়েছে।" ' যেমন প্রসিদ্ধ একটি হাদিস রয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান : “ আল্লাহ কবর জিয়ারতকারীনী মহিলাদের উপর অভিসম্পাত করেন।" উক্ত হাদিসটি ইমাম তিরমিযী, নাসায়ী, হাকিম, ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসের একজন রাবী আবু ছালেহ বাযাম তার সম্পর্কে ইমাম ইবনে মাহদী (رحمة الله) বলেন, তার হাদিস পরিত্যাগযােগ্য। ইমাম আবু আহমদ (رحمة الله) ও ইমাম নাসায়ী বলেন, তিনি শক্তিশালী রাবী নয়, অনুরূপভাবে ইমাম যাহাবী ও বলেছেন। অথচ ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। আল্লামা হাইসামী (رحمة الله) একটি হাদিসের সনদ সম্পর্কে বলেন, “ উক্ত হাদিসটি ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন, উক্ত হাদিসের সমস্ত রাবী বিশ্বস্ত শুধু “ ইবনে লাহিআহ ” ব্যতীত, কেননা তিনি দুর্বল রাবি। তাই উক্ত হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।" দেখুন ইবনে লাহিআহ (رحمة الله) হলেন একজন দুর্বল রাবী। তারপরও হাদিসটি দুর্বল বলেন নি। তিনি অন্যস্থানে উক্ত দুর্বল রাবী সম্পর্কে লিখেন, “ উক্ত হাদিসটি ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, উক্ত হাদিসের সমস্ত রাবী সহিহ বা বিশুদ্ধ শুধুমাত্র ইবনে লাহিআহ ছাড়া। তবে তার হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।" 


তথ্যসূত্র-

●আল্লামা ইমাম ইবনে জওজী : জামিউল মাসানিদ : ২১৩৩, হাদিস : ১১২৩। 

●আল্লামা ইমাম যাহাৰী : মিনুল ইতিদাল : ৪ / ৫৩৮ : রাবী নং : ১০৩০২। 

●ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউদ - যাওয়াহিদ : ৬ / ২৯৫ পৃ.হাদিস : ১০৭৬১। 

●ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউদ - যাওয়াইদ : ৪ / ৩৩৬ পৃ। 


তিনি অন্যস্থানে উক্ত রাবী সম্পর্কে বলেন, “ উক্ত হাদিসটি ইমাম তাবরানী সংকলন করেছেন, উক্ত সনদে ইবনে লাহি'আহ  বিদ্যমান, তারপরও তার কারণে হাদিসটি হাসান ”। আর বাকী রাবীগুলাে সহিহ বা বিশুদ্ধ। শুধু তাই নয়, তিনি অন্যত্র হুবহু বলেন, “ উক্ত হাদিসটি ইমাম বাযার (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, উক্ত সনদে ইবনে লাহি'আহ রয়েছে, তারপরও তার সনদটি “ হাসান ”, আর বাকী সকল রাবী বিশুদ্ধ।" 


আল্লামা হাইসামী অন্যস্থানে অন্য রাবী সম্পর্কে লিখেন, "হাদিসটি ইমাম আবু ই'য়ালা (رحمة الله) ও ইমাম তাবরানী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, উক্ত সনদে সমালােচিত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর বিন আলকামা ” রয়েছেন, তারপরও হাদিসটি হাসান ”। আর বাকী সমস্ত রাবী সিকাহ বা বিশ্বস্ত।"ইমাম হাইসামী এ রাবির ব্যাপারে অনুরুপ তার এ গ্রন্থের ১৮ স্থানে বলেছেন। 


তিনি অন্যস্থানে অন্য এক রাবী সম্পর্কে লিখেন, 

“ উক্ত হাদিসটি ইমাম আহমদ সংকলন করেছেন, উক্ত সনদে “ আলী বিন যিয়াদ রয়েছেন, আর তিনি দুর্বল, তারপরও হাদিসটি “ হাসান ”।


তথ্যসূত্র-

●ইবন হাযার হায়সামী: মাযমাউদ - যাওয়াইদ : ৪ / ৩৩৫ পৃ.

●ইবনে হাজার হারসামী : মাযমাউদ - যাওয়াইদ : ৪ / ৩২৯ পৃ .। 

●ইবনে হাজার হাজসামী : মাযমাউদ - যাওয়াইদ : ৭/১৪২ পৃ. ১১৫১৭। 

●ইবন হাযার হায়সামী : মাযমাউদ-যাওয়াইদ : ৪/৩২২.


"আল্লামা ইবনে হাযার হাইসামী এক হাদিস প্রসঙ্গে বলেন,

হাদিসটি তাবরানী বর্ণনা করেছেন, হাদিসের সমস্ত রাবি বিশ্বস্ত, তবে ইবনে লাহিয়াহ ব্যতিত, তারপরও হাদিসটি হাসান।"

(মাযমাউদ যাওয়াইদ : ১০ / ১৫৯পৃ. হাদিস, ১৭২৭২) 


তিনি অনুরুপ নিম্নের আরেকটি হাদিস প্রসঙ্গে বলেন, 

“ হাদিসের সমস্ত রাবি বিশ্বস্ত, শুধু ইবনে লাহিআহ ব্যতিত। তারপরেও হাদিসটি হাসান।" (মাযমাউদ যাওয়াইদ, ১০ / ১৭০পৃ . হাদিস : ১৭৩৪৭) 


শুধু তাই নয় প্রসিদ্ধ একটি হাদিস হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, “ রাসূল(ﷺ) ইরশাদ করেন : কিয়ামতের ময়দানে আমার সবচেয়ে নিকটে থাকবে সেই ব্যক্তি যে আমার প্রতি অধিক দুরূদ শরীফ পাঠ করবে।" 


উক্ত হাদীসে পাকটি ইমাম তিরমিযী ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসে একজন রাবী মুসাবিনা ইয়াকুব জামাঈ আল মাদানী সম্পর্কে, ইমাম নাসায়ী (رحمة الله) বলেন, উক্ত রাবী সে মজবুত বা শক্তিশালী রাবী নয়। 

তারপরও ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) উক্ত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, তাই প্রমাণিত হলাে একজন রাবী সাধারণত দুর্বল হলে হাদিস হাসান বা গ্রহণযােগ্য। সুতরাং তার বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল একজন রাবি দ্বঈফ হওয়াতে হাদিসের সনটি দ্বঈফ হওয়া শর্ত নয় তবে রাবির ব্যাপারে যদি মুহাদ্দিসগণ বেশী দুর্বলতার শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করে যেমন মুনকার, বাতিল, মাতরুক হলে নিশ্চয় দ্বঈফ হবে। 


তথ্যসূত্র-  

●ইমাম তিরমিযী : আস সুনান ১২৪১ : হাদিস ৪৮৪। 

●ইমাম যাহাবী : মিনুল ইতিদাল : ৪/২০৯ : ৯৪৪০। 

●আল্লামা ইমাম আযানী : কাশফুল খাফা : ১/২৩৯: হাদিস: ৮৩৫। 

Top