ইমাম গাযযালী (রহ:) তাঁর ‘এহইয়ায়ে উলূম আল-দ্বীন’
গ্রন্থে লিখেছেন, “মধ্য-শা’বান (মাস)-এর রাতে (অর্থাৎ,
শবে বরাতে) ১০০ রাকআত (নফল) নামায পড়বে,
যা’তে প্রতি রাকআতে সূরা ফাতেহার পর ১০ বার সূরা এখলাস
থাকবে; তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফবৃন্দ) এটি তরক (ত্যাগ)
করেন নি, যেমনিভাবে আমরা সম্পৃক্ত হয়েছি অতিরিক্ত নফল
নামায ও আ’রাফাত রজনীর সাথে।”
শায়খ ইসমাঈল হাক্কী তাঁর কৃত ’তাফসীরে রুহুল বয়ান’-এ
বলেন, “তাফসীরকার উলামাদের কয়েকজন বলেন
যে কুরআন মজীদে সুরা দুখান-এর ৩ নং আয়াতে উল্লেখিত
‘লাইলাতুল মুবারক’ তথা ’বরকতময় রজনী’ বলতে মধ্য-
শা’বানের রাতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে; আর এই রাতের
৪টি নাম: প্রথমটি ‘বরকতময় রজনী’, যেহেতু অসংখ্য মানুষ এই
রাতে নেক আমল পালন করেন; আর বাস্তবিকই
এতে আল্লাহতা’লার সৌন্দর্যের নেয়ামত আরশ-
কুরসি থেকে দুনিয়াপৃষ্ঠ পর্যন্ত বিরাজমান প্রতিটি অণুকণার
কাছে পৌঁছে থাকে, যেমনিভাবে তা ঘটে ’লাইলাতুল কদর’
রজনীতে, যা’তে ফেরেশতাকুল মহান আল্লাহতা’লার
দরবারে হাজির হন।”
সুরা দুখানের ৩-৪ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়
আমি (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয়
আমি সতর্ককারী। তাতে (ওই রাতে) বণ্টন করে দেয়া হয়
প্রতিটি হেকমতময় কাজ।” এই আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাথমিক
জমানার তাফসীরবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:)-সহ বেশির ভাগ
উলামা বলেছেন ওই রাত ‘শবে কদরের’; পক্ষান্তরে, হযরত
একরিমাহ (রা:) ও তাঁর সাথে একমত পোষণকারী উলামাবৃন্দ
বলেছেন যে সেটা ’শবে বরাত’।
উপরোক্ত আয়াতটি (৪৪:৩-৪) প্রসঙ্গে মাহমূদ আলুসী নিজ
তাফসীরগ্রন্থে বলেন যে সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস
(রা:), কাতাদাহ (রা:), ইবনে জুবাইর (রা:), মুজাহিদ (রা:), ইবনে যায়দ
(রা:) ও আল-হাসান (রা:)-এর মতানুযায়ী উল্লেখিত রাত
হলো শবে কদর। আর এটি-ই অধিকাংশ মোফাসসেরীন
তথা তাফসীরকার উলেমার অভিমত। পক্ষান্তরে, হযরত
একরিমাহ (রা:) ও তাঁর দল বলেন, “এটি মধ্য শা’বানের রাত।”
আন্ নিসাপুরী তাঁর প্রণীত তাফসীরগ্রন্থে এই পবিত্র
আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, “বেশির ভাগ তাফসীরকার এই
রাতকে লাইলাতুল কদর বলে চিহ্নিত করেছেন; কেননা, মহান
আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, ‘নিশ্চয় আমি তা (কুরআন) ক্বদরের
রাতে অবতীর্ণ করেছি’ (৯৭:০১)। আর অধিকাংশ উলামার
মতে কদরের রাত রমযান মাসে।”
আমরা আত্ তাবারীর বক্তব্যের অংশ বিশেষও এখানে উদ্ধৃত
করবো; তিনি বলেন, “হযরত একরিমাহ (রা:)-এর
মতো (প্রাথমিক যুগের) কতিপয় মুফাসসির দাবি করেন যে এই
আয়াতে মধ্য শা’বানের রাতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।”
হযরত আনাস (রা:)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (দ:)
এরশাদ ফরমান যে ৪টি রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ
করেন এবং নেয়ামত দেন। এগুলো হলো –
শবে কদরের রাত ও এর পরে আগত সকাল; আ’রাফাতের রাত
ও তৎপরবর্তী সকাল; শবে বরাত ও তৎপরবর্তী সকাল
এবং প্রতি জুমু’আর রাত ও তৎপরবর্তী সকাল।
[দায়লামী শরীফ]
হযরত আয়েশা (রা:)-কে রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন,
৪টি রাতে আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ ও দয়া বান্দাদের
জন্যে অবারিত হয়: ১/ ঈদুল আযহার (আগের দিনগত) রাত; ২/
ঈদুল ফিতরের রাত; ৩/ মধ্য-শা’বানের রাত (শবে বরাত),
যা’তে আল্লাহ বান্দার হায়াত নির্ধারণ করেন এবং রিযিকও বন্টন
করেন; আর কারা কারা হজ্জ্ব করবেন, তাও নির্ধারিত হয়। ৪/
আ’রাফাত রজনী – আযান হওয়া অবধি।
আল-কুরআনে বর্ণিত “ওই রাতে বণ্টন করে দেয়া হয়
প্রতিটি হেকমতময় কাজ” (৪৪:৪) আয়াতটি প্রসঙ্গে হযরত
একরিমাহ (রা:) বলেন, “এটি মধ্য-শা’বানের রাত, যখন আল্লাহ পাক
(আগামী) সারা বছরের বিষয়গুলো (নিয়মবদ্ধভাবে) সাজান।
তিনি জীবিতদের কাউকে কাউকে মৃতদের তালিকাভুক্ত
করেন, আর যারা আল্লাহর ঘরে হজ্জ্ব করতে যাবেন,
তাদের নামও লিপিবদ্ধ করেন; এতে তিনি বেশি মানুষের নাম
যেমন অন্তর্ভুক্ত করেন না, তেমনি তিনি কাউকে বাদও দেন
না।”
হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন হযরত
রাসূলে করীম (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ ফরমান: “মানুষের
হায়াত এক শা’বান থেকে আরেক শা’বান মাসে কর্তন করা হয়,
যার দরুন কেউ হয়তো বিয়ে-শাদী করে সন্তানের জনকও
হতে পারে, অথচ তার নাম জীবিতদের তালিকা থেকে বাদ
দিয়ে ভাগ্যে মৃত্যু লেখা হয়ে গিয়েছে।”
হযরত আতা ইবনে এয়াসার (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:) শা’বান
মাসে যেভাবে (নফল) রোযা রাখতেন, অন্য
কোনো মাসে সেভাবে রাখতেন না। আর এটি এ
কারণে যে, ওই বছর যারা মৃত্যুবরণ করবেন, তা তাতে লিপিবদ্ধ
হতো।”
হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) অন্য
কোনো মাসে এতো অধিক (নফল) রোযা রাখতেন
না যেমনটি রাখতেন শা’বান মাসে; কারণ এতে জীবিত
যারা মারা যাবেন তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়, যে পর্যন্ত
না কেউ বিয়ে করেন অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ
হয়ে গিয়েছে; আর কেউ হজ্জ্ব করেন, কিন্তু তার নাম
মৃতদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।”
সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (ক:) থেকে বর্ণিত
যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “মধ্য-শা’বানের রাত
তোমরা এবাদত-বন্দেগী করে অতিবাহিত করো এবং ওই দিন
রোযা রেখো। কেননা, নিশ্চয় সূর্যাস্ত থেকে আরম্ভ
করে এই রাতে আল্লাহতা’লা সর্বনিম্ন (নিকটতম)
আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কেউ
কি আছো ক্ষমা চাইবার, যাকে আমি ক্ষমা করে দিতে পারি?
কেউ কি আছো রিযক চাইবার, যাকে রিযক মঞ্জুর করতে পারি?
কেউ কি আছো মসিবত/পরীক্ষায়, যাকে তা থেকে মুক্ত
করে দিতে পারি?’ ইত্যাদি, ইত্যাদি, যতোক্ষণ না ফজরের সময়
(সূর্যোদয়) হয়।” [হযরত আবদুর রাযযাক (রা:) ও ইবনে মাজাহ
বর্ণিত]
হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, “এক রাতে আমি হুযূর পাক (দ:)-
কে (ঘরে) না পেয়ে ’বাকী’ কবরস্থানে যাই
(এবং সেখানে তাঁর দেখা পাই)। এই সময় তাঁর পবিত্র মস্তক
মোবারক আসমানের দিকে ওঠানো ছিল। তিনি বলেন,
‘ওহে আয়েশা! তুমি কি আশংকা করো যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
(দ:) তোমার প্রতি অন্যায্য আচরণ করবেন?’ আমি বল্লাম,
এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমি মনে করেছিলাম
আপনি হয়তো আপনার কোনো বিবি সাহেবার
কাছে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মধ্য-শা’বানের রাতে মহান
আল্লাহতা’লা সর্বনিম্ন (নিকটতম) আসমানে অবতরণ করেন
এবং বনূ কালব্ গোত্রের মালিকানাধীন সমস্ত ভেড়ার
গায়ে যতো লোম আছে, ওই সংখ্যক
মানুষকে ক্ষমা করে দেন’।” ইমাম আহমদ, ইবনে মাজাহ ও
তিরমিযী বর্ণিত হাদীস; শেষোক্ত হাদীসবিদ বলেন
যে তিনি শুনেছেন ইমাম বোখারী (রহ:) একে ’দুর্বল’
শ্রেণীভুক্ত করেছেন, কেননা এর কতিপয়
বর্ণনাকারী হাদীসটি একে অপরের কাছ
থেকে সরাসরি বর্ণনা করেন নি।
উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন: “এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে বিছানায় পাই নি;
(খুঁজে পেয়ে) আমার হাত তাঁর কদম মোবারকের মধ্যভাগ
স্পর্শ করে, আর ওই সময় তিনি মসজিদে ছিলেন। তাঁর পবিত্র
দুই পায়ের পাতা খাড়া ছিল (অর্থাৎ, সেজদায় ছিলেন)। এমতাবস্থায়
তিনি বলেন, ‘আমি আপনার (আল্লাহর) শাস্তি হতে আপনারই
ক্ষমার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি; আপনার না-রাজি হতে আপনারই
রেযামন্দির আশ্রয় নিচ্ছি; আর আপনার (রুদ্ররোষ)
হতে আপনারই মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আপনার
যেভাবে প্রশংসা প্রাপ্য, সেভাবে আমি আপনার
প্রশংসা করতে অপারগ। আপনি তা-ই, যেভাবে আপনি আপনার
পরিচয় দিয়েছেন’।” এই হাদীস বর্ণনা করেন ইমাম আহমদ,
ইবনে মাজাহ, আবূ দাউদ, নাসাঈ ও তিরমিযী।
অপর এক রওয়ায়াতে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “মধ্য-
শা’বানের রাতে জিবরীল আমীন (আ:) আবির্ভূত
হয়ে আমাকে বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনার সে’র
(মস্তক) মোবারক আসমানের দিকে উত্থিত করুন।’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এটি কোন্ রাত? তিনি জবাব দেন,
‘এটি সেই রাত যখন মহান আল্লাহতা’লা তাঁর রহমতের
তিন’শটি দ্বার উম্মুক্ত করেন এবং সে সব ব্যক্তিকে মাফ
করে দেন যারা তাঁর সাথে (কোনো উপাস্যকে) শরীক
করে নি’।”
হুযূর করীম (দ:) অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “মধ্য-শা’বানের
রাতে (শবে বরাতে) সপ্তম আসমানের
দ্বারগুলো খুলে দেয়া হয়; আর
প্রতিটি দ্বারে ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে মুসলমানদের
জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন যতোক্ষণ
না প্রত্যেক মুসলমানকে মাফ করা হয়; এর ব্যতিক্রম শুধু
কবীরা গুনাহ সংঘটনকারীরা।”
উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত;
তিনি বলেন: “রাসূলে পাক (দ:) এক রাতে আমার ঘরে ছিলেন;
তিনি বিছানায় শুয়েছিলেন যতোক্ষণ
না আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অতঃপর তিনি শয্যা ত্যাগ করেন
এবং আমি (জেগে উঠে) তাঁকে (বিছানায়) পাই নি।
তাঁকে দেখতে পেলাম নামাযে; সংক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে ও রুকু
করে তিনি অত্যন্ত দীর্ঘ এক সেজদায় যান, যার
ফলে অর্ধেক রাত তাতেই অতিবাহিত হয়। অতঃপর
তিনি দ্বিতীয় রাকআতে উঠে দাঁড়ান এবং আবারও রুকু
করে দীর্ঘ সেজদায় সময় অতিবাহিত করেন, যার দরুন প্রায়
ফজরের ওয়াক্ত উপস্থিত হয়। আমার এমন আশংকা হয়
যে তিনি বুঝি বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত)
হয়েছেন। তাই আমি তাঁর মোবারক কদমে হাত রাখি, আর
তিনি নড়ে ওঠেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন।
আমি তাঁকে বলতে শুনি, ‘এয়া আল্লাহ!
আমি আপনাকে সেজদা করেছি (সারা) রাতের অন্ধকারে, আর
(তাই) আমার অন্তর আপনার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। অতএব,
মহাপাপ (কবীরা গুনাহ) ক্ষমা করে দিন, কেননা তা মহাপ্রভু
ছাড়া কেউই মাফ করতে পারে না। আমি আপনার রুদ্ররোষ
থেকে আপনারই রেযামন্দির (সন্তুষ্টির) মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি;
আশ্রয় নিচ্ছি আপনার শাস্তি থেকে আপনারই ক্ষমার মাঝে;
আর আপনার (রুদ্ররূপ) থেকে আপনারই মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি।
আপনি যেভাবে আপনার প্রশংসা করেছেন,
আমি তা পুরোপুরিভাবে করতে অক্ষম।’ অতঃপর
নামাযশেষে তিনি আমায় বলেন, ‘ওহে আয়েশা!
তুমি কি জানো এটি কোন্ রাত?’ আমি বল্লাম, ‘না।’ তিনি বল্লেন,
‘মধ্য-শা’বানের রাত (শবে বরাত)। এই রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর
বান্দাদের দিকে নজর করেন এবং যারা এতে ক্ষমাপ্রার্থী হয়
তাদেরকে মাফ করেন; আর যারা তাঁর করুণা প্রার্থনা করে,
তাদের প্রতি তিনি নিজ করুণা বর্ষণ করেন। কিন্তু যাদের
অন্তরে বিদ্বেষ আছে, তাদেরকে তিনি আগের
সে অবস্থাতেই রেখে দেন’।”
হযরত আবূ নাসর (রা:) থেকে সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ’যম হযরত
আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ:) তাঁর ‘গুনইয়াতুত্ তালেবীন’
পুস্তকে হযরত আয়েশা (রা:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন;
তিনি বলেন: “মধ্য-শা’বানের রাতে একবার মহানবী (দ:) আমার
একখানি বস্ত্র অপসারণ করেন। আল্লাহর কসম! আমার ওই
বস্ত্র রেশমও ছিল না, মিহি রেশমও ছিল না; সেটি সুতোরও
ছিল না, আবার সুতো ও তুলোর (মিশ্রণ)-ও ছিল না; (এমন কি)
তুলোরও ছিল না।” বর্ণনাকারী (আবূ নাসর) বলেন,
“আল্লাহরই প্রশংসা! তাহলে সেটি কিসের তৈরি ছিল?” হযরত
আয়েশা (রা:) উত্তর দেন, “এর বনুন হয়েছিল চুল ও
রেশমের সংমিশ্রণে। আমি ধারণা করেছিলাম
যে তিনি হয়তো তাঁর অপর কোনো স্ত্রীর
কাছে গিয়েছিলেন; তাই আমি উঠে (অন্ধকার) কক্ষে তাঁর
খোঁজ করি। আমার হাত তাঁর কদম মোবারক স্পর্শ করে। ওই
সময় তিনি নামাযে সেজদারত ছিলেন। আমার মনে পড়ে,
তিনি দোয়া করছিলেন এই বলে: ‘(এয়া আল্লাহ), আপনার
সামনে সেজদারত আমার দেহ (মোবারক) ও রূহ
(মোবারক), আর আমার অন্তর রয়েছে আপনারই
হেফাযতে। আমি আপনার রহমত-বরকতের শোকর-গুজার
করি এবং আপনার কাছেই আমার কৃতকর্ম স্বীকার করি।
আমি এস্তেগফার করি; অতএব, আমায় মাফ করে দিন!
আমি আপনার শাস্তি হতে আপনারই ক্ষমার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি;
আপনার রুদ্ররোষ হতে আপনারই করুণার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি।
আপনার না-রাজি থেকে আপনারই রেযামন্দির মাঝে আশ্রয়
নিচ্ছি। আমি আপনার (রুদ্ররূপ) হতে আপনারই মাঝে আশ্রয়
নিচ্ছি। আমি আপনার প্রশংসা করতে পারি না, কেননা আপনি তা-ই,
যেভাবে আপনি আপনার নিজের প্রশংসা করেছেন’।”
অতঃপর মা আয়েশা (রা:) আরও বলেন, “মহানবী (দ:) নামায
পড়া ক্ষান্ত দেন নি, কখনো দাঁড়িয়ে, আবার কখনো বসে,
যতোক্ষণ না ভোর হয়। অতঃপর তিনি তাঁর কদম মোবারক
ওপরে তোলেন এবং আমি তা টিপে দেই। আমি তাঁকে বলি,
আমার বাবা ও মা আপনার জন্যে কোরবান হোন।
আল্লাহতা’লা কি নিশ্চয় আপনার পূর্ববর্তী ও
পরবর্তী কৃতকর্ম মাফ করে দেন নি? তিনি কি আপনার
ব্যাপারে দয়াশীল হন নি? তা নয় কি? তা নয় কি? এমতাবস্থায়
রাসূলুল্লাহ (দ:) উত্তর দেন, ‘ওহে আয়েশা!
আমি কি তাহলে কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? তুমি কি জানো এই
রাতে কী হয়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়ে থাকে?
তিনি বল্লেন, ‘এ রাতে সকল (শিশুর) জন্মের (দিন-ক্ষণ)
লিখে রাখা হয়; আর সকল মৃত্যুরও। এই সন্ধিক্ষণে মনুষ্যজাতির
রিযক-ও বরাদ্দ করা হয়, আর তাদের কৃতকর্মের হিসেব
নেয়া হয়।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর করুণা (রহমত)
ছাড়া কি কেউই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন না?
তিনি আমায় বল্লেন, ‘কেউই আল্লাহর রহমত
ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না।’ অামি আবার জিজ্ঞেস
করলাম, এমন কি আপনিও পারবেন না? বিশ্বনবী (দ:) উত্তর
দিলেন, ‘না, এমন কি আমিও না, যতোক্ষণ না আল্লাহতা’লার
রহমত আমাকে পরিবেষ্টন করছে।’ এরপর তিনি নিজ মস্তক ও
চেহারা মোবারকে তাঁর হাত মোবারক বুলান।” [অনুবাদকের
নোট: মহানবী (দ:)-এর উদ্ধৃত ‘কৃতকর্ম’
শব্দটি দ্বারা তিনি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে মাফ
চাইতে শিক্ষা দিয়েছেন। কেননা, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস
হলো, আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ বে-গুনাহ। বিশ্বনবী (দ:)-এর
‘এস্তেগফার’ করার মানে উম্মতের জন্যে সুপারিশ ছাড়া কিছু
নয় (সূরা নিসা, ৬৪)।]
হযরত আয়েশা (রা:) অন্যত্র বর্ণনা নবী করীম (দ:)-এর
হাদীস, যিনি বলেন: “মধ্য-শা’বানের রাতে আল্লাহ তাঁর
বান্দাদের প্রতি নজর করেন
এবং ক্ষমাপ্রার্থীদেরকে ক্ষমা করেন; আর
যারা অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণ করে, তাদেরকে সেই
অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।” [আত্ তাবারানী কৃত ‘কবীর’
পুস্তক]
হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন যে বনূ কালব্ ওই সময়
সবচেয়ে বড় গোত্র ছিল এবং এর সদস্যদের বড় বড়
ভেড়ার পাল ছিল। অতএব, এই হাদীসে শেষ
বাক্যটি ইশারা করে যে মহান আল্লাহ পাক ওই রাতে অসংখ্য
মানুষকে মাফ করে থাকেন।
রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “মধ্য-শা’বানের
রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের দিকে তাকান এবং এবাদত-
বন্দেগীতে রত বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন; তবে দুই
ধরনের লোককে তিনি ক্ষমা করেন না: ১/
অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারী এবং ২/ খুনী।” [ইমাম
আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীত ‘মুসনাদ’ ও আত্ তিরমিযী]
শবে বরাতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন
ও মো’মেন তথা বিশ্বাসীদেরকে ক্ষমা করেন; আর
অবিশ্বাসীদেরকে শাস্তি প্রদানে নিবৃত্তি দেন,
এবং যারা বিদ্বেষভাব পোষণ করে তাদেরকে নিজ নিজ
বিদ্বেষের আবর্তে ছেড়ে দেন, যতোক্ষণ না তারা তাঁর
কাছে ক্ষমা চায়।
হযরত আবূ বকর (রা:) বর্ণনা করেন, “মধ্য-শা’বানের
রাতে আল্লাহ পাক পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন
এবং প্রত্যেক মো’মেন (বিশ্বাসী)
মুসলমানকে ক্ষমা করেন; এর ব্যতিক্রম শুধু পিতা-মাতার অবাধ্য
সন্তান (আল-’আক্ক) ও যার অন্তরে বিদ্বেষভাব আছে
।” [বায়হাকী তাঁর কৃত ‘শুআব’, ইবনে খুযায়মা (রা:) ও
ইবনে হিব্বান (রা:)]
আল-কাসিম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর সিদ্দিক (রহ:)
তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর চাচা হতে বর্ণনা করেন যে তাঁর পিতামহ
বলেন: “আল্লাহতা’লা মধ্য-শা’বানের রাতে তাঁর সকল সৃষ্টির
প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন; ব্যতিক্রম
শুধু যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে এবং যাদের
অন্তরে বিদ্বেষভাব আছে।” [ইবনে যানজুউইয়ীয়্যা, আদ্
দারু কুতনী কৃত ’সুনান’, ইবনে আদী প্রণীত ‘কামিল’
এবং আল-বায়হাকী রচিত ‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে উদ্ধৃত]
রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “শবে বরাতের
রাতে আমাদের প্রভু খোদাতা’লা পৃথিবীর
আকাশে নেমে আসেন এবং দুনিয়াবাসীকে মাফ করেন;
ব্যতিক্রম কেবল মূর্তি পূজারী ব্যক্তিবর্গ ও
অন্তরে বিদ্বেষভাব
লালনকারী লোকেরা।” [ইবনে মূসা হতে ইবনে
যানজুউইয়ীয়্যা বর্ণিত]
হযরত মুয়ায (রা:) মহানবী (দ:)-এর কথা বর্ণনা করেন;
তিনি বলেন: “আল্লাহ পাক শবে বরাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের
প্রতি রহমতের নযর বিস্তৃত করেন এবং সবাইকে মাফ করেন;
মাফ করেন না শুধু মুশরিক (মূর্তি পূজারী) ও অন্তরে বিদ্বেষ
পোষণকারী ব্যক্তিবর্গকে।” [ইবনে হিব্বান (১২:৪৮১
#৫৬৬৫), আল-আরনাওত এই এসনাদকে সহীহ বলেছেন;
আত্ তাবারানী, আল-হায়তামী যার সনদকে সহীহ
বলেছেন; আল-বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’
এবং ইবনে আসাকিরও এই হাদীস বর্ণনা করেন]
রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আমাদের প্রভু
শবে বরাতে উদিত হন এবং সৃষ্টিকুলকে ক্ষমা করেন;
ব্যতিক্রম শুধু মূর্তি পূজারী ও অন্তরে বিদ্বেষ
পোষণকারী ব্যক্তিবর্গ।” [ইবনে মাজাহ ও ইবনে মনসূর
নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে]
মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “মহান আল্লাহ পাক
শবে বরাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি নজর করেন এবং সকল
সৃষ্টিকে মাফ করেন; মাফ করেন না শুধু মূর্তি পূজারী ও
অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তিদের।” [আল-
বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’]
শবে বরাতে আল্লাহতা’লা যমদূত আজরাঈলের কাছে ওই বছর
যাদের জীবনাবসান চান, তাদের তালিকা প্রকাশ করেন।
[রশীদ ইবনে সা’আদ হতে আদ্ দায়নূরী নিজ ‘আল-মাজালিসা’
গ্রন্থে (মুরসালান)]
হযরত উসমান ইবনে আবি আল-’আস হতে ইমাম বায়হাকী তাঁর
‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন
যে শবে বরাতে আল্লাহ পাক ডেকে বলেন:
“ক্ষমাপ্রার্থী কেউ আছ কি, যাকে আমি মাফ করতে পারি?
আমার কাছে কোনো কিছূ প্রার্থী কেউ আছ কি,
যাকে আমি তা মঞ্জুর করতে পারি?” ফলে যার যা প্রার্থনা,
তা তিনি মঞ্জুর করেন; কিন্তু এর ব্যতিক্রম
হলো দুরাচারে লিপ্ত ব্যভিচারিনী এবং মূর্তি পূজারী।
হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর হাদীস;
তিনি এরশাদ ফরমান: “মহান আল্লাহতা’লা মধ্য-শা’বানের
রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হন এবং বনূ কালব্
গোত্রের মালিকানাধীন ভেড়ার পালের সমস্ত ভেড়ার
লোমের চেয়েও বেশি সংখ্যক
মানুষকে ক্ষমা করেন।” [সাঈদ ইবনে মনসূর প্রণীত ‘সুনান’
দ্রষ্টব্য]
হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলে খোদা (দ:)-এর
বাণী: “শবে বরাতে আল্লাহতা’লা বণূ কালব্ গোত্রের
সমস্ত ভেড়ার লোমের সমপরিমাণ গুনাহ মাফ
করেন।” [বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’]
হযরত আয়েশা হুযূর পূর নূর (দ:)-কে উদ্ধৃত করেন,
যিনি বলেন: “ওহে আয়েশা! তুমি কি ভেবেছ আল্লাহ ও তাঁর
রাসূল (দ:) তোমার প্রতি অন্যায্য আচরণ করবেন? বরঞ্চ
জিবরীল আমীন আমার কাছে এসে বল্লেন, ‘এটি-ই মধ্য-
শা’বানের রাত। আল্লাহতা’লা এ রাতে বনূ কালব্ গোত্রের
সমস্ত ভেড়ার লোমের সমসংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের
আগুন থেকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি মাফ করেন
না মূর্তি পূজারীদের কিংবা অন্যদের
প্রতি অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারীদের;
অথবা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদেরও; অথবা পায়ের
গোড়ালির নিচে বস্ত্র পরিধানকারীদেরও (যারা অর্থ-
বিত্তের দম্ভের প্রতীকস্বরূপ তা পরে); কিংবা পিতা-মাতার
অবাধ্য সন্তানদেরও; অথবা মদ্যপায়ীদেরও।” [বায়হাকী রচিত
‘শুয়াবুল ঈমান’]
এ যাবত যতো হাদীস ও রওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে,
সেগুলো একত্র করলে স্পষ্ট
হয়ে যাবে যে শবে বরাতের ফযীলত তথা ইহ ও পারলৌকিক
উপকারিতার ভিত্তি সুদৃঢ়; আর এই পবিত্র রাত এবাদত-
বন্দেগীতে কাটানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও বিদ্যমান। বস্তুতঃ এ
সব হাদীদের কিছু কিছুকে বেশ কিছু হাদীসবিদ সহীহ
(বিশুদ্ধ) হিসেবে বিবেচনা করেছেন, আর
বাকিগুলোতে ছোটখাটো পরিভাষাগত
ত্রুটি রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেছেন; এই পরিভাষাগত
ত্রুটি হাদীসশাস্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন বর্ণনার
সমন্বয়ে সারানো যায়। এ কারণেই এই উম্মাহ’র
বুযূর্গানে দ্বীনবৃন্দ শবে বরাতকে রহমত-বরকতময়
রজনী হিসেবে এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পালন
করেছেন যুগে যুগে।
শবে বরাতের দোয়া
মাহমূদ আলূসী নিজ তাফসীরগ্রন্থে ইবনে আবি শায়বা কৃত
‘মোসান্নাফ’ পুস্তক হতে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর
কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “বান্দা আল্লাহর কাছে (নিচের)
এই দোয়া করলে তিনি তার জীবন-জীবিকা বৃদ্ধি করে দেন:
হে আল্লাহ! অফুরন্ত রহমত-বরকতের অধিকারী!
হে সর্বোচ্চ শান-শওকত, সম্মান ও ক্ষমতার মালিক!
আপনি ভিন্ন অন্য কোনো খোদা নেই। আপনি-ই
আশ্রয়হীনদের আশ্রয় এবং নৈকট্য অন্বেষীদের
প্রতিবেশী (নিকটবর্তী); মুত্তাকী (খোদাভীরু)-দের
অভিভাবক। এয়া আল্লাহ! আপনি যদি আপনার মূল লিপিতে আমার
দুর্দশা ভারাক্রান্ত হবার বিষয়টি নির্ধারণ করে থাকেন,
তবে তা অপসারণ করুন এবং আমাকে সুখ-সমৃদ্ধি দান করুন।
হে আমার প্রভু! আপনি যদি আপনার কেতাবে আমার
জন্যে আপনার রহমত (আশীর্বাদ) বাদ দেয়ার
কথা লিখে রাখেন, তবে তা মুছে দিন এবং আমার রিযক আমার
জন্যে সহজ করে দিন; আপনার দরবারে আমাকে সুখী,
সৎকর্মশীল ও সমৃদ্ধিশালী করে দিন। কেননা,
আপনি আপনার পাক কালামে এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ যা চান
নিশ্চিহ্ন করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন; এবং মূল লিপি তাঁরই
কাছে রয়েছে’।” (আল-কুরআন, ১৩:৩৯, মুফতী আহমদ
এয়ার খান সাহেব কৃত ’নূরুল এরফান’)
আবদ ইবনে হুমাইদ এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে হযরত
উমর ফারুক (রা:) কাবা শরীফের তাওয়াফকালে দোয়া করেন:
“এয়া আল্লাহ! যদি আপনি লিখে রাখেন
আমি দুঃখী বা পাপী হবো, তবে তা (পরিণতি) মুছে দিন
এবং আমার ভাগ্যে সুখ-সমৃদ্ধি ও গুনাহ মাফের বিষয়টি লিখুন।
কেননা, আপনি যা চান নিশ্চিহ্ন করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন, আর
আপনার কাছেই রয়েছে মূল লিপি।”
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রা:) ও হযরত মোজাহিদ (রা:)-এর
তরীকা (পদ্ধতি) অনুসারে ইবনে জারির তাবারীর বর্ণনায়
এবং অন্যান্য রওয়ায়াত ও আল-এয়াফী’ হতে ‘আল-এবদা’আ’
পুস্তকের লেখকের বিবরণে জানা যায়,
শবে বরাতে প্রথমে যে দোয়া করা হয় তা হলো –
‘এয়া আল্লাহ, অফুরন্ত রহমত-বরকতের মালিক!’
সমাপ্ত